নেহাত মিরিয়াম-ওয়েবস্টার ডিকশনারিটা বাংলায় নয়, ইংরেজিতে। নইলে হয়তো বছরের শব্দ হিসেবে নির্বাচিত হত ‘আমরা-ওরা’। পরিবর্তে প্রধানতম আমেরিকান ডিকশনারি ২০২৪-এর শব্দ হিসেবে বেছেছে ‘পোলারাইজ়েশন’-কে। অর্থাৎ ‘মেরুকরণ’। মূলত আমেরিকার এ বারের ভোটের প্রেক্ষিতে আমেরিকান সমাজের দু’মেরুতে বিভক্ত হওয়ার যে রূপরেখা দেখা গিয়েছে, তার প্রেক্ষিতেই এই সিদ্ধান্ত। একে ট্রাম্প-যুগের ফলিত রূপায়ণ হিসেবে ভাবতে চান অনেক বিশেষজ্ঞ, যা জমাটি রূপ নিয়েছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পুনর্নির্বাচনের প্রেক্ষিতে।
এই ট্রাম্প-যুগটার সূত্রপাত মোটামুটি ২০১৬-র আমেরিকার ভোটের সময় থেকে। ফেক নিউজ় আর পোস্ট ট্রুথ-বিধ্বস্ত এক নতুন যুগের সূচনার সন্ধিক্ষণ সেটা। কিন্তু শুধুমাত্র আমেরিকার নয়, এ গ্রহের সর্বত্রই এই তীব্র মেরুকরণের নগ্ন ছবি। তাই শুধুমাত্র ট্রাম্পের উপর এর পূর্ণ দায়ভার চাপিয়ে দেওয়াটা বোধ হয় যুক্তিযুক্ত নয়। তা ছাড়াও পোস্ট ট্রুথের অবাক-দুনিয়ায় আমরা তো আর হঠাৎ ঢুকে পড়িনি, বিশ্লেষকরা এ সবের বীজ খুঁজে পেয়েছেন আধ শতক বা তারও আগেকার ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে। আমেরিকার প্রেক্ষিতে ২০২৪ সালে প্রকাশিত বই দ্য রুটস অব পোলারাইজ়েশন: ফ্রম দ্য রেশিয়াল রিঅ্যালাইনমেন্ট টু দ্য কালচার ওয়র্স-এ ইউনিভার্সিটি অব অরেগন-এর অধ্যাপক নিল ও’ব্রায়ান দেখিয়েছেন ১৯৬০-এর দশকের সিভিল রাইটস আন্দোলন প্রভাবিত করেছে আজকের পক্ষপাতমূলক সংস্কৃতির সংঘাতকে। এর শিকড় আবার খুঁজে পাওয়া সম্ভব ১৯৩০-এর দশকের বিবিধ সাংস্কৃতিক সংঘর্ষের মধ্যে।
অভিধান অনুসারে ‘পোলারাইজ়েশন’ বা মেরুকরণ সংজ্ঞায়িত হয় দু’টি তীব্র ভাবে স্বতন্ত্র বিপরীত প্রান্তে বিভাজনের মাধ্যমে। কর্মক্ষেত্রেও সাংস্কৃতিক মেরুকরণ হয়ে উঠছে এক কঠিন চ্যালেঞ্জ, সতর্ক করেছে ফোর্বস ম্যাগাজিন। তবে দুনিয়া জুড়ে মেরুকরণ প্রকটতর হওয়া নিশ্চয়ই বহুমাত্রিক ঘটনা-প্রবাহের ফসল। রয়েছে অর্থনৈতিক, ভৌগোলিক এবং প্রযুক্তির বিবর্তন-জনিত কারণসমূহ। এ সব মিলেই বদলে দিচ্ছে সমাজের অভিমুখ, তার সুস্থিতি।
আয় এবং সম্পদের বেড়ে চলা বৈষম্যও বাড়াচ্ছে রাজনৈতিক মেরুকরণ। ১৯৭০-এর দশক থেকে এই বৈষম্য বাড়ছে অনেকটাই। মধ্যবিত্ত কমেই ক্ষীণতর হচ্ছে আমেরিকা-সহ নানা দেশে। অর্থনীতির ইতিহাসবিদ এমআইটি-র অধ্যাপক পিটার টেমিন তাঁর বই দ্য ভ্যানিশিং মিড্ল ক্লাস-এ দেখিয়েছেন, দ্বৈত অর্থনীতি সংক্রান্ত ল্যুইস মডেল সুপ্রযুক্ত হয়ে উঠেছে আমেরিকার প্রেক্ষিতে। বিশ্বায়ন, মুক্ত অর্থনীতি, পুঁজিপতি এবং পেশাদারদের সাহায্যকারী নতুন প্রযুক্তি, ক্ষয়িষ্ণু হতে থাকা শ্রমজীবীদের সুরক্ষা, এ সবের ফলে আমেরিকায় মধ্যবিত্তের ঘটছে অবক্ষয়। ভারত-সহ যে-সব দেশে মধ্যবিত্তদের অনুপাত স্ফীত হচ্ছে আপাতভাবে, সেখানেও কিন্তু মধ্যবিত্তের সংজ্ঞা বদলেছে অনেক ক্ষেত্রেই।
এই অক্টোবরেই তো ‘ফার লেফট’ আর ‘ফার রাইট’ শব্দ দুটো যুক্ত হয়েছে অভিধানে। রাজনীতি হোক কিংবা খেলা বা বিনোদন, সমর্থন প্রধানত দুই শিবিরে বিভক্ত থাকত আগেও। বিপরীত মতাদর্শের রাজনৈতিক দল শুধু নয়, প্রতিযোগী দুই ফুটবল দল কিংবা বিনোদন বা ক্রীড়া দুনিয়ার দুই তারকার সমর্থকদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ থাকত আগেও। পার্থক্য হল, আগে মধ্যপন্থার একটা বড়সড় জায়গা থাকত সমাজে। আর এখন তা ক্রমেই গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছে। অভাব দেখা দিচ্ছে ভারসাম্য রক্ষাকারীদের। ফলে মতান্তর ক্রমে মনান্তরের পথ বেয়ে পরিণত হচ্ছে এক সর্বব্যাপী ঘৃণায়। আমেরিকায় দুই র্যাপ গায়ক ড্রেক আর কেন্ড্রিক লামার-এর মধ্যে দ্বন্দ্বও এখন মেরুকরণের পর্যায়ভুক্ত হয়ে দাঁড়ায়। প্যারিস অলিম্পিক্সের পরে আমেরিকান জিমন্যাস্ট জর্ডান চিলিসের ব্রোঞ্জ পদক কেড়ে নেওয়ার আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির সিদ্ধান্তও মেরুকরণের রূপ বলে পর্যবসিত হয়। ইটালি থেকে আর্জেন্টিনা, আমেরিকা থেকে ভারত, সর্বত্র ক্রমবর্ধমান মেরুকরণের ছবি।
মেরুকরণ মানে বিভাজন নিশ্চয়ই, তবে এক নির্দিষ্ট ধরনের বিভাজন। আমরা কেন্দ্রের দিকে না গিয়ে ঝুঁকছি প্রান্তের দিকে। মধ্যপন্থার বিসর্জন যে কতটা বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে ফরাসি ইমানুয়েল মাকরঁ কিংবা জার্মান ওলাফ শোলৎজ তার সাক্ষ্য দেবেন নিশ্চয়ই। সমাজে কতটা অস্থিরতা বিস্তার করতে পারে এক শক্তিশালী মধ্যপন্থার অনুপস্থিতি, তার প্রমাণ মিলবে ইউরোপ-সহ দুনিয়ার নানা দেশে।
ম্যাট গ্রসম্যান আর ডেভিড হপকিন্স বই লিখেছেন সম্প্রতি, পোলারাইজ়ড বাই ডিগ্রিজ়। কয়েক দশক ধরেই আমেরিকান সমাজ অনুভব করেছে বেশ কিছু মৌলিক পরিবর্তন। সামাজিক গোষ্ঠীগুলির মধ্যে সম্পর্কের পরিবর্তন, ভাষা ও আচরণের নিয়মের বিবর্তন, কলেজ ডিগ্রির ক্রমবর্ধমান মূল্যায়ন। এ সব রূপান্তর মেরুকরণ করেছে দেশটার রাজনৈতিক আবহাওয়াকে। দাউদাউ করে জ্বালিয়ে দিয়েছে ধিকিধিকি এক চিরস্থায়ী সাংস্কৃতিক যুদ্ধকে। ডেমোক্র্যাটরা ক্রমেই প্রগতিশীল সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি-সম্পন্ন উচ্চশিক্ষিতদের পার্টিতে পরিণত হয়েছে, আর রিপাবলিকানরা হয়ে উঠেছে কলেজ ডিগ্রি-হীন শ্বেতাঙ্গদের দল, শিক্ষক, বিজ্ঞানী, সাংবাদিক, বিশ্ববিদ্যালয়, ইত্যাদির প্রতি অবিশ্বাসকে সঙ্গী করে। ক্রমেই জটিল হচ্ছে দুনিয়া, যেখানে সব কিছুই রাজনীতি, এবং রাজনীতি সব কিছু নিয়েই।
প্রযুক্তিও তীব্র করে মেরুকরণকে। কারণ, প্রযুক্তির মাধ্যমে সমাজের এক শ্রেণি হয়ে ওঠে বেশি ক্ষমতাশালী, সম্পদশালী। গত দু’তিন দশকের দুনিয়াব্যাপী মেরুকরণে তাই আন্তর্জাল, সোশ্যাল মিডিয়া এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ফুলেফেঁপে উথলে ওঠার অবদান অভূতপূর্ব। ক্রিস বেল তাঁর বই ব্রেকিং দ্য সোশ্যাল মিডিয়া প্রিজ়ম-এ তত্ত্বতালাশ করেছেন সোশ্যাল মিডিয়ার রাজনৈতিক প্রভাব। বেল দেখিয়েছেন কী ভাবে সোশ্যাল মিডিয়া এবং মুখোমুখি আলাপচারিতার ক্রমবিস্তৃত ব্যবধানের ফলে বাড়তে থাকে রাজনৈতিক মেরুকরণ। সোশ্যাল মিডিয়াকে তিনি ‘দর্পণ’ বলেননি, বলেছেন ‘প্রিজ়ম’, যার বিচ্ছুরণ দিয়ে মানুষ নিজেকে এবং অন্যদের তির্যক ভাবে দেখে।
আর, কী করেই বা অগ্রাহ্য করা সম্ভব কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে? এ-যাবৎ মূলত হামাগুড়ি দিয়ে চললেও তা প্রশস্ততরই করেছে সামাজিক বিভাজনকে, প্রধানত সোশ্যাল মিডিয়াকে মাধ্যম করে। এআই-এর আরও রমরমায় হয়তো আরও তীক্ষ্ণ হবে এই মেরুকরণ। দুই প্রান্ত ক্রমেই স্ফীত হয়ে, মধ্যভাগ ক্ষয়িষ্ণু হয়ে, সমাজ ক্রমেই হবে আরও দুই মেরুতে কেন্দ্রীভূত।
রাশিবিজ্ঞান বিভাগ, ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy