ভাঙন ধরা পরিবারে মাকে নিয়ে ছেলেমেয়েদের টানাপড়েনের চিত্রনাট্য সেলুলয়েডে আকছার বক্স-অফিস মাত করেছে। ভাগ হওয়া বাঙালি দর্শককে নিয়েও প্রযোজক-পরিচালকদের হতাশার অন্ত নেই। এ-পার বাংলার ছবি সচরাচর রাজ্যের বাইরে দেখার সুযোগ মেলে না। ও-পারের ছবিরও এ-পারে ঢোকা কার্যত নিষেধ। আসন্ন ভাষা-দিবসের প্রাক্কালে কিন্তু চিত্রটা পাল্টাতে পারে।
ফেব্রুয়ারিতে নন্দিতা রায়-শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ছবি ‘বেলাশেষে’ ঢাকা-চট্টগ্রাম-রাজশাহি-খুলনা-বরিশালে বাণিজ্যিক ভাবে মুক্তি পেতে চলেছে। একই সময়ে কলকাতা ও আশপাশের হল-এ আসবে ও-পার বাংলার জনপ্রিয় ছবি আরিফিন শুভ-জাকিয়া বারি মম জুটির ‘ছুঁয়ে দিলে মন’।
গত শতকের ষাটের দশকের মাঝপর্ব অবধি ও-পার বাংলায় কলকাতা বা মুম্বইয়ের ছবি দেখা যেত অবাধেই। ’৬৫-র ভারত-পাক যুদ্ধের পরে পরিস্থিতি পাল্টায়। টালিগঞ্জের তারকা থেকে পরিচালক-প্রযোজককুল, কথায়-কথায় তাই নিয়ে আক্ষেপ করে থাকেন। ও-পার বাংলার সিনেমারসিকদের আক্ষেপও কম নয়। ‘ব্যোমকেশ-‘ফেলুদা’ থেকে অপর্ণা সেন, কৌশিক-সৃজিত-শিবপ্রসাদদের ছবি যখন যেটা মেলে, কলকাতায় এলেই দেখার জন্য মুখিয়ে থাকেন চট্টগ্রামের ফারহানা-রকিবুলরা। বছর তিনেক আগে বণিকসভা ফিকি-র অনু্ষ্ঠানে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পাশে বসে বাংলাদেশের তথ্যসম্প্রচার মন্ত্রী হাসানুল হক ইনু পর্যন্ত উদ্বেল হয়েছিলেন। কৈশোরে ঢাকার বলাকা প্রেক্ষাগৃহে ‘অপুর সংসার’ দেখার কথা মনে পড়ে গিয়েছিল তাঁর।
ইলিশ-জামদানি-চা নিয়ে দুই বাংলার কূটনীতি বা কুটুম্বিতা নরমে-গরমে ওঠানামা করে। সিনেমার ক্ষেত্রে কিন্তু খড়ির দাগের বিভাজনটাই শেষ কথা। দু’একটি যৌথ প্রযোজনার ছবি বাদ দিলে কলকাতার ছবি এ-দেশে, আর ঢাকার ছবি ও-দেশের গণ্ডিতে আটকে থাকাই দস্তুর। তবু এ যাত্রা ভারত-বাংলাদেশের আমদানি-রফতানি সংক্রান্ত আইন কাজে লাগিয়ে বিনিময়ের ভিত্তিতে দুই বাংলার দু’টি ছবিকে দু’দেশে দেখানোর বন্দোবস্ত হয়েছে। এর জন্য দু’দেশ থেকেই আলাদা করে ছবি দু’টির সেন্সর ছাড়পত্র জোগাড় করা হয়েছে। বাংলাদেশের তথ্য-সম্প্রচার মন্ত্রী ইনু সাহেব এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাচ্ছেন। তাঁর কথায়, ‘‘দু’দেশে ছবি রিলিজের ক্ষেত্রে আইনি জট এখনও আছে। কিন্তু আইনের ভিতরে কিছু জানলাও খোলা। দু’দেশেই সেগুলো কাজে লাগানো উচিত।’’
বছর দুয়েক আগে বাংলা ছবির জন্য দরবার করতে পরিচালক গৌতম ঘোষ, প্রযোজক মহেন্দ্র সোনি, বিজয় খেমকা প্রমুখের সঙ্গে ঢাকায় গিয়েছিলেন টালিগঞ্জের অভিভাবকপ্রতিম তারকা প্রসেনজিৎ। তিনি বলছেন, ‘‘আমার কাছে এটা স্বপ্ন সফল হওয়া! এতে আমাদের দু’দেশের ছবিই অনেক দূর এগিয়ে যাবে।’’ গৌতম ঘোষও দুই বাংলার যৌথ উদ্যোগে ছবি নির্মাণের সঙ্গে ধারাবাহিক ভাবে জড়িত। ‘পদ্মানদীর মাঝি’ ‘মনের মানুষ’-এর পরিচালকের পরের ছবি ‘শঙ্খচিল’ও দু’দেশের কো-প্রোডাকশন। গৌতমের কথায়, ‘‘দু’দেশের যৌথ ছবি-র ক্ষেত্রে একসঙ্গে দুই বাংলায় রিলিজ এখন মসৃণ হয়েছে। কিন্তু যে কোনও ভাল বাংলা ছবি দুই বাংলায় দেখানো না-গেলে বাণিজ্য থমকে যাবে।’’
ইন্ডাস্ট্রি সূত্রের খবর, এ-পারে ছবির বাজেট দেড়-দু’কোটির বেশি হলে প্রযোজকের পক্ষে টাকা তোলাটা কার্যত অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। প্রযোজক কৌস্তুভ রায় থেকে পরিচালক অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরী সকলেই একমত, বাজারের পরিধি না-বাড়লে এর বেশি কিছু করা যাবে না। রাজ্যে মেরেকেটে ২০-২৫টি মাল্টিপ্লেক্স। হল-এর সংখ্যা কমতে কমতে ৩৫০-য় এসে ঠেকেছে। মহারাষ্ট্র বা অন্ধ্রপ্রদেশে মাল্টিপ্লেক্সের সংখ্যা ১০০-র কাছাকাছি। হল-এর সংখ্যা এখানকার দশ গুণ। মরাঠি ছবির মতো বিপুল করছাড় বা হল-এ প্রাইম টাইমের সুবিধাও এ রাজ্যে সুলভ নয়। ফলে তেলুগু বা মরাঠি ছবি যেখানে অনায়াসে ২৫ কোটির শৃঙ্গ ছোঁয়ার কথা ভাবতে পারে, বাংলা ছবির ব্যবসা তিন-চার কোটি ছুঁলেই লটারি জেতার সামিল।
ও-পার বাংলার অবস্থাও খুব আলাদা নয়। বাংলাদেশেও ভাল প্রেক্ষাগৃহ হাতে গোনা। বাংলাদেশি মুদ্রায় ছবির বাজেট ৮০ লক্ষ ছাড়ালে সেখানেও প্রযোজকের কপালে ভাঁজ পড়ে। ‘ছুঁয়ে দিলে মন’-এর সহ-প্রযোজক তাহসিন সঈদ কবুল করছেন, ‘‘সুপারস্টার শাকিব খানের ছবি ছাড়া বাংলাদেশের সিনেমা দু’-আড়াই কোটির বেশি ব্যবসা করছে, এটা প্রায় অভাবনীয়।’’
অথচ সংখ্যার নিরিখে বাংলাভাষীরা বিশ্বে ছ’নম্বর। এ-পার বাংলায় ১০ কোটি, বাংলাদেশে ১৬ কোটি বাঙালি রয়েছেন। অসম, ত্রিপুরা, ঝাড়খণ্ড-সহ ভারতের অন্যান্য রাজ্য থেকে শুরু করে বিলেত-আমেরিকার মতো দেশ ধরলে আরও পাঁচ-ছ’কোটি বাঙালি আছেন। বলিউডি ছবির আন্তর্জাতিক পরিবেশক ইরস ফিল্মসের কর্তা নন্দু আহুজা বলছেন, ‘‘ভাল ছবির ক্ষেত্রে ভাষাটাও বাধা নয়। ‘বেলাশেষে’ বা ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’-এর মতো কিছু বাংলা ছবি প্রমাণ করেছে, ঠিকঠাক প্রচার পেলে অবাঙালিরাও তা দেখতে যাবেন।’’ আপাতত দু’দেশের দু’টি হিট ছবি দুই বাংলায় পৌঁছে দেওয়াটা কম কথা নয়। অভিজ্ঞরা অবশ্য মনে করাচ্ছেন, ঢাকায় বলিউডের কয়েকটি ছবি মুক্তির বিনিময়ে বাংলাদেশের একটি ছবি কলকাতার অকিঞ্চিৎকর একটি হলে রিলিজ করা হয়েছিল। লাভ হয়নি। এ বার কী হবে? জিরোনা এন্টারমেন্ট সংস্থার কর্ণধার শুভজিৎ রায় আটঘাট বেঁধে এগোচ্ছেন। টালিগঞ্জে এ বছরের সবথেকে বড় হিট ‘বেলাশেষে’ বাংলাদেশের গোটা দশেক শহুরে হল-এ দেখানোর ছক কষা হয়েছে। আর বাংলাদেশের ‘ছুঁয়ে দিলে মন’-এর জন্যও এ বাংলার অভিজ্ঞ পরিবেশক পিয়ালি ফিল্মসের সঙ্গে গাঁটছড়া
বাঁধা হয়েছে। বেছে নেওয়া হয়েছে কলকাতা ও আশপাশের ১০-১৫টি হল। একই তারিখে ঢাকা-কলকাতায় দু’টি ছবির মুক্তির চেষ্টা চলছে। পরিচালক গৌতম ঘোষ বলছেন, ‘‘বাংলাদেশের ছবিকে এই বাংলায় চেনাতে নিজের স্বার্থেই টালিগঞ্জকে বাড়তি দায়িত্ব নিতে হবে।’’
এখানেই শেষ নয়। শুভজিৎদের উদ্যোগে এর পরে দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের ‘নাটকের মতো’ ছবিটিরও বাংলাদেশে ‘রিলিজ’ প্রায় পাকা। বিনিময়ে শাকিব খানের কোনও ছবি দেখার সুযোগ পাবেন, এ বাংলার মানুষ। টালিগঞ্জের তরুণ প্রযোজক ফিরদৌসুল হাসানের মতে, ‘‘দুই বাংলারই যাতে ভাল হয়, সেটা দেখতে হবে। আর টলিউডের কম বাজেটে ভাল ছবির বাজারটা আর একটু বাড়াতে পারলে খুব ভাল হবে।’’
বেরাদরির সবটাই অবশ্য নিখাদ সম্প্রীতির নয়। এ বাংলার ছবি ঢুকে ও-বাংলার ছবির ক্ষতি করবে, এমন আশঙ্কাও ঢাকা ইন্ডাস্ট্রির রয়েছে। তবে মন্ত্রী ইনুসাহেব মনে করেন, ‘‘টালিগঞ্জের দরজা খুললে তা আখেরে বাংলাদেশের ছবির মান বাড়াতে সাহায্য করবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy