সোনার দাম কমা-বাড়ায় উৎসাহ থাকে সাধারণ মানুষেরও, শুধুমাত্র অর্থনীতির বোদ্ধাদের কাছেই তা সীমাবদ্ধ নয়। অর্থনীতিবিদরা মূল্যবৃদ্ধির কারণ জানাচ্ছেন। তবে মানুষ আমেরিকা ও চিনের শুল্কের অ-বনিবনার বিষয়ে প্রবেশে অনিচ্ছুক। যদিও সোনার ঊর্ধ্বমুখী দাম, তাঁদের জীবনকে প্রভাবিত করছে।
প্রথমেই ‘কন্যাদায়গ্রস্ত বাবা-মা’দের অসুবিধার কথা। সোনার গয়না বিয়েতে পরতে হবেই। মেয়েটি শিক্ষিকা, উপার্জনক্ষম হলেও গয়নার ব্যবস্থার দায়িত্ব শেষ পর্যন্ত অভিভাবকের— গৌরীদানের যুগের একশো বছর পরও কি প্রাসঙ্গিক এই কথা?
সমীক্ষা বলছে একটি ভারতীয় পরিবার বিয়ের বাজেটের ২৫% ব্যয় করে সোনার গয়না কিনতে। উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারের সেই খরচ প্রায় ২৫ লাখ টাকা। প্রতি বিয়েতে গড়ে ৩৯৪ গ্রাম সোনা (দু’পক্ষের পরিবার মিলিয়ে) কেনা হয়। মাথাপিছু সোনা কেনার হার উচ্চবিত্ত শ্রেণিতে বেশি হলেও, মোট সোনা সবচেয়ে বেশি কেনে মধ্যবিত্ত শ্রেণি (বার্ষিক আয় ২-১০ লাখ)।
সোনার বিকল্প, সোনালি গয়নার বিজ্ঞাপনেও মুখ ঢেকে যায়। কথা বলে জেনেছি, বহু কমবয়সি মেয়ে ভাল ব্র্যান্ডের সোনার মতো দেখতে গয়না পরেই বিয়ের পিঁড়িতে বসে। ‘কেউ যদি জানতে পারে?’ মেয়েটি (এই বুদ্ধি খাটিয়েই উত্তীর্ণ) এবং তার বন্ধু আত্মবিশ্বাসী— ‘এত আলো, সাজের মধ্যে বোঝা যাবে না। তার পর তো সব লকারে— সেখানে সোনা কী আর অমুক ব্র্যান্ডই বা কী?’ ‘সোনাকে স্ত্রীধন বলতেন মা-দিদিমারা’। শুনে বলল, অন্য কোনও ‘অ্যাসেট’-এর ফর্ম তখন ছিল না। তাঁরা চাকরি করতেন না। হাতে টাকা থাকার, উপার্জনের অর্থ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহারেরও প্রশ্ন নেই। গয়নাই একমাত্র সম্পদ।
যুক্তিগুলো সাজানো যাক। বিয়েতে ঐতিহ্যবাহী সাজগোজে আপত্তি নেই। নানান সাজপোশাক, মানানসই গয়না এবং ছবি। বিবাহ সংক্রান্ত খরচের বিশাল অংশ জুড়ে আছে মূলত সমাজমাধ্যমের ছবি, প্রতি বিয়ের নির্দিষ্ট হ্যাশট্যাগ, রিল। দু’-তিন দিনের উদ্যাপন নব্বই দশকের সিনেমা থেকে শুরু হলেও, বাঙালি বিয়েতে জনপ্রিয় হতে সময় নিয়েছে। এখন তিন-পাঁচ দিনের উদ্যাপন, বিভিন্ন পোশাক এবং তার ছবিই সামাজিক মান্যতা পাওয়ার ধরন।
এই বিশাল আর্থিক প্রয়োজন, শ্রেণিবিশেষে তার তারতম্য তো হবেই। যে তরুণী চিত্রতারকার লেক কোমো-র বিবাহবাসরের ছবি দেখছে তার তেমনটা ইচ্ছা হওয়া হয়তো সমর্থনযোগ্য নয়, কিন্তু স্বাভাবিক। সাধ ও সাধ্যের ব্যবধান পূরণে প্রবেশ করেছে ডিজ়াইনারের নকল, তস্য নকল পোশাকের সম্ভার, ব্র্যান্ডেড সোনার দোকানে হুবহু নকশার নকল-সমেত সোনালি গয়নার পসরা।
প্রশ্ন ওঠে, নতুন প্রজন্মের মেয়েরা যখন এতটাই আত্মনির্ভর, তাদের সোনার গয়নায় মোহ নেই তখন সোনালি গয়নার কী প্রয়োজন? উত্তর সম্ভবত লুকিয়ে জিনসঞ্চিত ম্যাগপাই কমপ্লেক্স (ঝকমকে বস্তুর আকর্ষণ) ও সামাজিক গণমাধ্যম-নির্ভর মান্যতা পাওয়ার চেষ্টায়। সোনার গয়না নেই, বা কেনার টাকা নেই— সেই কথা সামাজিক মান্যতার ক্ষেত্রে প্রশ্ন তোলে, তাই হয়তো ব্র্যান্ডেড সোনালি গয়নার এমন ব্যবসা।
ভারতের সোনালি ও পাথরের নকল গয়নার বাজার ১৬০ কোটি ডলারের। ২০২৪-২০২৭’এর মধ্যে সোনালি গয়নার বাজারের ১১.৪% বৃদ্ধির কথাও বলেছে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক। ২০২৩-এ একটি প্রতিবেদন জানায় ভারতে ১১ লাখ কোটি টাকার ব্যবসা নকল ডিজ়াইনার পোশাকেরও। চলচ্চিত্রে নায়িকা বিয়ের ডিজ়াইনার লহেঙ্গা কিনতে বাড়ি থেকে পালায়। ছবিটির জনপ্রিয়তা প্রসঙ্গেসামাজিক মান্যতা ও স্বাভাবিক ইচ্ছের যে কথা মেলে, উভয়েই যথার্থ।
সোনার দামের এই তারতম্য বিয়ের বাজারকে প্রভাবিত করবে না? পুরাতন স্ত্রীধন সংক্রান্ত দুর্বলতা, ‘সোনার গয়না কিনতে পারি’র ক্ষমতা-প্রদর্শনের মানসিকতা তো আছেই। কমবয়সি মেয়েগুলি যে দৃষ্টিতে দেখে, পৃথিবী তার চেয়ে অনেক নিষ্ঠুর। গলার হারকে নেড়েচেড়ে গঠন, ‘এস’ আকার দেখে যাচাই করার মানুষ স্বচক্ষে দেখেছি।
আছে সোনার সম্পদমূল্যও, যার সঙ্গে সোনার দাম বাড়ার সম্পর্ক বেশ মধুর। বেশি দাম মিলবে, মেয়ের বিয়েতে টাকাটা লাগবে বলে শখের দুলটুকু বিক্রিতে ছুটছেন মা। গয়না বিনিময়ে ধার দেয় এমন সংস্থাও মওকার অপেক্ষায় থাকে। সোনার দাম বাড়ায়, সোনার গয়না বিক্রি করতে খদ্দের বেশি আসছে কি না— সরকার অনুমোদিত বিক্রয়কেন্দ্রে গিয়ে খোঁজ করি। দশ-বারো বছরের মেয়ে নিয়ে কমবয়সি হিজাব-পরিহিতা মহিলা আসেন। দোকানে লোক দেখে চলে যেতে চান, আশ্বস্ত করায় বসেন। মেয়েটির স্কুলপোশাক, কুণ্ঠিত মুখে হিজাবের আস্তরণ— আর্থিক সাচ্ছল্যের পরিচায়ক। বহুমূল্য গয়না বিক্রি করতে এসেছেন। মেয়েটি মা’কে সাহস দিচ্ছে, আধার ইত্যাদি বার করে সাহায্য করছে।
সোনার দাম বেড়েছে, খবরটা জানে ওরা? নাকি সামান্য সম্মান কিনতে, হয়তো পারিবারিক অত্যাচার থেকে বাঁচতে তাদের কাছে এটাই একমাত্র পথ? সোনার দামের ঊর্ধ্বগতি তাদের কোনও মতে বেঁচে থাকার স্বাধীনতাকে সাহায্য করবে? অর্থনীতি সমাজতন্ত্রের কাছে উত্তর আছে হয়তো। আমি শুধু ছোট্ট মেয়েটির মাকে সাহায্য করতে চাওয়া দেখি।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)