অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘নতুন বছর, পুরনো লড়াই?’ (১-১) প্রবন্ধে আর জি কর আন্দোলনের অর্জন হিসেবে সঠিক ভাবেই প্রতিস্পর্ধী সাহসের উত্তরাধিকারের কথা বলেছেন। আর জি কর আন্দোলন বাস্তবে এক জনজাগরণ। ‘জাস্টিস’ কথাটি আর জি কর আন্দোলনের দাবি হিসাবে শুরু হলেও তা আজ এক সর্বজনীন স্লোগানে পরিণত হয়েছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে যে কোনও প্রতিবাদে, যে কোনও আন্দোলনে জাস্টিস আজ সাধারণ দাবিতে পরিণত হয়েছে। বিচার পাওয়া তো পরের কথা, বিচার যে দাবি করা যায়, এটাই তো মানুষকে ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বিচার চাওয়া এবং পাওয়া যে ন্যায্য অধিকারের মধ্যে পড়ে, আর জি কর আন্দোলন সেই ভুলে যাওয়া কথাটাকেই স্মরণ করিয়ে দিয়ে গেল। এটা কি কম পাওয়া!
যাঁরা আজ মনে করছেন এত বড় আন্দোলনে লাভ কী হল, তাঁদের ভেবে দেখতে হবে যে, প্রতিপক্ষ এখানে প্রবল শক্তিশালী, সংগঠিত, দীর্ঘ দিনের কায়েমি শক্তি। বহু জনের, বহু দিনের স্বার্থ এখানে জড়িয়ে আছে। অন্য দিকে, আন্দোলনে জনগণের বিরাট অংশের অংশগ্রহণ থাকলেও তা অসংগঠিত। এক-এক অংশের মানুষের নিজস্ব বঞ্চনার সঙ্গে, দাবির সঙ্গে যেমন ভাবে এই বিচারের দাবি মিলে গেছে, ঠিক তেমন ভাবেই এই আন্দোলনে তাঁরা পা মিলিয়েছেন। কিন্তু দাবি আদায় পর্যন্ত পৌঁছতে যত পথ হাঁটতে হয়, নানা কারণে সবাই তত দূর পর্যন্ত না-ও পৌঁছতে পারেন। দাবি আদায়ের যে আরও বহু দিক আছে, সেগুলি সম্পর্কেও সকলের উপলব্ধি এক রকম নয়। এর বাইরেও রয়েছে অনেক স্বার্থবাদী অংশ, যারা আন্দোলনকে তাদের নিজেদের স্বার্থের খাতে টেনে নিয়ে যেতে তৎপর। সেই শক্তিগুলি সম্পর্কেও সচেতন থাকা দরকার।
প্রবন্ধকার সংঘর্ষের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে নির্মাণের কথা বলেছেন। এই নির্মাণের অঙ্গ যেমন সরকারের কাছে, বিচার ব্যবস্থার কাছে সংশ্লিষ্ট দাবিগুলি ঠিক মতো তুলে ধরা, তেমনই আন্দোলনে আসা মানুষগুলিকেও আরও পথ হাঁটার জন্য সব দিক থেকে প্রস্তুত করা। আন্দোলনের বর্তমান পর্যায়ে জনজীবনের অন্য দাবিগুলিকেও এই আন্দোলনের দাবির সঙ্গে যুক্ত করা দরকার, যাতে আরও বড় অংশের মানুষকে এই আন্দোলনে যুক্ত করা সম্ভব হয়। এটা করতে পারলেই সম্ভব হবে ক্ষমতার চোখে চোখ রেখে তার মুখের উপর স্পষ্ট কথা শুনিয়ে দেওয়া। এক বার নয়, বার বার।
সমুদ্র গুপ্ত, কলকাতা-৬
প্রতিবাদী সত্তা
‘নতুন বছর, পুরনো লড়াই?’ শীর্ষক অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় লিখিত প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। আর জি করের ঘটনার সূত্রে শীতঘুমে চলে যাওয়া সমাজটা আবারও জেগে উঠেছিল। মানুষের স্বভাবজাত প্রতিবাদী সত্তাটুকু চিকিৎসক-পড়ুয়ার নৃশংস হত্যাকাণ্ডে কিঞ্চিৎ জাগ্রত হয়েছিল। স্বার্থসুখে মত্ত এই সমাজে ক্ষমতার মুখের উপর কথা বলা মানুষের সংখ্যা ক্রমহ্রাসমান। কোনও একটি ঘটনায় হঠাৎই জেগে উঠে আন্দোলন কর্মসূচিতে যোগ দেওয়া আর ক্রমাগত চোখে চোখ রেখে আন্দোলন নির্মাণের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান বর্তমান। প্রবন্ধকার প্রশ্ন তুলেছেন, সাফল্য মানে কী? ক্ষমতার মুখের উপর কথা বলা, তাকে আলোচনায় বসতে বা পথে নেমে আসতে বাধ্য করা?
আর জি করের আন্দোলন শুরু হয়েছিল নারী-নির্যাতনের পরিপ্রেক্ষিতে সমাজের নারীবাদী জয়গানে। সেই আন্দোলনের মুখ পরিবর্তিত হয়ে মূলত স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং চিকিৎসক সমাজের নিজস্ব দাবিদাওয়া পেশ করায় পরিণত হয়। তাৎক্ষণিক সংঘর্ষের বাতাবরণে সরকার পক্ষের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে দাবিদাওয়া আদায়ের লক্ষ্যপূরণে ব্রতী আন্দোলনকারীদের একাংশের লক্ষ্য হয়ে ওঠে আন্দোলনের আসরে শাসকের মতামতকে কব্জা করা। প্রবন্ধকার যথার্থই লিখেছেন, ক্ষমতাবানেরা যদি দেখেন যে নমনীয়তার ভঙ্গিটুকুই তাঁদের মুশকিল আসানের কৌশল হিসেবে কাজ দিচ্ছে, তবে গরুড়ের মতো পাখার একখানা পালক ফেলে দিতে তাঁদের কিছুমাত্র অসুবিধা হবে না। তাই আন্দোলনের প্রতিটি পদক্ষেপে উত্তেজনা খুঁজতে যাওয়া বৃথা। ক্রিকেটমাঠে এক জন খেলোয়াড় যেমন দীর্ঘ সময় বাইশ গজে পড়ে থাকতে ছক্কা মারার বলগুলিতেও অনেক সময় লোভ সংবরণ করে থাকেন, তেমনই দীর্ঘ সময়ের আন্দোলনের নির্মাণ পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনার মতো তাৎক্ষণিক জ্বালাময়ী ভাষণে গড়ে উঠতে পারে না। দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলনের জমি প্রস্তুত করতে উত্তেজনার আবহে লোভ সংবরণ করাই যে আগামী দিনের সবুজের অভিযানকে যথার্থ ভাবে চালিত করতে পারে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
সঞ্জয় রায়, দানেশ শেখ লেন, হাওড়া
নতুন দিশা
২০২৪ সালের অগস্ট মাস, আর জি করের নৃশংস হত্যাকাণ্ড ছিল বিগত বছরের সবচেয়ে সাড়া জাগানো ঘটনা। প্রতিবাদ হয়েছিল স্বতঃস্ফূর্ত, বিশাল এবং ঐতিহাসিক। অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়ের প্রবন্ধটি আগামী দিনে নতুন দিশা দেখানোর সুচিন্তিত এক পদক্ষেপ। প্রতিবাদে গড়ে ওঠা মঞ্চের সমব্যথী জনরোষ কতটা দাবি আদায়ে সমর্থ হয়েছে সেটা অবশ্যই লক্ষণীয়, কিন্তু শাসককেও নতি স্বীকারে যে বাধ্য করা যায়, তা প্রমাণিত। তবে নতিস্বীকার শাসকের দুর্বলতা ছিল, না কি সুচতুর কৌশল, তার মূল্যায়ন হওয়া উচিত। দাবি পূরণের নামে কিছু অঙ্গরাগ করে মূল প্রসঙ্গ থেকে বেরিয়ে আসার মধ্যে সদিচ্ছা অধরা। অভয়ার হত্যাকাণ্ড যে স্বাস্থ্য দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার, তা পারিপার্শ্বিক তথ্য প্রমাণে স্পষ্ট। তদন্তে অবহেলা, বিচারে বিলম্বিত পদক্ষেপ প্রতিবাদীদের কিছুটা হতাশ করেছে ঠিকই, কিন্তু অতীতের গণরোষের চেহারাকে স্মৃতিতে রেখে সংগঠিত তীব্র গণআন্দোলন, দাবি আদায়ের একমাত্র বিকল্প। মানুষের মধ্যে জমে থাকা ক্ষোভকে সঙ্গে নিয়ে শুরু হোক নতুন বছরে নতুন করে লড়াই, আর নব নির্মাণের অঙ্গীকার।
সারনাথ হাজরা, হাওড়া
নিবন্ত আগুন
গত ৯ অগস্টের ঘটনার পর দোষীদের শাস্তির ব্যাপারে জুনিয়র চিকিৎসকদের গণআন্দোলন সারা রাজ্যে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল। সাততাড়াতাড়ি আদালতের সিবিআই তদন্তের নির্দেশে সঠিক বিচারের আশায় জনগণ মনোবল ফিরে পেয়েছিল। এবং জনজাগরণের সম্মুখে পড়ে বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের জুজু দেখতে পেয়ে সরকার সিঁটিয়ে গিয়ে দোষীদের ‘ফাঁসি’ এবং ‘এনকাউন্টার’-এর প্রলাপ বকছিল। তার পর হঠাৎ কী এমন ঘটল যে, কোনও এক অদৃশ্য অঙ্গুলিহেলনে প্রকৃত বিচারকে অন্ধকারের মধ্যে রেখে দিয়ে আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তার, নাগরিক সমাজ এবং নির্যাতিতার বাবা, মা হতাশার সাগরে নিমজ্জিত হলেন? কেউ কল্পনা করতে পারেনি যে, সরকার এই ধরনের ঘৃণ্য ঘটনার সঠিক বিচারের চেষ্টা না করে, এর সঙ্গে জড়িত প্রকৃত দোষীদের কঠোর শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা না করে, প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করতে কোটি কোটি খরচ করবে! ফলে, আগামী দিনে কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা সিবিআই-এর কাছে অভিযোগকারীদের বহু তথ্যপ্রমাণ থাকা সত্ত্বেও, চার্জশিট পেশ না করায় অভিযুক্তরা একে একে জামিনে মুক্তি পেয়ে দিব্যি আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ঘুরে বেড়াবে। আর নতুন বছরে হয়তো সঞ্জয় রায়কে বলির পাঁঠা বানিয়ে প্রকৃত ঘটনাকে চাপা দিয়ে দেবে।
স্বাভাবিক ভাবেই জুনিয়র চিকিৎসক ও সাধারণ মানুষের রাতদখল করা গণজাগরণের আগুন আরও সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে একেবারেই নিবে যাবে। ব্যস, তা হলেই কেল্লা ফতে!
তপনকুমার বিদ, বেগুনকোদর, পুরুলিয়া
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy