বেলা দু’টো থেকে ঠায় বসেছিলেন রাজ্যসভার গ্যালারিতে। পাঁচ ঘণ্টা পরে যখন সংসদ ভবন থেকে আশা ও বদ্রীনাথ সিংহ বেরিয়ে আসছেন, তখন সন্ধ্যা নেমেছে। মুখে টিভি ক্যামেরার আলো পড়তেই আশা দেবীর চোখের কোণে জল চকচক করে উঠল। কান্নায় গলা বুজে আসার আগে বললেন, ‘‘বিল পাশ হয়ে গিয়েছে বলে আমি সন্তুষ্ট। অন্তত এ বার থেকে অপরাধীদের শাস্তি হবে। কিন্তু আমার মেয়েটা বিচার পেল না।’’
আশা-বদ্রীর মেয়ে, তিন বছর আগে দিল্লির গণধর্ষণের শিকার ‘নির্ভয়া’-কে নিয়ে তৈরি হওয়া দেশ জুড়ে আবেগ এবং গত দু’দিন ধরে নির্ভয়ার মায়ের জেদ— এই দুইয়ের চাপের মুখে আজ রাজ্যসভায় ‘নাবালক বিচার সংশোধন বিল’ পাশ হয়ে গেল। ফলে এ বার থেকে ধর্ষণ, খুনের মতো ঘৃণ্য অপরাধের ক্ষেত্রে ১৮ বছরের বদলে ১৬ বছর বয়স থেকেই অপরাধীকে প্রাপ্তবয়স্ক গণ্য করে শাস্তি দেওয়া হবে। যার অর্থ, নির্ভয়ার নাবালক ধর্ষণকারী যে ভাবে তিন বছর বালকাশ্রমে কাটিয়েই ছাড়া পেয়ে গিয়েছে, ভবিষ্যতে তা আর হবে না। তার বদলে ঘৃণ্য অপরাধে অন্তত সাত বছরের জেল হবেই। তবে ১৬ থেকে ১৮ বছর বয়সীদের আমৃত্যু কারাদণ্ড বা ফাঁসির শাস্তি হবে না। অপরাধের মাত্রা বিচার করে অনেক দেশই ঘৃণ্য অপরাধের ক্ষেত্রে নাবালক ও প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে শাস্তির ফারাক রাখেনি। আজ বিল নিয়ে খুঁটিনাটি অনেক প্রশ্ন উঠলেও শেষপর্যন্ত জনমতের চাপের মুখে সেই পথে এগোল ভারতও।
গত কাল পর্যন্তও নাবালক বিচার আইনে সংশোধনী বিল নিয়ে কংগ্রেস, তৃণমূল, সিপিএম— সকলেরই মত ছিল, একটি ঘটনার ভিত্তিতে বয়ঃসীমা কমিয়ে আনাটা ভুল। তাই আরও আলোচনার জন্য বিলটি সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানো দরকার। কিন্তু নির্ভয়ার মা জেদ ধরেন, বিল পাশ করাতেই হবে। আজ দুপুরে চলে যান রাহুল গাঁধীর বাড়িতে গিয়ে তাঁকে বিল সমর্থনে অনুরোধ করেন। রাহুল কথা দেন, তাঁরা বাধা দেবেন না। এর আগে সংসদীয় প্রতিমন্ত্রী মুখতার আব্বাস নকভির কাছে গিয়েও একই দাবি জানান আশা দেবী। মুখতারও একই আশ্বাস দেন। এর পরেই রাজ্যসভার গ্যালারিতে বসেন আশা-বদ্রী।
এই পরিস্থিতিতে কংগ্রেস আজ আর একে সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানোর দাবি তোলেনি। একই পথে হেঁটেছে তৃণমূলও। কংগ্রেসের শান্তারাম নায়েক ও তৃণমূলের ডেরেক ও’ব্রায়েন বিলটিকে সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব ফিরিয়ে নেন। বাকিরাও মুখে সিলেক্ট কমিটির দাবি তুললে এ নিয়ে চাপ দেননি। একমাত্র সিপিএম বিলটি সিলেক্ট কমিটিতে না পাঠানোর প্রতিবাদে ওয়াক-আউট করে।
পাঁচ ঘণ্টা ধরে বিল নিয়ে বিতর্ক চলেছে। বিলের ফাঁকফোকর নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অনেক সাংসদই যুক্তি দেন, কোনও কিশোর অপরাধ করলেও সে কী ভাবে মানুষ হচ্ছে, কোন পরিস্থিতিতে, কাদের প্রভাবে অপরাধ করছে, তা দেখা দরকার। কেননা, পরিসংখ্যান বলছে, সিংহভাগ ক্ষেত্রেই হতদরিদ্র, নিরক্ষর পরিবারের শিশুরাই অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। ১৬-১৭ বছর বয়সী কোনও অপরাধীকে জেলে পাঠালে সে অন্য অপরাধীদের সংস্পর্শে এসে আরও বড় অপরাধী হয়ে বের হতে পারে। বরং বালকাশ্রমে রেখে চরিত্র সংশোধন করা যায়। ইয়েচুরি যুক্তি দিয়েছেন, ‘‘আজ নির্ভয়ার অপরাধীর বয়স ১৮-র কম ছিল বলে ১৬ বছর করা হচ্ছে। কাল ১৫ বছর ১১ মাসের কেউ অপরাধ করলে কি ফের বয়স কমানো হবে?’’
বিজেপির সাংসদরা আবার পাল্টা যুক্তি দিয়েছেন, যে ধর্ষণ করছে, তাকে আর কোন যুক্তিকে নাবালক বলা যায়? অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করেন, এই আইনের অপপ্রয়োগ হতে পারে। কোনও কিশোর-কিশোরী স্বেচ্ছায় শারীরিক সম্পর্কে জড়ালেও মেয়েটির বাবা ছেলেটির বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আনতে পারে। নির্ভয়ার বাবা-মা কখনও হতাশায় মাথা নেড়েছেন। কখনও আবার পছন্দসই যুক্তি শুনে সম্মতি জানিয়েছেন।
নারী ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রী মেনকা গাঁধীর যুক্তি, এমন নয় যে ১৬ বছর বয়স হলেই কাউকে আদালতের কাঠগড়ায় তোলা হবে। প্রথমে জুভেনাইল বোর্ডই খতিয়ে দেখবে, অপরাধ কতখানি ঘৃণ্য, কী পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিতে, কোন মানসিক অবস্থায় অপরাধ করেছে ও অভিযুক্ত পরিণতি বুঝে, পরিণতমনস্ক হিসেবেই অপরাধ করেছে কি না। কেউ যদি রোজ বাবাকে মদ্যপান করে মা’কে মারতে দেখে, আর একদিন বাবার মাথায় মদের বোতল দিয়ে মেরে খুন করে ফেলে, তা হলে সে নিশ্চয়ই মানসিক ভাবে অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হবে না। সেই ভিত্তিতে ঠিক হবে, জুভেনাইল বোর্ডে বিচার হবে, না কি আদালতে। মেনকা বলেন, ‘‘শাস্তি হলেও কিশোর অপরাধীদের সাধারণ জেলে অন্যদের সঙ্গে রাখা হবে না। অপ্রাপ্তবয়স্কদের বিশেষ সংশোধনাগার তৈরি হবে।’’ সেখানে তাদের ২১ বছর বয়স পর্যন্ত রাখার পর মানসিক অবস্থার বিচার হবে। অপরাধীর মানসিকতা রয়ে গেলে পুরো সাজা হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy