‘পাঠান’ প্রমাণ করে দিয়েছে শাহরুখ এখনও ‘জিন্দা হ্যায়’। ছবি: সংগৃহীত।
দীর্ঘ চার বছর পর শাহরুখ খানের ছবি প্রেক্ষাগৃহে। ‘রইস’, ‘জব হ্যারি মেট সেজাল’, ‘জ়িরো’— পর পর বক্স অফিসে ব্যর্থ হয়েছিল তাঁর আগের ছবিগুলি। কিন্তু তাতে শাহরুখকে নিয়ে উন্মাদনায় কোনও ভাটা পড়েনি। এখনও পর্দায় তাঁকে কয়েক সেকেন্ড দেখলে বাকি ছবির ভুলত্রুটি মাফ করে দেয় দর্শক। সেটি গত বছর ‘ব্রহ্মাস্ত্র’-তে ছোট্ট ক্যামিয়ো করেই প্রমাণ হয়ে গিয়েছে যে, তিনি এখনও বলিউডের বাদশা। তাই বছরের শুরুতে ‘পাঠান’ মুক্তি নিয়ে প্রায় উৎসব শুরু হয়ে গিয়েছিল দেশ জুড়ে। কোনও ‘বয়কট গ্যাং’ বা কোনও রাজনৈতিক দল ভোরবেলা থেকে মাল্টিপ্লেক্সের সামনে দর্শকের ভিড় আটকাতে পারেনি। হাজার বিতর্কের মাঝেও জিতে গিয়েছেন বাদশা। ‘পাঠান’ প্রমাণ করে দিয়েছে শাহরুখ এখনও ‘জিন্দা হ্যায়’।
কিন্তু ছবিটা কেমন হল? গল্প কেমন? নাচ-গান কেমন, প্রেম কেমন? আসলে এ সব প্রশ্নই অপ্রাসঙ্গিক। শাহরুখ খানের ছবির অলঙ্কার মাত্র। মোদ্দা কথা, শাহরুখ কেমন? বেশ কয়েক বার এর আগে তাঁর ছবি নির্বাচনে যেন ব্যাটে-বলে লাগছিল না। এ বার তিনি নিঃসন্দেহে ছক্কা হাঁকিয়েছেন। বেছে নিয়েছেন বলিউডের অন্যতম সেরা প্রযোজনা সংস্থা। মার্ভেলের ধাঁচে তৈরি হয়েছে ‘স্পাই ইউনিভার্স’। মানে যখন এক জন সুপারহিরোয় কুলোয় না, তখনই এগিয়ে আসে ‘অ্যাভেঞ্জার্স’। ‘যশরাজ ফিল্মস’ও সেই ফর্মুলা মাথায় রেখে তৈরি করে ফেলেছে গুপ্তচরদের ব্রহ্মাণ্ড! যেখানে বলিউড মিশে যায়। ভাইয়ে-ভাইয়ে বিরোধ মিটে যায়। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বক্স অফিসের ভার তুলে নেন ইন্ডাস্ট্রির ‘বড়রা’। কারণ নায়করা নিজেই বলছেন, বলিউডের এই দুর্দিনে সব কিছু ‘‘বাচ্চোঁ কে হাত নেহি ছোড় সকতে!’’ কিন্তু মার্ভেল-ডিসি যা অনেক আগেই করে ফেলেছে, বলিউড তা করে দেখাতে বড্ড দেরি করে ফেলল না তো? যা-ই হোক, দেরি করে হলেও বলিউডে যে বদল আসছে, তা প্রমাণ করল ‘পাঠান’।
ছবির গল্প নিয়ে তেমন না ভাবলেও চলবে। দেশের অন্যতম সিক্রেট এজেন্ট পাঠান (শাহরুখ খান)। হাজার চোট লাগলেও ফের ঘুরে দাঁড়ায়। হাতকড়া, ছুরি, কাঁচি, গুলি, গ্রেনেড, মিসাইল— কিছুই তাকে হারাতে পারে না। দেশের প্রতি তার নিষ্ঠা এবং শ্রদ্ধা অবিচ্ছেদ্য। পাঠান যে মিশনেই যায়, কখনও ব্যর্থ হয় না— ইত্যাদি ইত্যাদি। মানে যে কোনও স্পাই ফিল্মের নায়ক যেমন হয় আর কি। রুবিনা (দীপিকা পাড়ুকোন) শত্রু দেশের (সেটা কোন দেশ আর এই ধরনের ছবিতে আলাদা করে বলার প্রয়োজন হয় না) গুপ্তচর। দু’জনের একটি মিশনে কাছাকাছি আসা, গল্পে একাধিক মোড়, বিশ্বাসঘাতকতা, টেক্কা দেওয়ার মতো বুদ্ধিমান ভিলেন (জন আব্রাহাম), শেষ মুহূর্তে দেশকে বাঁচানো— ফর্মুলা মেনে লেখা হয়েছে চিত্রনাট্য। যদি অ্যাভেঞ্জার্স বা বন্ডের মতো গল্পের আশা করেন, তা হলে কিন্তু চলবে না। সবে তো এই ব্রহ্মাণ্ড তৈরি হল। এখনই এত জটিল গল্প বা ‘মাল্টিলেয়ার্ড’ চিত্রনাট্য লেখার সময় আসেনি। ব্রহ্মাণ্ড যত বিস্তার করবে, আশা করা যায় নির্মাতারাও এ সবে মন দেবেন।
ছবির মূল ফোকাস অ্যাকশন। এবং প্রত্যেকটি অ্যাকশন সিকোয়েন্স পপকর্ন খেতে খেতে উপভোগ করার মতো। দক্ষ হাতে পরিচালনা এবং সম্পাদনা করা হয়েছে। হিরোগিরি দেখানোর জন্য কোনও সিকোয়েন্সই খুব লম্বা টানা হয়নি। বরং অনেকগুলি অ্যাকশন সিকোয়েন্স গল্প জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে উপভোগ্য অবশ্যই বিরতির কয়েক মিনিট পরের সিকোয়েন্সটা। সেখানেই যে ব্রহ্মাণ্ড খুলে যায়। ভাই-ভাই হাত মিলিয়ে দুষ্টের দমন করেন। গোটা সিকোয়েন্স জুড়ে আক্ষরিক ভাবেই একে অপরকে কাঁধ দেন বলিউডের রক্ষকরা। এবং হল ফেটে পড়ে জয়ধ্বনিতে!
গল্পে সে ভাবে মন দেওয়া না হলেও কিন্তু ছবিটি যাতে আন্তর্জাতিক মানে স্পাই ফিল্ম হয়ে উঠতে পারে, সে দিকে নজর দিয়েছেন পরিচালক সিদ্ধার্থ আনন্দ। তিনি অবশ্য অ্যাকশন ফিল্মে হাত আগেই পাকিয়েছিলেন ‘ব্যাং ব্যাং’ এবং ‘ওয়ার’ দিয়ে। তাই এই ছবিতে তাঁর পরিচালনা আরও খানিকটা পরিণত। বাণিজ্যিক ছবির অন্যতম লক্ষ্য যদি দর্শককে বিনোদন জোগানো হয়, তা হলে সেটা দিব্যি পূরণ করেছে এই ছবি। ২ ঘণ্টা ২৬ মিনিটের ছবি এক মুহূর্তের জন্যও কিন্তু একঘেয়ে, শ্লথ বা অহেতুক মনে হবে না।
অভিনয়ের বিচার করতে হবে অ্যাকশন সিকোয়েন্সে কে কেমন পারফর্ম করলেন সেই মাপকাঠিতে। কারণ বাকি ছবিতে অভিনয়ের প্রয়োজন সে ভাবে পড়েনি। মূল চরিত্রগুলির নেপথ্যকাহিনি বলতেই খুব বেশি সংলাপ খরচ করেননি নির্মাতারা। পার্শ্বচরিত্রগুলির কথা তো ছেড়েই দেওয়া যায়। শাহরুখ-দীপিকার অ্যাকশন দৃশ্যে অভিনয় আলাদা করে প্রশংসনীয়। কিন্তু তাঁদের রসায়নে ‘চেন্নাই এক্সপ্রেস’-এর ম্যাজিক নেই। প্রচারের সময়ে শোনা যাচ্ছিল জন আব্রাহামের এই ছবি নিয়ে নানা রকম অভিযোগ রয়েছে। তিনি গোসা করে বলেছেন, ছবি প্রসঙ্গে কিছুই বলতে চান না। ঝামেলাটা ঠিক কী নিয়ে, তা খোলসা করেননি যদিও। তবে ছবিতে তাঁর গুরুত্ব নিয়ে যদি হয়ে থাকে, তা হলে বিষয়টা ঠিক স্পষ্ট হবে না। কারণ গোটা ছবিতে তাঁর চরিত্র যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ এবং তেমনই রঙিন। পর্দায় তিনি অনেকটাই সময় পেয়েছেন এবং হলে দর্শকের হাততালি তাঁকে দেখে খুব একটা কম পড়েনি। আশুতোষ রাণার মতো শক্তিশালী অভিনেতাকে এখানে যথাযথ ভাবে ব্যবহার করা হয়নি। আলাদা করে যদি কারও অভিনয়ের কথা বলতেই হয়, তা হলে তিনি ডিম্পল কাপাডিয়া। সিক্রেট এজেন্টদের বস্ হিসাবে তাঁর বলিষ্ঠ শরীরী ভাষা এবং দৃঢ় অভিনয় দর্শকের মনে থাকবে।
শেষে যা নিয়ে কথা না বললেই নয়, তা অবশ্যই দীপিকার গেরুয়া বিকিনি। ছবিতে একটাই গান, ‘বেশরম রং’ (‘ঝুমে জো পাঠান’ এন্ড ক্রেডিটে)। এবং ছবি দেখলেই বোঝা যাবে এই গান কেন গুরুত্বপূর্ণ। গল্পে প্রয়োজন ছিল বলেই একটি মাত্র গান রেখেছেন নির্মাতারা। বাকি ছবি কিন্তু বিদেশি স্পাই ফিল্মের ধাঁচেই তৈরি। নাচ-গান করে সময় নষ্ট করা হয়নি। এই গানের শেষেই দীপিকা গেরুয়া বিকিনি পরেছিলেন। এবং শুধু নাচ-গান নয়, তার পরেও গোটা একটি গুরুত্বপূর্ণ অ্যাকশন সিকোয়েন্সও শুট করেছেন এই গেরুয়া বিকিনিতেও। উপরে একটি স্যারং জড়িয়েছিলেন বটে। শুধু গেরুয়া বিকিনি কেন, ছবিতে একাধিক দৃশ্যে দীপিকা অত্যন্ত মোহময়ী হয়ে উঠেছেন। সেই মায়া গুলি খেয়ে, মার খেয়ে, রক্তারক্তি হয়েও কিন্তু হারিয়ে যায়নি। পর্দায় তিনি সব সময়েই নিখুঁত! তবে শুধু ‘মেল গেজ়’ নয়, ‘ফিমেল গেজ়’-এর কথাও কিন্তু মাথায় রেখেছেন নির্মাতারা। শাহরুখ খানকে মন ভরে দেখা যাবে ছবিতে। বিস্ময়-মুগ্ধতা-ঈর্ষা— যাবতীয় অনুভূতি জাগতে পারে শাহরুখের অ্যাবস আর ম্যান বান দেখে! মনে হবে ৫৭ বছর বয়সে কী করে এক জন নিজের শরীর নিয়ে এত পরীক্ষানিরীক্ষা করতে পারেন? উত্তর অবশ্য ছবিতেই পেয়ে যাবেন। আপনার হাতে চিজ পপকর্ন-নাচোজ-বার্গার, যা-ই থাকুক, গোটা ছবি জুড়ে শাহরুখ শুধুই আপেল আর ইয়োগার্ট খেয়ে গেলেন!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy