Advertisement
১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪

কনট প্লেস ফেসবুক গৌরবেরা

ঋধিমা, গৌরব, ইন্দ্রাশিস বেড়াচ্ছেন নয়া দিল্লিতে। কেন? দেখে এসে লিখছেন অরিজিত্‌ চক্রবর্তী।যদি শাহজাহানের একটা ফেসবুক ফোরাম থাকত? দেওয়ান-ই-আম তৈরির দরকারটাই হয়তো হত না। যদি মহম্মদ বিন তুঘলকের স্কাইপ থাকত? রাজধানী পাল্টানো নিয়ে হাঙ্গামাটাই হয়তো বাদ চলে যেত ইতিহাস বই থেকে। যদি আকবরের স্ন্যাপচ্যাট থাকত? যোধাবাঈয়ের সঙ্গে প্রেমপর্বটা হয়তো শুরু হত স্ন্যাপচ্যাটে ছবি বিনিময়ের মধ্যে দিয়ে।

‘ইন্ডিয়া গেট’-এর সামনে গৌরব, ঋধিমা, ইন্দ্রাশিস।

‘ইন্ডিয়া গেট’-এর সামনে গৌরব, ঋধিমা, ইন্দ্রাশিস।

শেষ আপডেট: ০৬ অগস্ট ২০১৪ ০০:২৩
Share: Save:

যদি শাহজাহানের একটা ফেসবুক ফোরাম থাকত? দেওয়ান-ই-আম তৈরির দরকারটাই হয়তো হত না।

যদি মহম্মদ বিন তুঘলকের স্কাইপ থাকত? রাজধানী পাল্টানো নিয়ে হাঙ্গামাটাই হয়তো বাদ চলে যেত ইতিহাস বই থেকে।

যদি আকবরের স্ন্যাপচ্যাট থাকত? যোধাবাঈয়ের সঙ্গে প্রেমপর্বটা হয়তো শুরু হত স্ন্যাপচ্যাটে ছবি বিনিময়ের মধ্যে দিয়ে।

দিল্লিতে শ্যুটিং কভার করতে এসে ইতিহাস মনে পড়াটা স্বাভাবিক। শহরটাই তো ইতিহাস।

আর যে ছবির নাম ‘ফেক বুক’। সেখানে ফেসবুক-স্কাইপ-স্ন্যাপচ্যাট আসবে না? ‘ফেকবুক’য়ের প্রধান তিন অভিনেতা-অভিনেত্রীও তো আবার জেনারেশন-অ্যাপসের সদস্য। ঋধিমার আইপ্যাডের কভারে লেখা, ‘ইউ ওন্ট লাইক মাই অ্যাপস্‌, সো ব্যাক অফ’। হোটেলে দেখা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গৌরবের প্রশ্ন, “আইওস সেভেন-এ প্রচণ্ড ব্যাটারি খাচ্ছে, না?” আর ইন্দ্রাশিস লাগেজ থেকে প্রথমেই বের করল জেবিএল-এর একটা ব্লু টুথ স্পিকার।

স্বাধীনতা দিবসের দশ দিন আগে দিল্লিতে শ্যুটিংয়ের পারমিশন পাওয়াটা বেশ ঝামেলার। সেটা মাথায় ছিল। কিন্তু শুটিং স্পটে পৌঁছে দেখা গেল সেটা কোনও সমস্যাই না। আসল সমস্যা জনগণকে নিয়ে। ইস্ট পটেল নগরের যে রাস্তার পাশে এ দিনের শ্যুট চলছে, সেটা চওড়ায় বড় জোর আট ফুট। কিন্তু টু ওয়ে। অবশ্য তাতেও কোনও সমস্যা ছিল না। যদি না যত গাড়ি সেখান দিয়ে যাচ্ছে, সে বিএমডব্লিউ হোক কী মোপেড, স্পিডোমিটারের কাঁটা ১০য়ে নামিয়ে দেখে নিচ্ছে রক্তাক্ত গৌরব কেন বাড়ির সামনে বসে কাঁদছে! গড়ে তিনটে গাড়ির একজন গাড়ি থামিয়ে প্রশ্নও করছে। আসলে দিল্লিতে তো তেমন সিনেমার শ্যুট হয় না। বলিউড-টলিউডের মতো তাদের কোনও দিল্লিউড নেই। তাই হয়তো মাঝবয়সি এক ভদ্রলোক জাগুয়ারের কাচ নামিয়ে পাঁচ-ছ’টা প্রশ্ন করছিলেন প্রোডাকশনের লোকদের। এক অ্যাসিসট্যান্ট ডিরেক্টর তো মজা করে বলেই ফেললেন, “এখানে একটা ‘মে আই হেল্প ইউ’ কিয়স্ক বসালে তো হয়।”

দিল্লি মেট্রোর কাছে কলকাতা মেট্রোর অবস্থা যে বিশ্বকাপ ফাইনালে মেসির মতো, সেটাও বুঝিয়ে দিলেন কলকাতা থেকে আসছি শুনে।

তিন দিন ধরে দিল্লির বিখ্যাত জায়গাগুলোয় ঋধিমা-গৌরবের বেশ কয়েকটা শট নেওয়ার কথা। প্রথম দিন লোকেশন কনট প্লেসের আশেপাশে। কনট প্লেসের পোশাকি নাম অবশ্য রাজীব চৌক। তবে স্থানীয়দের কাছেও ওটা সিপি। সকালেই হোটেলে ঋধিমা ফ্লিপকার্টে জুতোর অর্ডার নিয়ে দুঃখ করছিলেন। কনট প্লেসের দোকানগুলো দেখে সে দুঃখ আরও বেড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। তবে এ দিন শপিংয়ের সময় নেই ঋধিমাদের। পরের স্টপ ইন্ডিয়া গেট। আলোও কমে আসছে।

সন্ধেবেলা ইন্ডিয়া গেটে যেন গোটা দিল্লি এসে জড়ো হয়। উইকডে-তেও লোকে এত সময় পায় কোথা থেকে কে জানে? দিল্লি ‘দিলওয়ালো কা’ শহর। ইন্ডিয়া গেটের সামনে হট প্যান্ট পরা ঋধিমা, এক ঘণ্টার মেকআপে প্রায় কালো হয়ে যাওয়া গৌরব আর জেল দিয়ে ব্যাকব্রাশ করা ইন্দ্রাশিসের পানিপুরি খাওয়া দেখতে শ’খানেক লোক জড়ো হতে একশো সেকেন্ড লাগল না। কিন্তু জীবনের প্রথম পানিপুরি মুখে দিয়ে গৌরব-ঋধিমা-ইন্দ্রাশিস কেউই তেমন ইমপ্রেসড হলেন না। ঋধিমা তো বলেই ফেললেন, “ধুর্‌, এর থেকে কলকাতার ফুচকা অনেক ভাল। মশলা নেই। খালি আলু আর মটর।”

কনট প্লেসে সন্ধের পর আর একটা শট নিয়ে সে দিনের মতো প্যাক আপ। অন্ধকার নেমে এসেছে। দিল্লি এসে টিনটিনেরও মনের ভাব ছিল, কত কী ‘দেখার’ আছে বাকি। তাই শেষ হয়েও শেষ না হওয়ার মতো বাকি শ্যুট তুলে রাখা হল পরের দিনের জন্য। হোটেলে ফিরে ইন্দ্রাশিসের ঘরে আড্ডা দিচ্ছিলেন গৌরবরা। ‘রংমিলান্তি’র পর আবার তিনজন একসঙ্গে কোনও শ্যুটে। আড্ডা তো হবেই। মিনারেল ওয়াটার পাঠাতে রিসেপশনে ঋধিমা ফোন করে ‘চার বোতল...’ বলার পরেই সমবেত হাসি। হানি সিংহের রেফারেন্স। ব্লু টুথ স্পিকারে তখন ‘কিক’য়ের ‘জুম্মে কি রাত হ্যয়’। স্বাভাবিক ভাবে লোকে এঁদের সিরিয়াস অভিনেতা বলেই জানে। তাঁদের আড্ডায় সলমন? “কী বলছেন কী? একা নিজের কাঁধে ছবিকে বের করে নিয়ে যাওয়ার ক্রেডিটটা দেব না?” সঙ্গে সঙ্গে উত্তর গৌরবের। পাশ থেকে ইন্দ্রাশিস যোগ করলেন, “এটাই তো হিরোইজম। কেমন ভাবে ডিকটেট করে ইন্ডাস্ট্রিকে। ফোটোগ্রাফারের সঙ্গে ঝামেলা হয়েছে। তাতে কী? সলমনের থোড়াই কেয়ার।”

সলমন হয়তো নিজের প্রাইভেসি বজায় রাখতে পারেন। কিন্তু বাকি অভিনেতারা? বিশেষ করে ফেসবুক-ট্যুইটার-ইন্সটাগ্রামের যুগে? “সেটা একটা সমস্যা তো বটেই। এই তো কিছু দিন আগে ফেসবুকে একজন পোস্ট করছিল আমি কোথায় যাই না-যাই সে সব জায়গা দিয়ে। বেশ ভয় পাওয়ার মতো ব্যাপার,” বলছিলেন ঋধিমা।

একমত গৌরবও। বললেন, “আমাকে একবার একজন ফেসবুকে মেসেজ পাঠিয়ে ছিল একটা নম্বর দিয়ে যে, সে রাজ চক্রবর্তী আর আমি যেন ওই নম্বরে ফোন করি। আমার কাছে রাজদার নম্বর ছিল। তাই আমি আর মেসেজ করা নম্বরে ফোন করিনি। কিন্তু কেউ তো করতেও পারত। তার নম্বর তো আর তখন প্রাইভেট থাকত না।” যে কোনও সোশ্যাল মিডিয়াতেই কোনটা আসল আর কোনটা যে ফেক তা বোঝা সহজ নয়। ‘ফেক বুক’ও সেই জায়গাটাই ধরতে চেয়েছে। “তবে কোনও মেসেজ দেওয়া নয়। একটা গল্প বলতে চেয়েছি। দর্শকরা ঠিক তার থেকে ব্যাপারটা অ্যাবসর্ব করে নেবেন,” শ্যুটিংয়ের ফাঁকে বলছিলেন পরিচালক সঞ্জয় বর্ধন।

ইন্দ্রাশিসের স্পিকারে এ বার বাংলা গান। অর্ণবের গাওয়া। গানের মতো তাঁদের জীবনও তো পাল্টে গিয়েছে। তিন জনেই প্রায় একসঙ্গে উত্তর দিলেন ‘রংমিলান্তি’র পর। ওটাই টার্নিং পয়েন্ট। টেলিভিশন থেকে রুপোলি পর্দায় নিয়মিত হওয়া। তাঁদের জীবনের ‘কিক’টা কী ছিল? উত্তরটা গৌরব দিলেন, “কৌশিকদা (গঙ্গোপাধ্যায়)-র একটা কথা। বলেছিল, ‘ভাল কিছু করতে হলে মাসমাইনের লোভটা ছাড়’।” বাকি দু’জনও মাথা নাড়লেন। বোঝা গেল তাঁদেরও মনে আছে কথাটা। ‘মাসমাইনে’র টেলিভিশন নয়, তিন জনের এখন পাখির চোখ শুধুই ‘সিনেমায় অভিনয়’। সে কাজে এগিয়েওছেন ওঁরা তিন জন। প্রত্যেকের অভিনীত ছবির সংখ্যা দু’অঙ্কে পৌঁছে গিয়েছে। গৌরবের কথাটা তখনও শেষ হয়নি। ঋধিমার দিকে একপলক তাকিয়ে যোগ করলেন, “এখন তো বাবা-মায়ের সাহায্যেই চলছে। তাই স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারি। দায়িত্ব বাড়লে কী হবে কে জানে?”

ভবিষ্যত্‌ কে-ই বা জানে। ইন্দ্রাশিসের তো ফুটবলার হওয়ার ইচ্ছে ছিল। গৌরবের ইঞ্জিনিয়ার। ঋধিমার অভিনয়ে আসার কোনও ইচ্ছেই ছিল না। তবু তাঁরা এসেছেন। আছেন। থাকবেনও। বর্তমান প্রজন্মের প্রতিশ্রুতিমানদের তালিকার প্রথম দিকেই। দিল্লির মেহেরৌলিতে নিজের সমাধির জন্য একটা জায়গা ঠিক করে রেখেছিলেন বাহাদুর শাহ জাফর। কিন্তু মারা গেলেন বর্মায় নির্বাসনের সময়। ‘পাঁচ বছর পর নিজেদের কোন জায়গায় দেখতে চান’য়ের মতো ক্লিশে প্রশ্নটা তাই আর করলাম না। আড্ডা দিতে দিতে বুঝে গিয়েছিলাম, ওঁরা উত্তরটা দিতেনও না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

ridhima indrashis gaurab arijit chakraborty
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE