শিল্পী নিকেতনের গদিঘরে একলা মৃণালকান্তি গুহ। —নিজস্ব চিত্র।
ঘরটাকে একটু গুছিয়ে নিয়েছেন তিনি। সাফসুতরো করে দেওয়ালে লাগানো পোস্টারগুলোতে টুনি দিয়ে সাজিয়েছেন। রথ বলে কথা! টেবিলের এক পাশে কাগজপত্রের স্তূপ, অন্য দিকটায় একটু জায়গা করে নিয়ে খসখস করে কী যেন লিখে চলেছেন প্রৌঢ়। নাহ্, খদ্দেরের দেখা নেই। অস্ফূটে বললেন, ‘‘আগে কত লোক সমাগম হতো। আর এ বার... মাত্র দু’টো বায়না হয়েছে!’’
তিনি মৃণালকান্তি গুহ। চাকদহ স্টেশনের আপ প্ল্যাটফর্মের উপর তাঁর গদিঘর। চাকদহ স্টেশনের একমাত্র গদিঘর। আগেই এই স্টেশনেই কমবেশি ১৫টি গদিঘর বা যাত্রার বুকিং অফিস ছিল। এখন টিমটিম করে জ্বলছে সলতে।
বছর পনেরো আগেও এই চাকদহ স্টেশনে রথের দিন পা ফেলার জায়গা হতো না। দুই প্ল্যাটফর্ম জুড়ে থাকা গদিঘরগুলোতে থাকতো নায়কদের ভীড়। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চলত যাত্রার বুকিং। কিন্তু সে কালের সেই ‘মিনি-চিৎপুর’ এখন কই!
মৃণালবাবুর সংস্থার নাম ‘শিল্পী নিকেতন’। তাদের নিজস্ব যাত্রাদল রয়েছে। এ বার তাদের প্রযোজনা ভক্তিমূলক সামাজিক পালা ‘নটী বিনোদিনী’। বললেন, “রথের দিন তো মাত্র দু’জায়গায় বুকিং হয়েছে। এক সময় এই দিনে মফস্বলের এই গদিঘর থেকে কলকাতার গুরুত্বপূর্ণ সব যাত্রাদলের বুকিং হয়েছে।”
কিন্তু এ অবস্থা কেন? টিভি সিরিয়াল আর সিনেমা— স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন প্রৌঢ়। তাঁর কথায়, ‘‘মানুষ আর টিভি চ্যানেলের বাইরে যেতে চায় না। এর মধ্যে অভিনেতা-অভিনেত্রীরা আবার রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছে। তাতে আর যাই হোক, তাঁদের গুরুত্ব কমে যাচ্ছে।’’ রাস্তাঘাটে, ভোটের প্রচারে, ইতিউতি তাদের দেখা মিলছে। ফলে দূর থেকে তাঁদের এক ঝলক দেখার, একটু গলা শোনার যে উৎসাহ থাকতো লোকের, তা এখন কমে গিয়েছে।
এক দিকে কদর কমছে, উল্টো দিকে খরচ হু হু করে বাড়ছে। মৃণালবাবুর কথায়, “স্থানীয় দলের যাত্রা বায়না হয় বড়জোড় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকায়। খরচ বাদ দিয়ে সেই অর্থের আর কিছুই পড়ে থাকে না। অভিনেতা-অভিনেত্রীদের পারিশ্রমিক ছাড়াও শব্দ, আলো, বাজনা, পোশাক, মেক-আপ, বিভিন্ন জায়গায় যাত্রা করতে যাওয়ার জন্য গাড়ি ভাড়া আরও কত কী? তা ছাড়া প্রশাসনের অনুমতি নিতে গিয়েও মোটা টাকা খরচ হয়।”
প্রবীণ যাত্রা অভিনেতা ৬২ বছর বয়সি মদন দাসের বক্তব্য, এ পেশায় ভাল শিল্পীও আসছে না। বললেন, “কোথায় সেই অভিনেতা-অভিনেত্রী? কোথায় সেই কণ্ঠস্বর? যে একাই মঞ্চ কাঁপিয়ে দেবে। যে যাত্রার মাঝে মাঝে ঘটনার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ভূত, ভবিষ্যৎ, সুখ-দুঃখ নিয়ে গান করবে। দক্ষ শিল্পীর অভাবে পৌরানিক ও ঐতিহাসিক যাত্রার সংখ্যা ক্রমে কমে গিয়েছে। কারণ একটাই, এ সব পালায় অভিনয় করতে দম লাগে।”
পালাকার কুমার নিরঞ্জন বলেন, “যাত্রায় চিত্রভিনেতাদের প্রবেশ করানোটা সব চেয়ে বড় ভুল হয়েছে। প্রথম দিকে দু-চার জন আয় করলেও, পরে মুখ থুবড়ে পড়েছে। একই জিনিস মানুষ সবসময় পছন্দ করে না।’’ জানালেন, সামাজিক যাত্রার চাহিদা রয়েছে। একটু অন্য স্বাদ আনতে হয় তাতে। দলগুলোর অধিকাংশের পেটুয়া লোক রয়েছে। মালিকরা তাঁদের মতো করে গল্প লিখতে বলেন। শিক্ষার কিছু থাকা দরকার। সেটা পাওয়া যাচ্ছে না। ‘‘সেই ক্যাবারে, সেই ভিলেন দিয়ে সব সময় মানুষের আকর্ষণ বাড়ানো যায় না। মানুষের স্বাদেরও তো পরিবর্তন হয়েছে। সেই ভাবে গল্প লিখতে হবে,” বলছেন কুমার নিরঞ্জন।
এক সময় রথের আগের দিন রাত থেকেই নায়েকরা এসে হাজির হতেন। তাঁরা সকলেই চাইতেন, রথের দিন সবার আগে তাঁদের পছন্দের যাত্রাপালা বুকিং করতে। ওই দিন সকাল থেকে বুকিং অফিস বা যাত্রাঘরগুলো রজনীগন্ধা ফুলের মালা দিয়ে সাজানো হতো। সন্ধ্যায় বসত যন্ত্রসঙ্গীতের আসর। নায়ক ছাড়াও, অভিনেতা, বাদ্যশিল্পী, হেয়ার ড্রেসার, মেক-আপ ম্যান, নৃত্য শিল্পী, বিভিন্ন ক্লাবকর্তাদের ভিড় জমতো। সব মিলিরে রথের সারা দিনটা গমগম করতো গদিঘর।
শিয়ালদহ-রানাঘাট শাখার চাকদহ রেল স্টেশনে এ ধরনের কমবেশি ১৫টি গদিঘর বা বুকিং অফিস ছিল। ওই সব সংস্থার অধিকাংশেরই নিজস্ব যাত্রাদল ছিল। এই সব গদিঘর থেকে স্থানীয়, কলকাতা এবং জেলার বিভিন্ন যাত্রাদলের বুকিং হতো। স্টেশন ছাড়াও তার আশপাশ এলাকায় ছিল বেশ কয়েকটি যাত্রাদল ও তাদের বুকিং অফিস। সব মিলিয়ে ৪০টির মতো যাত্রাদল ছিল। এখন হাতেগোনা কয়েকটি। কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকসংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক তপনকুমার বিশ্বাস বলেন, “মানুষ কর্মব্যস্ত হয়ে পড়েছে। সময় ব্যয় করে যাত্রা দেখার সুযোগ তাঁদের অনেকেরই নেই। খুব গ্রামের দিকে মানুষ নিজেরাই টাকা তুলে যাত্রা করে আনন্দ করেন। অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নামে ‘নাইট’ হচ্ছে। যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে মানুষের স্বাদ বদলাচ্ছে। তাই যাত্রাও মার খাচ্ছে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy