Advertisement
১৫ জানুয়ারি ২০২৫
উন্নত দেশগুলি পরিবেশ খাতে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে না
COP 29

বেঁচে থাকার মতো টাকা

২০১৫ সালে প্যারিস চুক্তির মাধ্যমে যে পথে প্রথম পদক্ষেপ করা হয়েছিল, বর্তমান সম্মেলনের এই ঐকমত্য সেই ‘নিউ কালেক্টিভ কোয়ান্টিফায়েড গোল’-এর ভিত্তি তৈরি করল।

ঋণ: উন্নত দেশগুলিকে তাদের ঐতিহাসিক দায়ের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে বাকুতে মৌনী মিছিল। ২৩ নভেম্বর, ২০২৪।

ঋণ: উন্নত দেশগুলিকে তাদের ঐতিহাসিক দায়ের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে বাকুতে মৌনী মিছিল। ২৩ নভেম্বর, ২০২৪। ছবি: পিটিআই।

বিশ্বজিৎ ধর
শেষ আপডেট: ১৫ জানুয়ারি ২০২৫ ০৫:১৬
Share: Save:

বাকুতে রাষ্ট্রপুঞ্জের ২৯তম জলবায়ু সম্মেলন (সিওপি ২৯) শেষ হওয়ামাত্র আন্তর্জাতিক সংবাদ শিরোনামে এল এই খবরটি: ‘পরিবেশ রক্ষার্থে উন্নয়নশীল দুনিয়াকে দেওয়া অর্থের পরিমাণ তিন গুণ করতে রাজি হল সম্মেলন, সুরক্ষিত হল জীবন ও জীবিকা’। ২০০৯ সালের কোপেনহেগেন চুক্তি অনুসারে এত দিন লক্ষ্য ছিল, ‘প্রতি বছর উন্নত দেশগুলি উন্নয়নশীল বিশ্বকে পরিবেশ রক্ষার্থে ১০,০০০ কোটি ডলার অর্থসাহায্য করবে’। এই সম্মেলনে স্থির হল, ২০৩৫ সালের মধ্যে এই তহবিলের পরিমাণ বাড়িয়ে অন্তত ৩০,০০০ কোটি ডলার করতে হবে। এ ছাড়াও স্থির হল যে, সব দেশকেই এই চেষ্টা করতে হবে, যাতে উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলিকে পরিবেশ রক্ষা সংক্রান্ত তহবিলে দেওয়ার জন্য সব সরকারি ও বেসরকারি সূত্র মিলিয়ে ২০৩৫ সালের মধ্যে অন্তত ১.৩ লক্ষ কোটি ডলারের সংস্থান করা যায়। ২০১৫ সালে প্যারিস চুক্তির মাধ্যমে যে পথে প্রথম পদক্ষেপ করা হয়েছিল, বর্তমান সম্মেলনের এই ঐকমত্য সেই ‘নিউ কালেক্টিভ কোয়ান্টিফায়েড গোল’-এর ভিত্তি তৈরি করল।

মজার কথা হল, আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম যখন ভেসে যাচ্ছে এই বরাদ্দ বৃদ্ধির ‘সুসংবাদ’-এ, তখনই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, উন্নয়নশীল দুনিয়াকে আর্থিক সাহায্য দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতে অন্তত তিন গোত্রের ঘাটতি রয়েছে। প্রথমত, উন্নত দেশগুলির উচিত ছিল ২০২০ সালের মধ্যেই বছরে ১০,০০০ কোটি ডলার তহবিলের প্রতিশ্রুতিটি পূর্ণ করা; তারা সে কাজে দু’বছর দেরি করেছে। দ্বিতীয়ত, দেখা যাচ্ছে যে, অতিমারি-পরবর্তী দু’বছরে উন্নত দেশগুলি থেকে যে আর্থিক সাহায্য এসেছে, তার দুই-তৃতীয়াংশের বেশি এসেছে বেসরকারি ক্ষেত্র থেকে। অর্থাৎ, অতিমারি-জনিত আর্থিক মন্দার প্রকোপে যখন উন্নয়নশীল দেশগুলি ধুঁকছিল, তখনই তাদের বাধ্য করা হল বেসরকারি পুঁজির উপরে নির্ভর করতে— যে পুঁজি ঋণ নেওয়ার শর্ত তুলনায় কঠিনতর। বিশেষত ঋণ-জর্জরিত নিম্ন আয়ের দেশগুলির পক্ষে এটি সুসংবাদ নয়।

তৃতীয়ত, বাকুতে যে অর্থ বরাদ্দ করা হল, তা তৃতীয় বিশ্বের প্রকৃত প্রয়োজনের তুলনায় যৎসামান্য। বিভিন্ন হিসাব থেকে দেখা যাচ্ছে, উন্নয়নশীল দুনিয়ায় বিশ্ব উষ্ণায়ন-জনিত জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের বিরুদ্ধে লড়তে গেলে বছরে অন্তত এক লক্ষ কোটি ডলার প্রয়োজন। সেখানে বরাদ্দ হল ‘২০৩৫ সালের মধ্যে বছরে ৩০,০০০ কোটি ডলার’। ভারত বলেছিল, ‘উন্নত দেশগুলিকে বছরে অন্তত এক লক্ষ কোটি ডলার দিতেই হবে, যার বড় অংশ হবে বিভিন্ন ধরনের সাহায্য এবং স্বল্প সুদে ঋণ’, এবং, ‘উন্নয়নশীল দুনিয়ায় যেমন যেমন ভাবে অর্থের প্রয়োজন বাড়বে, এই তহবিলের পরিমাণও সে ভাবেই বাড়াতে হবে। অর্থাৎ, এখনকার লক্ষ্য হিসাবে বছরে ১০,০০০ কোটি ডলার, এবং ২০৩৫ সালের লক্ষ্য হিসাবে বছরে ৩০,০০০ কোটি ডলার, দু’টি অঙ্কই ভারতের হিসাব অনুসারে অত্যন্ত কম। সৌদি আরব বলেছে, উন্নত দেশগুলির কর্তব্য বছরে এক লক্ষ দশ হাজার কোটি ডলারের ব্যবস্থা করা— মূলত সাহায্য এবং স্বল্প সুদের ঋণ হিসাবে।

সম্মেলনের স্ট্যান্ডিং কমিটি অন ফাইনান্স (এসসিএফ)-সহ একাধিক প্রতিষ্ঠান ভারত এবং সৌদি আরবের দেওয়া হিসাবের পক্ষেই মত দিয়েছে। ২০২৪ সালে প্রকাশিত এসসিএফ-এর রিপোর্টে বলা হয়েছিল, প্যারিস চুক্তির প্রতি অঙ্গীকারের শর্ত পূরণ করতে সর্বমোট ৯৩টি উন্নয়নশীল দেশ যে তাদের জাতীয় পরিবেশ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে, তা যথাযথ রূপায়ণ করতে হলে ২০৩০ সালের মধ্যে পাঁচ থেকে সাত লক্ষ কোটি ডলার প্রয়োজন হবে। প্রায় একই ধরনের হিসাবপদ্ধতি ব্যবহার করে গোটা দুয়েক বেসরকারি ঋণপ্রদাতা সংস্থাও জানিয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে ১২৬টি উন্নয়নশীল দেশের মোট ৭.৮ থেকে ১৩.৬ লক্ষ কোটি ডলার প্রয়োজন হতে পারে। উল্লেখ্য যে, দু’টি সংস্থাই বলেছে, তাদের এই হিসাব প্রকৃত প্রয়োজনের তুলনায় সম্ভবত কম।

রাষ্ট্রপুঞ্জের সংস্থা ইউনাইটেড নেশনস কনফারেন্স অন ট্রেড অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট হিসাব কষে দেখিয়েছিল যে, পরিবেশ-খাতে উন্নয়নশীল দেশগুলির অর্থের প্রয়োজন ২০২৫ সালে ৫০,০০০ কোটি ডলার থেকে বেড়ে ২০৩০ সালে দাঁড়াবে এক লক্ষ পঞ্চান্ন হাজার ডলার। সংস্থার হিসাব ছিল যে, উন্নত দেশগুলি এই খাতে ২০২৫ সালে তাদের মোট জাতীয় আয়ের ০.৭% অর্থবরাদ্দ করতে পারে, যা ২০৩০ সালে গিয়ে দাঁড়াবে জাতীয় আয়ের ন্যূনতম এক শতাংশ। সেই লক্ষ্য পূরণ হবে, এ আশা ক্ষীণ— কারণ, উন্নত দেশগুলির সিংহভাগই এখনও এই খাতে তাদের জাতীয় আয়ের ০.৭% বরাদ্দ করে উঠতে পারেনি। ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট হাই লেভেল এক্সপার্ট গ্রুপ অন ক্লাইমেট ফাইনান্স’-এর হিসাব অনুযায়ী, চিন বাদে উন্নয়নশীল দুনিয়ার বাকি দেশগুলিকে তাদের ঘোষিত পরিবেশ-লক্ষ্য পূরণ করতে হলে ২০৩০ সালের মধ্যে এই খাতে প্রায় ২.৪ লক্ষ কোটি ডলার ব্যয় করতে হবে।

বাকুতে ‘নিউ কালেক্টিভ কোয়ান্টিফায়েড গোল’-এ অর্থবরাদ্দ বৃদ্ধি নিয়ে আলোচনার চোটে ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড’-এর প্রসঙ্গটি কার্যত হারিয়ে গেল। এই ব্যবস্থাটি কিন্তু প্রস্তাবিত নয়, সিওপি-২৯’এর সময় সম্পূর্ণ রূপে চালু— জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যে দেশগুলির সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা, এবং যে দেশগুলি ইতিমধ্যেই ক্ষতিগ্রস্ত, এই তহবিল তাদের অর্থসাহায্য করার জন্য। গত কয়েক বছর বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশ যে ভয়ঙ্কর পরিবেশ-বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে, তাতে এই তহবিলের গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। সিওপি-২৮ চলাকালীন যখন এই প্রকল্পটি চালু হয়েছিল, তখন ২৬টি দেশ এই তহবিলে মোট ৭৪.৯ কোটি ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। ২০২৪ সালের শেষে দেখা যাচ্ছে, প্রতিশ্রুত অর্থের কুড়ি শতাংশও তহবিলে জমা পড়েনি— আমেরিকা তার প্রতিশ্রুতির ১৩.৬% দিয়েছে মাত্র। আশঙ্কা হয়, অর্থের অভাবে এই তহবিলটিও শেষ অবধি মুখ থুবড়ে পড়বে। অবশ্য, প্রতিশ্রুতিমাফিক পুরো অর্থ এলেও কি খুব লাভ হবে? প্রতিশ্রুত অর্থের পরিমাণ ৭৪.৯ কোটি ডলার— এবং, ২০৩০ সালের মধ্যে এই খাতে প্রয়োজন হবে পঁয়তাল্লিশ হাজার কোটি থেকে নব্বই হাজার কোটি ডলার!

১৯৯২ সালে উন্নত দেশগুলি যখন জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত কনভেনশনের পক্ষে সায় দিয়েছিল, তখন স্থির হয়েছিল, জলবায়ু-সংক্রান্ত কর্মসূচি রূপায়ণে উন্নয়নশীল দুনিয়ার দেশগুলির যে পরিমাণ খরচ হবে, তার পুরো দায়ই বহন করবে উন্নত বিশ্ব। ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তিতেও উন্নত দেশগুলি প্রতিশ্রুতি দেয় যে, এই কনভেনশনের অধীনে তাদের পুরনো প্রতিশ্রুতি মাফিক উন্নয়নশীল দুনিয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ঠেকাতে, এবং ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা করতে যে অর্থ প্রয়োজন, সেটা তারাই দেবে। কিন্তু, ১৯৯২-এর কিয়োটো সম্মেলনের পর কেটে যাওয়া তিনটি দশকে স্পষ্ট, উন্নত দেশগুলি আসলে তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে না। তারা অন্য জিনিসকে অনেক বেশি গুরুত্ব দেয়। যেমন, আমেরিকা ২০২৪ সালে প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করেছে দু’লক্ষ কোটি ডলারেরও বেশি, কিন্তু লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ডে ১.৭৬ কোটি ডলারের বেশি দিয়ে উঠতে পারেনি। আশ্চর্য যে, বৈশ্বিক দক্ষিণ উন্নত দেশগুলির এই অস্বীকৃতিকে কার্যকর ভাবে চ্যালেঞ্জ জানায়নি। উন্নত দেশগুলির উপরে চাপ সৃষ্টি করে পরিবেশের প্রতি তাদের দায়িত্ব পালনে বাধ্য করা এখন বৈশ্বিক দক্ষিণের প্রধান দায়িত্ব।

অন্য বিষয়গুলি:

Climate Fund
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy