কোয়েস্ট মল, কলকাতা। ১৫ জুন। ২০১৫। সাবটাইটেল ছাড়াই ‘বেলাশেষে’ দেখে বেরিয়ে আসছেন এক গুজরাতি দম্পতি। তাঁদের চোখে জল। বসুন্ধরা মল। ঢাকা। ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬। হল থেকে বেরিয়ে এলেন জাহানারা বীথি। মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে ‘বেলাশেষে’ দেখতে এসেছিলেন। মা মেয়ে দু’জনের চোখে জল।
বাংলা সিনেমার ঐতিহাসিক দিন
বাংলাদেশ থেকে সদ্য কেনা খাদির জ্যাকেট পরে ‘বেলাশেষে’র পরিচালক শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় তখন বুঝেই উঠতে পারছেন না কী ভাবে সামলাবেন এত মানুষের আবেগ। তাঁকে ঘিরে তখন ঢাকার অগুন্তি মানুষ। যেন ২১ ফেব্রুয়ারির উচ্ছ্বাস নেমে এল বসুন্ধরা মল-এ।
এই প্রথম একই সঙ্গে বাংলাদেশে ভারতের ছবি ‘বেলাশেষে’, আর ভারতে বাংলাদেশের ছবি ‘ছুঁয়ে দিলে মন’ ২৬ ফেব্রুয়ারি রিলিজ করবে। ‘‘২৬ ফেব্রুয়ারি বাংলা সিনেমার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। আগে বাংলাদেশে ভারতের ছবি দেখানো হলেও এই প্রথম বাংলাদেশের ছবি ভারতে সাধারণ মানুষের জন্য সিনেমা হলে দেখানো হবে,’’ বললেন ভারত–বাংলাদেশের ছবি এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামের কর্তা শুভজিৎ রায়।
‘পদ্মা নদীর মাঝি’ আর ‘মনের মানুষ’য়ের মতো ছবিও তো ভারত বাংলাদেশ যৌথ প্রযোজনায় তৈরি হয়েছিল। সে সব ছবি বাদ দিয়ে হঠাৎ ‘বেলাশেষে’কেই এই ‘এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম’-এ নির্বাচন করা হল কেন?
‘‘গত বছর বাংলাদেশে ‘বেলাশেষে’র পাইরেটেড সিডি বিক্রির সংখ্যা অন্য সব সিডিকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। চেয়েছিলাম বাংলাদেশের মানুষ পাইরেটেড সিডি না দেখে বড় পর্দায় ছবিটা দেখুন। সেই কারণেই এই আয়োজন,’’ বললেন শিবপ্রসাদ।
বিশ্বনাথ আর আরতি
বসুন্ধরা হল প্রায় ভর্তি। অনেকেই খোঁজ করছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আর স্বাতীলেখা সেনগুপ্তর। ছবিটা আবার দেখতে দেখতে মনে হল ‘বেলাশেষে’র আরতি (স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত) কি শেষ অবধি গিয়েছিল ফরিদপুরে তার নিজের জন্মস্থানে? বা ময়মনসিংহে শ্বশুরের ভিটেতে? আরতি কী বলছেন? ‘‘বেলাশেষে’র মতো ছবি ওপার বাংলার মানুষ বড় পর্দায় দেখতে পেলেন, এটা খুবই আনন্দের। একটা সময় বাংলাদেশে প্রচুর ঘুরেছি। ইদানীং আর যাওয়া হয় না। ওখান থেকেও ডাক আসে না,’’ ‘বেলাশেষে’র প্রিমিয়ারে আসতে পারেননি স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত। যেমন আসেননি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু ফোনের ওপার থেকে শোনা গেল তাঁর উচ্ছ্বাস। ‘‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রায় ৪৫ বছর হয়ে গেল। এত বছর লেগে গেল একটা বাংলা ছবির সিনেমা হলে ঠিক মতো পৌঁছতে! আমি জানি না পরবর্তী অন্য কোনও বাংলা ছবি এ ভাবে ঢাকায় দেখানো হবে কিনা। ‘বেলাশেষে’ তো সুপারহিট ছবি। এর নানা ঘটনা মানুষের মন ছুঁয়ে যায়,’’ বললেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
ফেব্রুয়ারির বাংলাদেশ
শুরু হল ছবির স্ক্রিনিং। শিবপ্রসাদ জানালেন সব প্রোটোকল মেনেই ‘বেলাশেষে’ ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার ৯টা হলে রিলিজ করছে। লঞ্চ করা হল শিবপ্রসাদ-নন্দিতার পরের ছবি ‘প্রাক্তন’-এর ফার্স্ট লুক।
ঢাকা শহরের কুখ্যাত যানজট পেরিয়ে পিচরঙা পাকিস্তানি সালোয়ার স্যুট আর হাই হিল-এর লাস্যে ‘বেলাশেষে’র প্রিমিয়ারে এলেন বাংলাদেশের অভিনেত্রী জয়া এহসান। শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় আর নন্দিতা রায়ের পরের ছবি ‘কণ্ঠ’র নায়িকা তিনি। প্রিয় অভিনেতা রাব্বি-র সঙ্গে সেলফি তুলতে তুলতে বললেন ‘‘আজ ঋতুদিকে মিস করছি।’’
মাঝ-ফেব্রুয়ারির এই সময়টায় ঘুমোয় না বাংলাদেশ।
২০ ফেব্রুয়ারির মধ্যরাত থেকে শুরু হয় লক্ষ লক্ষ মানুষের পথ চলা। রাত পেরিয়ে ভোর। ফাল্গুনের মিঠে কড়া রোদ উপেক্ষা করে ভাষার জন্য, মাটির জন্য শহিদ মিনারের দিকে এগোয় ছাত্রছাত্রীর দল। প্রতিবন্ধী, বাচ্চা, বুড়ো। কেউ খালি পায়ে, কারও হাতে আগুনরঙা ফুল। যেন একুশের রক্তদাগের স্মৃতি। সাদাকালোর অক্ষরমালায় সেদিন সেজে ওঠে বাংলাদেশের শরীর।
প্রিমিয়ারে হাজির বাংলাদেশের গীতিকার পরিচালক এনামুল করিম নির্ঝর। সদ্য অস্কারে নির্বাচিত হয়েছে তাঁর ছবি। নিজের লেখা গান নিয়ে কলকাতায় শো করতে আসছেন তিনি। বললেন, ‘‘‘একুশে’র স্মরণে দেশের মানুষ যখন বাংলা ভাষা নিয়ে মেতেছে, সেই সময় কাঁটাতার পেরিয়ে বাংলা ছবির পারাপার
ওয়ার্ল্ড সিনেমায় বাংলা ছবির গুরুত্ব বাড়িয়ে দিল।’’
‘বেলাশেষে’ দেখার পর স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক বদলে গিয়েছে
‘‘ঢাকায় ওপার বাংলা ছবির প্রিমিয়ার হচ্ছে ভাবতেই পারছি না। এখানে তো শুধু হলিউডের ছবি চলে। আগামী প্রজন্মের জন্য খবরটা সত্যিই ভাল,’’ বলছিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী লিলি ইসলাম। ঢাকা শহরে কেউ এলে তাঁর বাড়িতে এলাহি ‘দাওয়াত’ না খেয়ে নাকি দেশের বাইরে যেতে পারে না। বিরতিতে দেখা ‘গেরিলা’র পরিচালক বাচ্চুভাইয়ের সঙ্গে। ‘বেলাশেষে’র সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয় দেখে তিনি মুগ্ধ।
নাট্যকর্মী সারা জাকের অভিযোগ করে বসলেন, ‘‘আচ্ছা আমরা ওপার বাংলার বেশির ভাগ অভিনেতা অভিনেত্রীদের চিনি, অথচ তাঁরা আমাদের দেশের কাউকেই তেমন জানেন না। দরজাটা এবার কিন্তু খুলে দেওয়াই ভাল।’’ ‘বেলাশেষে’ দেখতে দেখতে সারা-র মনে পড়ে যাচ্ছিল ঋতুপর্ণ ঘোষের কথা। বললেন, ‘‘ওঁর কোনও ছবি মিস করি না।’’
রাত ১০টা। ছবি শেষ। হলভর্তি বাঙালি উচ্ছ্বাসে উঠে দাঁড়ালেন। কারও চোখে জল, কেউ বা খরাজ মুখোপাধ্যায় আর অপরাজিতা আঢ্যর খুনসুটি নিয়ে মেতেছেন। বিখ্যাত অভিনেত্রী আসনা হবিব ভাবনা বললেন, ‘‘‘বেলাশেষে’ দেখার পর আমার সঙ্গে আমার স্বামীর সম্পর্ক বদলে গেছে। ওই পঞ্চাশ বছরের বিবাহবার্ষিকীর কথা ভেবে আমিও সহ্য করতে শিখেছি। ঝগড়া আর করি না। ভালবাসতে জেনেছি।’’
শিবপ্রসাদ গেলেন কোথায়!
বাংলাদেশের ন্যাশনাল টেলিভিশন ড্রামার ডিরেক্টর, মুক্তিযোদ্ধা, লেখক আলি জাকের ও তাঁর স্ত্রী সারা জাকেরের বাড়িতে আফটার পার্টির প্রথম দাওয়াত। বাড়িটা নিজেই একটা ইতিহাস। দেওয়ালে মুক্তিযুদ্ধের ছবি, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ছবি। টেবিলে পড়ে আছে সে সময়ের পিস্তল। একে একে আসতে শুরু করেছে ইলিশ মাছ, খিচুড়ি, মুর্গির ঝোল, বিফ ভুনা। কিন্তু ‘বেলাশেষে’র পরিচালক শিবপ্রসাদ উধাও। আলি জাকের শেয়ার করেছেন ১৫০০ দর্শকের সামনে তাঁর
নাটক করার অভিজ্ঞতা। সারা যেমন উষা গঙ্গোপাধ্যায়ের কাজ নিয়ে উচ্ছ্বসিত। জানতে চাইছেন ‘নান্দীকার’ আর ‘বহুরূপী’র কথা। আফশোস করে বলছেন, ‘‘কলকাতার মানুষজন দেখে আবার আমার নাটক করতে ইচ্ছে করছে। বাংলাদেশের ফেডারেশনের চক্করে পড়ে নাটক করারই বারোটা বাজল। গ্রুপ থিয়েটার আর চলবে না। নিজেদের কিছু করতে হবে।’’
কিন্তু শিবপ্রসাদ গেলেন কোথায়!
ঢাকায় একের পর এক দাওয়াত খেয়ে তাঁর শরীর খারাপ। খানিক পরে এসে বললেন,‘‘জয়ার হাতের বিরিয়ানিটা এবার আর খাওয়া হল না। অনেক করে বলেছিল ও।’’
বগুড়ার দই-স্টাফড্ ইলিশ
দাওয়াতের আবদার যেন ফুরোতেই চায় না। রাত ১২টা। ‘বেলাশেষে’র টিম পৌঁছল লিলি ইসলামের বাড়িতে। ঢাকাই শাড়ির পর্দা আর ঝরনা ঘেরা বিরাট ডাইনিং হল-এ আসতে শুরু করল বোনলেস স্টাফড ইলিশ, ট্যাংরা মাছ, গলদা চিংড়ি, কচি পাঁঠার ঝোল, রুই কালিয়া, মুর্গি। মাটির সানকিতে (সরা) বগুড়ার জমাট ক্ষীরের লাল দই খেতে খেতে নন্দিতা বললেন, ‘‘ ঢাকায় ১ বৈশাখ কভার করতে এসেছিলাম আমরা। ২০০৫ সম্ভবত।’’
ঢাকায় পা দেওয়া থেকেই চ্যানেলের টক-শো থেকে রেডিয়োর ইন্টারভিউ, প্রযোজকদের সঙ্গে ব্রাঞ্চ— সবই একা হাতে সামলে চলেছেন শিবপ্রসাদ। নন্দিতা রায় কোথাও যাননি। তিনি ব্যস্ত শিবপ্রসাদের বিয়ের শপিংয়ে। শিবপ্রসাদের হবু বৌয়ের জন্য ঠাস বুনটের লাল-রঙা জামদানি কিনতে কিনতে বললেন, ‘‘শিবুকে প্রথমেই বলে দিয়েছিলাম আমি গল্পটা বলব আর ছবি বানাব। বাদবাকি চিত্রনাট্য থেকে মার্কেটিং— সব তোমার দায়িত্ব। আমাকে কেউ ইন্টারভিউ দিতে বললে, স্টেজে দাঁড়াতে বললে, ভয়ে হাত-পা কাঁপে আমার!’’
স্বাতীলেখার শেষ সংলাপ মৃণালদার বৌয়ের থেকে
দর্শক যখন ‘বেলাশেষে’ দেখছিলেন, তখন শিবপ্রসাদ আর নন্দিতা উল্টোমুখ করে বসে দেখছিলেন দর্শকদেরই। ‘‘আসলে ডায়লগ লেখার সময় যে যে রিঅ্যাকশনের কথা ভেবেছি, সেগুলোই কলকাতার মতো এখানে হচ্ছে কি না সেটাই মেলাচ্ছিলাম,’’ ‘প্রাক্তন’এর প্রোমোশন করতে করতে বললেন শিবপ্রসাদ। জীবন থেকেই সংলাপ কুড়িয়ে নেন নন্দিতা। বললেন, ‘‘স্বাতীলেখার ওই শেষ সংলাপ, যেখানে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে উনি বলছেন তুমি আমার আগে চলে যেও… এই ব্যাপারটা আমি মৃণালদার (সেন) বৌয়ের কাছ থেকে পেয়েছি কিন্তু। মাসিমা এতটাই ভালবাসেন মৃণালদাকে, ভাবা যায় না!’’
ততক্ষণে এসে গেছে রবীন্দ্রনাথের কাছারি বাড়ি শাহ্জাপুরের ঘিয়ে ভাজা তুলোর মতো নরম ল্যাংচা। তাতে কামড় বসিয়ে প্রযোজক অতনু রায়চৌধুরী বললেন, ‘‘শিবুর সঙ্গে কিম্তু রোজ সকালেই ঝগড়া হয়। হলে কী হবে! ঝগড়া করতে করতেই পরপর পাঁচটা ছবি একসঙ্গে করে ফেললাম। এটা কিন্তু রেকর্ড।’’
হোয়াটসঅ্যাপে ঢাকার বিরিয়ানি
শিবপ্রসাদ হোয়াটসঅ্যাপে হবু বৌকে মেনু পাঠাচ্ছেন। আর ও প্রান্ত থেকে অর্ডার আসছে ঢাকার বিরিয়ানি নিয়ে যাওয়ার। নয়তো শিবপ্রসাদ নাকি আস্ত থাকবেন না। ‘‘তুমি তো দেখছি বৌকে সব ডিটেল পাঠাচ্ছ হোয়াটসঅ্যাপে। এত বোলো না ভায়া। বিয়ের আগেই যদি বৌকে ভয় পাও, তা হলে পরে কী করবে?’’ টিপ্পনী কাটলেন ‘বেলাশেষে’র অপর প্রযোজক প্রভাত রায়। শিবপ্রসাদ ততক্ষণে চলে গিয়েছেন ‘প্রাক্তন’-এর মোডে। কবিতা লিখে লিখে প্রোমোট করছেন বিচ্ছেদ আর ভালবাসার গল্পকে।
‘‘দেখুন, একদিনে ৩০০ শেয়ার, হাজারের ওপর লাইক। ইচ্ছে আছে ‘প্রাক্তন’ একই দিনে বাংলাদেশ, টরন্টোয় রিলিজ করার,’’ বললেন শিবপ্রসাদ।
ঢাকার ফ্লাইট কলকাতার পথে টেক অফ করল। ঘড়িতে তখন ৫.৩০।
শিবপ্রসাদ-নন্দিতা ভেসে গেলেন নস্ট্যালজিয়ায়। তাঁদের মনে পড়ছিল আট বছর আগের সেই দিনগুলোর কথা। ‘ইচ্ছে’র মতো ছবি তৈরি করেও দেখাতে পারছিলেন না তাঁরা। ঘুরতে হয়েছিল প্রযোজকদের দরজায় দরজায়। ইন্ডাস্ট্রির মানুষ বিদ্রুপ করে বলেছিল ওঁদের ছবি বানানোর ধরনটা নাকি কোনও দিনই দর্শকরা নেবেন না।
ঢাকার ফ্লাইট কলকাতার মাটি ছুঁল সেই ৫.৩০-য়েই।
শুধু দর্শক কেন, সময়টাকেও যে মুঠোবন্দি করে ফেলেছেন তাঁরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy