ইন্দিরা গাঁধী।—ফাইল চিত্র।
আমরা তো স্বাধীন ছিলুম না। ছিলুম বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অধীন। আমাদের উপরে আরোপ করা হয়েছিল বিস্তর বিধিনিষেধ। ছিল সামন্ততন্ত্র, ছিল বর্ণশ্রেণীর বৈষম্য। সাধারণ মানুষ তোমার বৈদান্তিক দৃষ্টিভঙ্গির ধার ধারেনা; তারা জানে ধর্মের আচার বিচারের কথাগুলি। জাতির উপরে একটা মতন বোঝার মতন চেপে বসেছিল। তারপর এলো স্বাধীনতা। মহাত্মা গান্ধী সর্বক্ষণ সকলকে স্মরণ করিয়ে দিতেন যে, সুবিধে ভোগ করতে হলে দায়িত্বটাও পালন করা চাই; অধিকারের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী জড়িত থাকে কর্তব্য। কিন্তু দায়িত্ব আর কর্তব্যের কথা ভুলে গিয়ে শুধু লোকে লোকে শুধু সুবিধে আর অধিকারের কথাই ভাবতে শুরু করল। ভাবতে লাগলো যে , স্বাধীনতা যখন পেয়েছি তখন যা খুশি আমরা করতে পারি। কিন্তু তাতো নয়। আমার কোন কোন ভাষণে আমি বলেছি যে, নদী বলতে শুধু মুক্ত জলাধারকেই বোঝায় না, দুদিকের সেই পাড়দুটিকেও বোঝায়, জলাধার কে যা বেঁধে রেখেছে। পাড় যদি না থাকতো, নদীর অস্তিত্বই থাকত না যে। আজ আমার মনে হয় যে, দায়িত্ব, কর্তব্য ইত্যাদি ব্যাপারের উপরে যতটা গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল, তা দেওয়া হয়নি ।
দেশে জরুরী অবস্থা জারি করা হয়েছিল, এটা তার একটা কারণ তো বটেই । কিন্তু জরুরী অবস্থার অনেক অপব্যবহার হয়েছে, এবং সিদ্ধান্তটা যে খুব ভাল হয়েছিল এমনও ও আমি বলতে পারিনা কিন্তু তখন আমার মনে হয়েছিল যে, আমরা প্রথম পথভ্রষ্ট হয়েছি এবং দেশে একটা অদ্ভুত অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তার পরেই আমার বিপক্ষে বেরোল আদালতের রায় এবং কাগজে কাগজে এই নিয়ে একটা হৈচৈ লাগিয়ে দেওয়ার সুযোগও পেয়ে গেলেন বিরোধীরা। তখন আমার মনে হল যে, কংগ্রেস সরকার যদি চলে যায় তাহলে একটা ঘোর বিশৃঙ্খল অবস্থা দেখা দেবে এবং গণতন্ত্র বলতে কিছু থাকবে না। মনে হলো, দেশকে একটা ঝাঁকুনি দেওয়া দরকার। কি করে দেবো, আমার কিছু সহকর্মীর তা নিয়ে আলোচনা ও করেছিলুম তখন। দেশকে ঠিক পথে ফিরিয়ে এনে কর্তব্যের বিষয়এ তাকে সচেতন করতে চেয়েছিলুম।
ঠিক জরুরি অবস্থার কথা আমি ভাবিনি। কিন্তু আমার ই দুই দায়িত্বশীল মন্ত্রী বললেন যে, সংবিধান অনুযায়ী এটা করা যেতে পারে। এঁরা দুজনেই আইনজ্ঞ মানুষ । এঁদের একজন পড়ে এ ব্যাপারে সমস্ত দায়িত্ব অস্বীকার করেছেন বটে, কিন্তু তখন বলেছিলেন অন্য কথা। বলেছিলেন সংবিধান অনুযায়ী তো কাজ করতে হবে, তা সেই অনুযায়ী এটা করা যায়। তো এভাবেই আমরা জারি করেছিলুম জরুরি অবস্থা।
সংবিধান লঙ্ঘনের কথা আমরা কোন সময়ই ভাবি নি। দীর্ঘকাল ধরে জরুরি অবস্থা চালু রাখার ইচ্ছাও ছিল না আমাদের। প্রথমটায় ভেবেছিলুম মাসখানেক এটা চালু থাকবে। রাজনৈতিক কিছু নেতাকে তখন গ্রেফতার করা হয়েছিল,তা আপনারা জানেন। অন্য যাদের গ্রেফতার করা হয়েছিল, জরুরি অবস্থা বলে কোন কথা নেই, যেকোনো অবস্থাতেই তাদের গ্রেফতার করা উচিত। তারা চোরাচালানকারী এবং এইরকমেরই সব দুর্বৃত্ত। কিন্তু জরুরি অবস্থার সময়এ গ্রেফতার করা হয়েছে তো , তাই তারাও রাজনৈতিক ভেক ধরল।
আমারই এক আত্মীয়া ( আন্ট) তার বইয়ে এক যুবকের প্রসঙ্গে লিখেছেন যে, বিনা কারণে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তাকে গ্রেফতার করেছিল শুল্ক বিভাগের কর্মীরা। বইখানি পড়বার আগেই অবশ্য তার নামও আমি জানতুম না । পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি যে, আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অতি মূল্যবান একটি প্রাচীন কোরান চুরি করে সেটি বাইরে পাচার করবার অপরাধে তাকে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু সেই এবং তারই মতো আরো অনেক তখন রাজনৈতিক হিরো বনে গেল। দেশের বাইরে কিছু ভারতীয় তখন জার্মানিতে থেকে যেতে চাইছিল । থাকবার অনুমতি না মেলায় তারাও বলতে লাগল যে, তারা রাজনৈতিক শরণার্থী। জার্মানি আইন অনুযায়ী রাজনৈতিক শরণার্থীকে জার্মান নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। উপরন্তু প্রতি মাসে দেওয়া হয় কিছু টাকা।
বেশকিছু লোক জরুরি অবস্থার সুযোগ নিয়েছিল, এবং এমনভাবে এর অপ- ব্যবহার করেছিল যাতে নিজেদের দোষ ঢেকে রাখা যায়। এছাড়া আর কোনো অসুবিধে হয়নি। না নামাতে হয়েছে সৈন্যবাহিনী, নামাতে হয়েছে পুলিশ। গোড়ায় যখন কিছু লোককে গ্রেফতার করা হয় একমাত্র তখন ছাড়া সত্যিই আর কখনো ও পুলিশ নামাবার কোন দরকার ই হয়নি। এমন কোন ঘটনাই কখনও ঘটেনি, যাতে এই ধরনের কোন ব্যবস্থা নেওয়ার দরকার হয়। জরুরি অবস্থার অবসান ঘটবার কথা আমরা ভাবছিলুম ও, কিন্তু ঠিক তখনই শেখ মুজিবকে সপরিবারে হত্যা করা হলো। ফলে আমাদের থমকে দাঁড়াতে হয়েছিল। তার কিছুদিন বাদেই হত্যা করা হলো শেখ মুজিবের কারারুদ্ধ সহ কর্মীদের। এইসব ঘটনা ঘটায় আমার মনে হয় যে, কে জানে, রাশ ঢিল করবার সময় হয়ত এখনো আসেনি। আর তাছাড়া, জরুরি অবস্থার সময়ে সাধারণ মানুষজনেরা তো কোন অসুবিধে ভোগ করেননি, তাঁরা সুখেই ছিলেন।
সঞ্জয় গাঁধির প্রয়াণের পর ভেঙে পড়েছেন। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।
একটা দৃষ্টান্ত দিই । এক মহিলা আমাকে একটি চিঠি লেখেন। আমি তাঁকে চিনি না।তাঁর নামও আমার মনে নেই। তিনি আমাকে জানান যে, আমাকে কিংবা আমার নীতিকে তিনি কখনো ও সমর্থন করেননি। কিংবা ভোট দেননি কংগ্রেসকে। জরুরি অবস্থা জারি হওয়ার খবর শুনে তিনি খুব রেগে গিয়েছিলেন। কিন্তু বিবেকের তাড়নায় তিনি এই চিঠি লিখছেন। কর্মসূচি তাকে প্রচুর ঘুরতে হয়। ট্রেনে সাধারণত মহিলাদের কামরায় তিনি ভ্রমণ করেন। জরুরি অবস্থা জারি হওয়ার পরে রকমের এক সফরের সময়় কামরাটিকে আমরা দেখে তিনি এক ঝাড়ুদার নিকে ডাকেন। অভ্যাসবশত তিনি বকশিশ দেবার জন্য মানিব্যাগ খুলছিলেন , কেননা বকশিস না পেলে তো কেউ কাজই করে না। কিন্তু ঝাড়ুদারনি কিন্তু ঝাড়ুদারনি তাঁকে জানায় যে, এ কাজের জন্য সে মাইনে পায়; সুতরাং বকশিশ সে নেবে না। ভদ্রমহিলা আমাকে লিখেছেন ," দশ বছর আমি এইভাবে ট্রেনে ঘুরছি, কিন্তু এমন অভিজ্ঞতা এই প্রথম হলো। আর তাই মনে হলো কথাটা আপনাকে জানানো দরকার।"
কিন্তু জরুরী অবস্থার একটা খারাপ দিকও ছিল বই কী। সত্যিই বেশ কিছু লোক তখন ভেবেছিলেন যে, জরুরি অবস্থার সুযোগে নিজেদের কাজ গুছিয়ে নেবেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন আমাদের কিছু মুখ্যমন্ত্রী ও । পরে অবশ্য জরুরি অবস্থার সঙ্গে নিজেদের যোগসম্পর্কের কথা তাঁরা সবৈর্ব অস্বীকার করেন। বস্তুত এমনও ও বলতে থাকেন যে,তাঁরা ছিলেন এর বিরোধী। কার্যত কিন্তু তাঁরা জরুরী অবস্থার সুযোগ নিজেদের রাজনৈতিক বিরোধীদের গ্রেপ্তার করেছিলেন।
একটি রাজ্যে তো স্রেফ বিনা কারণে ৪০০ কংগ্রেসী কে গ্রেফতার করা হয়েছিল। কথাটা আমার কানে যেতেই আমি জিজ্ঞেস করলুম," এঁদের বিরুদ্ধে কি স্পষ্ট কোন অভিযোগ আছে? নয়তোএঁদের গ্রেফতার করা হয়েছে কেন? " শুনলুম , কোন অভিযোগ নেই। তাহলে দোষটা কী? না এঁরা সেখানকার মুখ্যমন্ত্রীর বিরোধী। এঁদের ছাড়িয়ে আনতে আমাদের বিস্তর বেগ পেতে হয়েছিল।
একজন সাংবাদিকের কথা বলি। ইনি আমার সমর্থক ছিলেন না। যে কাগজের ইনি কর্মী , সেই কাগজ আজও আমাদের আমাদের বিরুদ্ধে । কিন্তু সেই সময় এই সাংবাদিক এমন কিছু করেননি, যার জন্য তাঁকে গ্রেফতার করা যায়। কিন্তু সেখানকার মুখ্যমন্ত্রী চাইছিলেন তাঁকে গ্রেফতার করতে। দিল্লিতে থাকতে এই সাংবাদিকটিকে আমরা সর্বতোভাবে রক্ষা করেছিলুম। কিন্তু তিনি দিল্লী ছাড়তেই মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে গ্রেফতার করলেন।
জরুরি অবস্থার শেষ দিকটায় অনেক অন্যায় করা হয়েছিল। নিচের দিকের লোকরাও এর অপব্যবহার করতে থাকে। অপব্যবহার করেছিল পুলিশও। " যা বলছি কর, নয়তো গ্রেফতার করব" - এই ছিল তাদের কথা। তবে ভিত্তিহীন গল্প-গুজব ও কম ছড়ায়নি। তখন আমরা এসব কথা জানতুম না। ক্ষমতাচ্যুত হবার পরে জানতে পারি।
এক সংসদ সদস্যের কাছে একটি ঘটনার কথা শুনেছিলুম। ভদ্রলোক দেরাদুন থেকে ফিরছিলেন। পথে তাঁর গাড়ি বিগড়ে যায়। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভাবছেন কি করবেন, এমন সময় আর একটি গাড়ির আবির্ভাব। গাড়ির চালককে তিনি বললেন," কাছাকাছি এমন কোথাও যদি আমাকে পৌঁছে দেন, যেখানে আমি একটা ট্যাক্সি পেতে পারি তো বড্ড ভালো হয়।" চালক বললেন," যাবেন কোথায়?" ভদ্রলোক বললেন," দিল্লী"। তাতে তিনি বললেন," আরে, আমিও তো দিল্লী ই যাচ্ছি। তাহলে আর ট্যাক্সি নেবার দরকার কি। চলুন আমিই আপনাকে দিল্লিতে পৌঁছিয়ে দেব।" পথে যেতে যেতে এক সময় বললেন ," জরুরি অবস্থা হয়ে কি বিপদ হয়েছে জানেন। এইতো সেদিন সঞ্জয় গান্ধী আমাকে ফোন করে বলল," তোমার যা জমি আছে জমি আছে, তার অর্ধেক আমাকে দিয়ে দিতে হবে, নইলে তোমাকে গ্রেফতার করব।" সংসদ সদস্য টি চেনেন। তিনি বললেন," তার জন্য কি আপনাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল?" উত্তরে এবারেও তিনি বললেন ," না।" সদস্যটি তখন বললেন," সঞ্জয় বললেন না দিলে, আপনাকে গ্রেফতার করা হবে, অথচ আপনি বলছেন, আপনাকে গ্রেফতার করা হয়নি। এ তো বড় অদ্ভুত ব্যাপার। কেন আপনাকে গ্রেফতার করা হলো না বলুনতো?"গাড়ি তখন দিল্লির কাছাকাছি এসে পড়েছে। যে সংসদ সদস্যের কথা বলছি তিনি একটু দুষ্টু মানুষ। বললেন, " এবারে আমাকে কোনো ট্যাক্সি স্ট্যান্ড এর কাছে নামিয়ে দিন।" চালক তাতে বললেন," আরে না। কোথাও কোথায় যাবেন বলুন, সেইখানেই আমি আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি।" গাড়ি যখন প্রাক্তন প্রধান মন্ত্রীর বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছে, সংসদ সদস্য তখন বললেন," সম্ভবত সঞ্জয়কে এখন বাড়িতেই পাওয়া যাবে। চলুন না তাঁকে গিয়ে জিজ্ঞেস করি যে, কথাটা সত্যি কিনা।" তাতে চালক বললেন," কি জানেন, সঞ্জয় গান্ধী আমাকে ফোন করেননি। ফোন করেছেন মি: ধাওয়ান। " তাতে কি সংসদ সদস্য কি বললেন," মি: ধাওয়ান ও ওখানে পাওয়া যাবে নিশ্চয়ই । চলুন, তাঁকেই গিয়ে জিজ্ঞেস করি।" চালোকটি তখন বললেন," না না ধাওয়ান ও নন।" অর্থাৎ চালক ততক্ষণে অন্য সুর ধরেছেন। মোটকথা আমাদের বাড়িতে তিনি এলেন না। বুঝতেই পারছেন না একেবারে বানানো।
রাজনৈতিক দিক থেকে আমরা তখন জরুরি অবস্থার অবসান ঘটাতেই প্রস্তুত। এদিকে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আমরা তখন বেশ এগিয়ে যাচ্ছি। ফলে সিদ্ধান্ত নিতে আমাদের বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। জরুরি অবস্থার যদি অবসান ঘটাই, তো অর্থনৈতিক অগ্রগতি বন্ধ হবে। অন্যদিকে, রাজনৈতিক বিচারে, জরুরি অবস্থার অবসান ঘটাবার পক্ষে সেটাই ছিল ঠিক সময়। অবসান ঘটালে নির্বাচনে আমাদের জিতবার সম্ভাবনা, আর অবসান না ঘটালে আশঙ্কা রয়েছে পরাজয়ের। এই অবস্খায় কি করবো আমি? দুটি পথের কোনটি বেছে নেব? তা আপনারা জানেন যে, কোন পথেটা আমি বেছে নিয়েছিলুম। আমার মনে হয়েছিল, নির্বাচনে হারি কি, সেটা বড় কথা নয়। দেশকে যদি এমন একটা অবস্থায় পৌছিয়ে দিতে পারি, যেখান থেকে তার পদস্খলনের আশঙ্কা নেই,তো সেটাই বড় কথা। হার জিতে কিছু যায় আসে না। সত্যি বলতে কি, আমার কিছু সহকর্মী পরে আমাকে এমন কথাও বলেছেন যে, তখন না হেরে যদি কিছুকাল পরে আমরা হারতুম ,তো ভারতবর্ষকে ইতিমধ্যে একটা শক্ত জমির উপরে দাঁড় করিয়ে দিতে পারতুম আমরা, এবং তার সুফল হতো অনেক। কিন্তু আমার মনে____, সে জায়গায় এদেশ ইতিমধ্যেই পৌঁছেছে। আর তাই , আরও এক_____.......
[নিমাইসাধন বসু প্রণীত ‘আমি: ইন্দিরা গান্ধী’ গ্রন্থ থেকে নেওয়া। লেখাটি পুনঃপ্রকাশিত হল। সৌজন্য: আনন্দ পাবলিশার্স]
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy