জল খাওয়া ভাল কিন্তু অতিরিক্ত নয়। প্রতীকী চিত্র।
জলের অভাবে শরীরে ডিহাইড্রেশন হলে বেশ কিছু সমস্যা হয়, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু এর ঠিক বিপরীতটাও ঘটে। শরীরে স্বাভাবিকের চেয়ে জলের পরিমাণ অতিরিক্ত বেড়ে গেলে নানা ধরনের সমস্যা হয়। শরীরে জল জমছে আন্দাজ করতে পারলেই সচেতন হওয়া প্রয়োজন। কারণ জল জমছে মানে শরীরের একাধিক অঙ্গের বা কোনও একটি অঙ্গের ক্ষতি হয়েছে এবং হচ্ছে। এই সমস্যা শুধু বয়স্ক নয়, যে কোনও বয়সে হতে পারে।
আমাদের শরীরে রক্তে এবং প্রতিটি কোষের মধ্যে জল থাকে। কিন্তু তার পরেও অতিরিক্ত জল শরীরে জমতে পারে একাধিক কারণে। পেট, ফুসফুস, হৃৎপিণ্ড, পায়ের পাতা ও গোড়ালি, চোখের তলায়, মস্তিষ্কে— প্রধানত ছ’টি জায়গায় জল জমার প্রবণতা বেশি। পেটে জল জমা বা অ্যাসাইটিসের জন্য অনেকটাই দায়ী লিভার সিরোসিস বা অতিরিক্ত ফ্যাটি লিভার। এ ছাড়া হার্ট ও ফুসফুসে জল জমতে পারে। যথাক্রমে যাদের ডাক্তারি ভাষায় বলে পেরিকার্ডিয়াল ইফিউশন এবং প্লুরাল ইফিউশন। কিডনির সমস্যার জন্য পায়ের পাতা, গোড়ালি, চোখের তলা ফুলে যায়। এ ছাড়া হাঁটুর মধ্যে, মালাইচাকিতে জল জমে।
শরীরে জল জমার কারণ
এর কারণ ব্যাখায় ডা. অরুণাংশু তালুকদার বললেন, ‘‘শরীরে জল জমা মানে শরীরের অরগ্যানগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। না হলে সাধারণত জল জমার কথা নয়। লিভার, হার্ট, কিডনির ইনফেকশন, থাইরয়েডের সমস্যা, রক্তাল্পতা, অপুষ্টি, সুষম আহারের অভাব, প্রোটিনের অভাবে শরীরে জল জমতে পারে। গর্ভাবস্থায় অনেকে অ্যানিমিক হয়ে পড়েন, তখন তাঁদের হাত পা ফোলে। আবার বেশ কিছু ওষুধের ব্যবহারে, বিশেষ করে, উচ্চরক্তচাপের জন্য কিছু ওষুধ দেওয়া হয় যার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় পা ফোলে। কিডনির স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা ব্যাহত হলে মুখ ও পা ফুলে যায়।’’ কিডনি যাতে ঠিক মতো কাজ করে তার জন্য স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া জরুরি। অতিরিক্ত রেড মিট, অতিরিক্ত পটাশিয়াম ও ফসফরাস ছাঁকতে কিডনির উপরে যথেষ্ট চাপ পড়ে। এতে কিডনির স্বাভাবিক কাজ ব্যাহত হয়।
জল জমলে বুঝবেন কী করে
শরীরে জল জমছে এটা চট করে বোঝা যায় না। সমস্যা কিছুটা বাড়লে লক্ষণ প্রকাশ পায়। যেমন যক্ষ্মা, নিউমোনিয়া হলে ফুসফুসে জল জমে, কিডনি বিকল হলে পায়ে জল জমে ইত্যাদি। ‘‘শরীরে জল জমলে হাঁটতে-চলতে অসুবিধে হবে, শ্বাসকষ্ট হবে, বুকে চাপ বাড়বে, শরীর ভারী লাগবে। অ্যাসাইটিস বা পেটে জল জমলে পেট ফুলবে, ওজনও বাড়বে, বদহজম হবে। এ ক্ষেত্রে ওষুধ দিলে খুব তাড়াতাড়ি ওজন কমে যায়, সাত দিনে তিন-চার কেজি কমে। ফ্যাট জমে মোটা হলে কিন্তু ওষুধে কাজ হয় না। তাই সব মোটা হওয়া কিন্তু ওবেসিটি নয়। সেটা মাথায় রাখতে হবে,’’ বললেন ডা. তালুকদার।
পেরিকার্ডিয়াল ও প্লুরাল ইফিউশন
হার্ট বা ফুসফুসে জল জমা শুরু হলে শ্বাসকষ্ট, বুকের উপরে ভার অনুভব করা, কাশি ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দেবে। যদিও হার্টের ভিতরে জল জমে না। জল জমে হার্টের উপরে থাকা দুটো পর্দার মাঝখানে। যেখানে তরল পদার্থের একটা পাতলা আস্তরণ থাকে। এই পর্দা দুটোর মাঝখানে জল জমাকেই বলে পেরিকার্ডিয়াল ইফিউশন। ‘‘এর পিছনে আছে নানা কারণ। অন্যতম প্রধান কারণ ভাইরাল, ব্যাকটিরিয়াল ও ফাঙ্গাল ইনফেকশন। এই ধরনের ইনফেকশন হলে সাধারণত জ্বর হয়। এ ছাড়া থাইরয়েড, অটোইমিউন ডিসঅর্ডার, ক্যানসার, হার্ট অ্যাটাকের ফলে জল জমতে পারে। হার্টে বা পেরিকার্ডিয়ামে টিউমর হলে এবং বুকে বড়সড় আঘাত পেলে তার থেকেও হতে পারে পেরিকার্ডিয়াল ইফিউশন,’’ বললেন হৃদ্রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. সুনীলবরণ রায়।
ফুসফুসের উপরেও একটা পর্দা থাকে, যাকে বলে প্লুরা। এই পর্দার দুটো লেয়ার। দুটোর মাঝে পাতলা তরল পদার্থের আস্তরণ থাকে যাতে শ্বাস নেওয়ার সময় কোনও রকম বাধার সৃষ্টি না হয়। বিভিন্ন কারণে এই দুটো লেয়ারের মাঝখানে জল জমার সমস্যাকে বলে প্লুরাল ইফিউশন। ‘‘যক্ষ্মা, নিউমোনিয়া, ক্যানসার, কিডনির সমস্যা, লিভার সিরোসিস, হার্ট ফেলের জন্য প্লুরাল ইফিউশন হতে পারে। বিভিন্ন রোগ ছাড়াও শরীরে প্রোটিনের অভাব, রক্তাল্পতা, কিডনির সমস্যায় প্লুরাল ইফিউশন হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। প্লুরাল ইফিউশন বা পেরিকার্ডিয়াল ইফিউশন গোড়ার দিকে ধরা গেলে চিকিৎসার মাধ্যমে সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়া যায়,’’ বললেন ডা. রায়।
হাইড্রোসেফালাস ও ব্রেন ইডিমা
আমাদের মস্তিষ্কের ভিতরে স্বাভাবিক ভাবেই যে তরল পর্দাথ থাকে তাকে বলে সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড বা সিএসএফ। এই সিএসএফ মস্তিষ্কে তৈরি হয় এবং বেরিয়েও যায়। এটি স্পাইনাল কর্ডেও থাকে। সিএসএফ ব্রেনকে ভাসিয়ে রাখে এবং সার্কুলেশন সিস্টেম ঠিক রাখে। মস্তিষ্কের ভিতরে ছোট ছোট চেম্বার বা ভেন্ট্রিকেলস আছে, সেখানে সিএসএফ তৈরি হয়। প্রতিদিন যতটা সিএসএফ তৈরি হয় ততটাই শিরার মধ্য দিয়ে বেরিয়ে যায়। এই তৈরি হওয়া এবং বেরোনোর সামঞ্জস্য নড়ে গেলে বা তৈরি বেশি, বেরোনোটা কম হলেই সমস্যার শুরু। তখন ভেন্ট্রিকেলস বেলুনের মতো ফুলতে থাকে অর্থাৎ মস্তিষ্কে সিএসএফ জমতে থাকে, যাকে ডাক্তারি ভাষায় বলা হয় হাইড্রোসেফালাস।
নিউরোলজিস্ট ও স্ট্রোক স্পেশ্যালিস্ট ডা. জয়ন্ত রায় এই অসুখের কারণ সম্পর্কে বলতে গিয়ে বললেন, ‘‘হাইড্রোসেফালাসের পিছনে একাধিক কারণ আছে। জন্মগতও হতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রথম থেকেই ভেন্ট্রিকেলসের ঢোকা-বেরোনোর পথ ঠিক মতো তৈরি না হলে সমস্যা হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন অসুখের কারণে বয়সকালেও এই সমস্যা হতে পারে। হাইড্রোসেফালাস হলে অপারেশন করে একটা বিকল্প রাস্তা বার করতে হয়, যাকে বলা হয় শান্টিং। ভিপি শান্ট বা ভেন্ট্রিকিউলোপেরিটোনিয়াম শান্টের মাধ্যমে সরু ভালভের দ্বারা অতিরিক্ত ফ্লুইড পেটে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। হাইড্রোসেফালাস ছাড়াও ব্রেন ইডিমার জন্য মস্তিষ্কে জল জমে। এ ক্ষেত্রে ব্রেনের টিসুর মধ্যে জল জমে ফুলে যায়। সাধারণত ব্রেন ইনজুরি, ব্রেন ইনফেকশন, স্ট্রোক, ব্রেন টিউমরের কারণে এই সমস্যা হতে পারে। সে ক্ষেত্রে উপায় অপারেশন বা ওষুধ।’’ মস্তিষ্কে যে অতিরিক্ত জল জমছে তা চট করে ধরা যায় না। ‘‘বাচ্চাদের ক্ষেত্রে ধরা যায়, তাদের মাথা বড় হতে থাকে। প্রাপ্তবয়স্কদের মতো শিশুর মাথায় খুলি জোড়া থাকে না। ফলে তরল সে সব ফাঁক পেয়ে ঢোকে। ব্রেন ফুলতে শুরু করে এবং মাথা বড় হতে থাকে। একে বলে ম্যাক্রোকেফালি,’’ বললেন ডা. রায়।
প্রাপ্তবয়স্কদের অন্যতম উপসর্গ মাথাব্যথা। যদিও মাথাব্যথা অন্য অনেক রোগের উপসর্গ, ‘‘মাথাব্যথার সঙ্গে ব্যালান্সের সমস্যা হবে। মানুষটি চুপচাপ হয়ে যাবেন, কম কথা বলবেন, ভুলে যাবেন। কারণ মস্তিষ্ক কাজ করা কমিয়ে দেবে। এতে প্রাথমিক ভাবে মনে হতে পারে মানসিক সমস্যা। কিন্তু সেই সময়ে খেয়াল করতে হবে বয়স্ক মানুষটির ভারসাম্যের সমস্যা এবং ইউরিন কন্ট্রোলে সমস্যা হচ্ছে কি না। এই ধরনের সমস্যা হলে দ্রুত স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে,’’ বললেন ডা. রায়। হাইড্রোসেফালাস এবং ব্রেন ইডিমা দুটো ক্ষেত্রেই সময় মতো রোগনির্ণয় হলে চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ হওয়া যায়।
ঊর্মি নাথ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy