এ দেশের রাজনীতিকদের সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করার মানসিকতাকে বড় মাপের ধাক্কা দিয়ে আজ বিচারপতিদের নিয়োগ ও বদলি সংক্রান্ত নতুন আইন বাতিল করে দিল সুপ্রিম কোর্ট। সংসদে যখন এই আইন পাশ হয়েছিল, তখন এক জন সাংসদও এর বিরুদ্ধে ভোট দেননি। (রাজ্যসভায় শুধু ওয়াকআউট করেছিলেন প্রবীণ আইনজীবী রাম জেঠমলানী।) শীর্ষ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে সরকার। শাসক দলের সমালোচনা করেও পুরনো বিচারপতি-নিয়ন্ত্রিত নিয়োগ ব্যবস্থা সংস্কারের পক্ষেই রায় দিয়েছে বিরোধী কংগ্রেস। ফলে আইনসভা ও বিচারব্যবস্থার মধ্যে সংঘাতের সম্ভাবনা তৈরি হল বলেই অনেকের মত।
বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে নানা সমালোচনার মুখে প্রায় দু’দশক আগে কলেজিয়াম ব্যবস্থার সূত্রপাত হয়। এই ব্যবস্থায় হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগ, বদলি এবং পদোন্নতির দায়িত্ব পান সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি-সহ পাঁচ জন সিনিয়র বিচারপতি। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ব্যবস্থা ঘিরেও নানা অভিযোগ উঠতে থাকে। বলা হয়, বিচারপতি নিয়োগ, বদলি ইত্যাদির ক্ষেত্রে স্বজনপোষণ চলছে। ঢুকে পড়েছে দুর্নীতি। এই পরিস্থিতিতে নতুন ব্যবস্থা প্রবর্তনের ভাবনা শুরু হয়ে আগের ইউপিএ আমলে। তখন একটা খসড়া বিল তৈরি হলেও তা সংসদে পাশ হয়নি। নরেন্দ্র মোদী অবশ্য ক্ষমতায় আসার দু’মাসের মধ্যেই সংবিধান সংশোধন করে জাতীয় বিচারপতি নিয়োগ কমিশন তৈরি করে।
এই কমিশনের সদস্য সংখ্যা ছয়। তাঁদের মধ্যে প্রধান বিচারপতি, সুপ্রিম কোর্টের প্রবীণতম দুই বিচারপতির সঙ্গে কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রীকে রাখার কথা বলা হয়। এ ছাড়া বাকি দুই সদস্য হবেন সমাজের দুই বিশিষ্ট ব্যক্তি। তাঁদের বাছাই করতে আবার একটি কমিটি গঠিত হয়। তাতে রাখা হয় প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলনেতা এবং প্রধান বিচারপতিকে।
কিন্তু এই কমিশন নিয়ে একেবারে গোড়া থেকেই আপত্তি তোলে বিচারপতি মহল। তাদের বক্তব্য, এই কমিশনের মাধ্যমে বিচারপতিদের নিয়োগ-বদলির উপরে নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে চাইছে সরকার। আপাতদৃষ্টিতে দেখলে নিয়োগ কমিশনে সরকার সংখ্যালঘু। তাদের প্রতিনিধি মাত্র এক। কিন্তু ঘুরপথে সরকারের অপছন্দের লোকের নিয়োগ বন্ধ করার ব্যবস্থা করা হয়েছে বলেই অভিযোগ আইনজীবীদের।
কী ভাবে? আইন অনুসারে কমিশনের দু’জন সদস্য আপত্তি জানালেই কোনও নিয়োগ, বদলি বা পদোন্নতি কার্যকর করা যাবে না। আইনজীবী মহলের বক্তব্য, দুই বিশিষ্ট ব্যক্তিকে নিয়োগের যে কমিটি, তাতে রাজনীতিকরাই সংখ্যাগুরু। ফলে তাঁরা এক জোট হয়ে এক জনকে নিয়োগ করতে পারলেই কেল্লাফতে। তখন আইনমন্ত্রী ও সেই বিশিষ্ট ব্যক্তি মিলে সরকারের অপছন্দের সব বিচারপতির পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়াবেন। সরকারের বহু মামলা বিভিন্ন আদালতে থাকে। কোথাও সরকার বাদী, কোথাও বিবাদী। এখন উঁচু আদালতে নিয়োগ বা পদোন্নতির পথে সরকার বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে এই আশঙ্কায় অনেক বিচারকই সরকারের বিরুদ্ধে রায় দিতে ভয় পাবেন।
সুতরাং আইন পাশ হতে না-হতেই সুপ্রিম কোর্টে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়। বিচারের জন্য গঠিত হয় পাঁচ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চ। ৩১ দিনের শুনানিতে এক দিকে সরকারের পক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মুকুল রোহতগি কলেজিয়াম ব্যবস্থার তীব্র সমালোচনা করেছেন। জানিয়েছেন, এই ব্যবস্থা বেআইনি। যাঁদের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে, তাঁদেরও সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতির পদে নিয়োগ করা হচ্ছে। উল্টো দিকে ফলি নরিম্যান, অনিল দিওয়ানের মতো প্রবীণ আইনজীবীরা যুক্তি দিয়েছেন, গোটা বিশ্বেই সরকার বিচারব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে চায়। কেন্দ্রীয় সরকার সুপ্রিম কোর্টে সব চেয়ে বেশি মামলা লড়ে। সেই সরকারই বিচারপতি নিয়োগ করলে, নিরপেক্ষ বিচার হবে না।
সরকার-বিচারবিভাগ টানাপড়েনে আটকে থমকে যায় বিচারপতি নিয়োগের গোটা প্রক্রিয়াটাই। কারণ, মামলা চলছে বলে কমিশনের বৈঠকে যাননি প্রধান বিচারপতি। ফলে সুপ্রিম কোর্টে তিন জন বিচারপতির পদ ফাঁকা। বিভিন্ন হাইকোর্টেও ৩৯২টি শূন্যপদ রয়েছে। প্রতিদিন মামলার পাহাড় আরও উঁচু হচ্ছে। এই সঙ্কটের মুখে সুপ্রিম কোর্ট আজ নিয়োগ কমিশন গড়ার আইনকে সংবিধান-বিরোধী আখ্যা দিয়ে পুরনো কলেজিয়াম ব্যবস্থাই চালু রাখার কথা
বলেছে। তাদের মতে, আইনমন্ত্রী, বিরোধী দলের নেতাদের বিচারপতি নিয়োগের মধ্যে জড়ালে অরাজকতা তৈরি হবে। তবে কলেজিয়াম ব্যবস্থায় যে খুঁত রয়েছে তা মেনে নিয়ে তাকে আরও স্বচ্ছ করতে চাইছে বেঞ্চ। এই বিষয়ে সরকার ও সব পক্ষের মত জানতে চেয়েছে শীর্ষ আদালত। ৩ নভেম্বর ফের এই বিষয়ে শুনানি হবে।
তবে ঘটনা হল, বিচারপতিদের নিয়োগ কী ভাবে হওয়া উচিত, তা নিয়ে আইনজীবী শিবিরও দ্বিধাবিভক্ত। সাংবিধানিক বেঞ্চের বিচারপতিদের মধ্যেও ঐকমত্য তৈরি হয়নি। বিচারপতি জে এস খেহর, মদন বি লোকুর, কুরিয়ান জোসেফ, আদর্শকুমার গয়াল মোদী সরকারের তৈরি নিয়োগ কমিশনকে অসাংবিধানিক বলে আখ্যা দিলেও, ভিন্ন মত পোষণ করেছেন বিচারপতি জে চেলামেশ্বর। আইনজীবী মহল একমত, ভারতের ইতিহাসে শাসনব্যবস্থার দুই স্তম্ভের মধ্যে এ হেন সংঘাত আগে কখনও হয়নি।
সংঘাতের জল যে আরও গড়াবে তার ইঙ্গিত আজই দিয়েছেন কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী সদানন্দ গৌড়া। তিনি বলেন, ‘‘সংসদের দুই কক্ষে একশো শতাংশ সদস্যের সমর্থনে এই বিল পাশ হয়েছিল। ২০টি রাজ্যের বিধানসভা এতে সিলমোহর বসিয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট আজ সাধারণ মানুষের ইচ্ছাকেই খারিজ করে দিল।’’ কেন্দ্রীয় সরকারের সূত্র বলছে, ফের সংসদে আইন করে কলেজিয়াম ব্যবস্থা খারিজ করার ব্যাপারে চিন্তাভাবনা ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। সরকারের যুক্তি, আর কোনও দেশে বিচারপতি নিয়োগের ক্ষমতা এ ভাবে বিচারপতিদের হাতে কুক্ষিগত নয়। ওই প্রক্রিয়ায় গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত প্রতিনিধি, নাগরিক সমাজের মত থাকা দরকার।
আইনজীবী মহলের একাংশ অবশ্য এই যুক্তি মানতে নারাজ। সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি অশোককুমার গঙ্গোপাধ্যায় যেমন বলছেন, ‘‘যে ভাবে অসহিষ্ণুতা বাড়ছে, সরকারের বিরুদ্ধমত দমন করা হচ্ছে, সেখানে বিচারপতি নিয়োগ আরও গুরুত্বপূর্ণ। তা ছাড়া আমাদের গণতন্ত্র এখনও আমেরিকা-ব্রিটেনের মতো পরিণত নয়।’’ আইনজীবীদের একাংশের যুক্তি, বিচারপতি নিয়োগে সরকারি হস্তক্ষেপ হলে আখেরে বিচারব্যবস্থা স্বাধীন থাকবে না। ক্রমশ তা দুর্বল হয়ে পড়বে। বিচারপতিরা শুধু সরকারের কথাই শুনবেন। আমজনতা সুবিচার পাবে না।
তবে সুপ্রিম কোর্ট যে আইনটা পুরোপুরি খারিজ করে দেবে, তা কেন্দ্রীয় সরকার আশা করেনি। সোলি সোরাবজির মতো আইনজ্ঞরাও বলছেন, এই রায় অপ্রত্যাশিত। সংবিধান সংশোধনে কোনও ভ্রান্তি থাকলে সেগুলি ঠিক করার নির্দেশ দিতে পারত শীর্ষ আদালত। বস্তুত কেন্দ্রের তরফে অ্যাটর্নি জেনারেলও সেই কথাই বলেছিলেন আদালতে। শুনানির প্রথম দিকে তিনি বলেছিলেন, সংবিধানে কোথাও বলা নেই যে প্রধান বিচারপতিই অন্য বিচারপতি নিয়োগে শেষ কথা বলবেন। সুপ্রিম কোর্ট ১৯৯৮ সালে একটি রায় দিয়ে নিজের হাতে এই ক্ষমতা তুলে নিয়েছে। এর ফলে অযোগ্য বিচারপতিদের নিয়োগ করা হচ্ছে। দেওয়া-নেওয়ার খেলা চলছে। পরের দিকে তিনি সুর নরম করে জানান, সংবিধান সংশোধনে কোনও সমস্যা থাকলে কেন্দ্র ফের তা সংশোধন করতে রাজি। সুপ্রিম কোর্ট অবশ্য সেই সুযোগ দেয়নি। রোহতগি আরও বেশি বিচারপতির বেঞ্চে মামলা নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। সেই চেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy