অলঙ্করণ: শৌভিক দেবনাথ।
কাল ৩১!
ভোর সাতটায় আমার বাড়ি...
জন্মদিনের জলখাবার...
চলে আসিস!
আজ ঋতুর মেসেজ বক্সে তো আমার এই টেক্সটাই লেখার কথা ছিল!
ওর আর আমার জন্মদিন মানেই তো আমাদের ভোর সাতটার দেখা। আর ব্রেকফাস্ট।
ঋতু আসলে আমার একটা ‘তুই’। যাকে দিতে পারতাম অনিয়মের সব উপহার। যে বলতে পারতো তার সব মনখারাপের কলঙ্ক। যার সঙ্গে জীবনে ভাব কম, ঝগড়া বেশি হয়েছে আমার! অনিয়মের ঋতু, নিয়মের ঋতু সবটাই আমার কাছে খোলা খাতার মতো। আমি আমার দিক থেকে যেমন ওকে যত্ন দিয়েছি, বন্ধুতা দিয়েছি, আমি আর অর্পিতা অনেক সময় আগলেও রেখেছি, তেমনই ও এক অন্য প্রসেনজিৎ-কে, এক নতুন প্রসেনজিৎ-কে জন্ম দিয়েছে।
আরও খবর: একার লড়াই চালাতেন ঋতুপর্ণ, যে লড়াইয়ের পরে আলো আসে
আজও মঞ্চে দাঁড়িয়ে ওকে নিয়ে বলতে পারি না...নাহ! অতো শক্ত মন আমার নয়।
শুনেছিলাম ‘হীরের আংটি’ করার সময় থেকেই ওর ইচ্ছে ছিল প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে কাজ করার। লোকে বলেছিল ওকে- ধুর অতো বড় স্টার আসবেই না! রিনাদির বাড়িতে ‘উনিশে এপ্রিল’-এর জন্য প্রথম ওকে দেখি। কাজ ও করি। ছবিতে একটা ছোট অংশ আমার অভিনয় ছিল। তার পর আসতে আসতে আমাদের পরিচয়।
আমাদের আজকের এই ইন্ডাস্ট্রিতে আর্ট ফিল্ম যে কমার্শিয়াল ছবির ধারায় মিশে গিয়েছে। এর শুরু তো ঋতুর ছবি থেকেই। কত বড় অবদান ওর বাংলা ছবিতে! যেমন একদিকে আমি, দেবশ্রী, ঋতুপর্ণা— আমরা যখন চুটিয়ে কমার্শিয়াল করছি তখন ঋতু আমাদের ওর ছবিতে নিয়ে এল। আবার অন্য দিকে অঞ্জনদা, মমদির মতো আর্ট ফিল্মের অভিনেতারাও ওর ছবিতে এল। এই যে মিলমিশ যা এখন আমরা কৌশিক, সৃজিতের ছবিতে দেখি, সেটার সূচনা তো ঋতুর হাত ধরেই হয়েছিল। এই প্রজন্মের সকলের ওকে খুব দরকার ছিল এই সময়! তিন রাত্রি বসে যে লোকটা ছবির চিত্রনাট্য লিখে ফেলত পারত! আর কী সব গল্প। মিস করি...
আমাকে যে ভাবে ভেঙেচুরে দিত! ও বলেই পারত। আমাকে কিন্তু ছবিতে বেশির ভাগই নেগেটিভ চরিত্র দিয়েছিল ও। ‘দোসর’, ‘চোখের বালি’, ‘উৎসব’, ‘সব চরিত্র কাল্পনিক’। একমাত্র ‘খেলা’ ছিল পজিটিভ চরিত্র। লেখকের নায়ক।
‘দোসর’ ছবির দৃশ্য
আমার মনে আছে কান ফেস্টিভ্যালে আমি আর ঋতু যাচ্ছি ‘দোসর’-এর জন্য। ঋতুর সঙ্গে যাওয়া মানেই ওর ঢাউস লাগেজ এবং সেটা যে কোনও ভাবেই হয় আমায় শেয়ার করতে হবে না হয় অন্য কাউকে। আমিও যদিও ঋতুর লাগেজ বাড়ানোর লিস্টে ঋতুর চেয়ে খুব একটা কম ছিলাম না! সুতরাং ‘অন্য কেউ’কে ঋতু ঠিক খুঁজে বার করত। এমনও হয়েছে, চ্যানেলের লোক দেখতে পেয়েছে, ব্যাস অমনি ওকে রীতিমতো হুকুম, “আমার এই সুটকেসটা নিয়ে যাবি!” উফফ! এ সব একমাত্র ঋতুই পারত। যেখানে যা দেখবে কিনবে। ঘর সাজাবার জিনিসের জন্য তো পাগল!
যাই হোক, কান-এ ‘দোসর’ দেখানোর পর হল কী, একজন মেমসাহেব আমায় পাকড়াও করে জানতে চেয়েছিলেন, “যদি আপনার বান্ধবী বেঁচে যেত? কী করতেন আপনি?” আমি তো থতমত, ঋতুকে খুঁজছি, ওঁকে বোঝাতে চেষ্টা করছি, আমি তো ছবিতে কেবল অভিনয় করেছি। কে শোনে কার কথা! সে মেমসাহেব ছাড়েই না! এতটাই প্রভাব ফেলত ঋতুর ছবি বিশ্বের মানুষের কাছে। আমার আজও মনে আছে, মণিরত্নম জানতে চেয়েছিলেন ঋতুর কাছে, ‘দোসর’-এ আমার মেক আপ কি কলকাতায় করা? ঋতু বলেছিল, “সব ক্রেডিট বুম্বার। ওকে ছবিতে কাস্ট করার এটাই সুবিধা। ও নিজে ওর বেস্ট দেওয়ার জন্য সব দায়িত্ব নিয়ে নেয়।”
ছবির ক্ষেত্রে বেশির ভাগ সময় আমি আর ঋতু আগে আমার দৃশ্যগুলো বলে নিতাম। ওখানেই আমায় ঠিক কী কী করতে হবে তার ইঙ্গিত ও দিয়ে দিত। তারপর নায়িকা এলে আমি ওই ভাবেই অভিনয় করতাম। তখন একবারও আমার দিকে দেখত না! এতটা আত্মবিশবাস ছিল ওর। অভিনয়ের ক্ষেত্রে এরকম শিক্ষক আর আমি পাব না।
মানুষকে কী অসম্ভব অপ্রস্তুত করতে পারত ও! কান-এর রেড কার্পেট এ আমরা দু’জন পাশাপাশি। ও এমন সাজল, সেই মাথায় পাগড়ি। জমকালো সাজ। কেউ ভাবছে ইনি বোধহয় ‘ইন্ডিয়ার রাজা’ কেউ ভাবছে অভিনেতা। সবাই দেখছে। আর ঋতু আমার দিকে দেখিয়ে বলছে, ‘ইনি অভিনেতা’।
খুব ভালবাসত ঋতু আমায়। আঁকড়ে ধরার ভালবাসা। অভিমানও ছিল। ঋতু বলত, অভিমান বললেই শুধু মেয়েদের মুখ কেন ভেসে উঠবে?
ওর এই নিজেকে অনেকটা উজাড় করে আমার সামনে ধরার জায়গা থেকে আমিও ওর প্রতি ইনভল্ভড হয়ে যেতাম। আমারও অধিকার বোধ জন্মেছিল। ইন্ডাস্ট্রির সবাই জানত, আমিই পারতাম ওর রাগ ভাঙাতে। ও রেগেমেগে দুম করে ইউনিট ছেড়ে বেরিয়ে গেলে আমার কাছে আগে ইউনিট থেকে ফোন আসত। ‘ঋতুদা ইউনিট ছেড়ে চলে গিয়েছে’ আমি হয়তো তখন অন্য ইউনিটে। ফোন করে বললাম, ‘ইউনিটকে বসিয়ে সময় নষ্ট করিস না। ফিরে যা।’ আমি বললে ঋতু না করত না। পরে খবর নিয়ে জেনেছিলাম, ও কাজ শুরু করেছে।
বন্ধুত্বে একটা ভরসার জায়গাও ছিল তো। ‘আবহমান’-এ কাস্টিং নিয়ে যখন ঋতু সমস্যায় পড়েছে আমি ওকে অনন্যার কথা বলি। ও অনন্যাকে ফোন করে বলেছিল, ‘একজন বিখ্যাত মানুষ তোমার কথা বলেছে তাই তোমায় কাজটা করার কথা বলছি। নয়তো বলতাম না!’
এরকমই ছিল ঋতু। আউটডোরে গেলে সকালে উঠে আগে হোটেলের নীচে বুটিক শপ থেকে কিছু না কিছু কিনবেই আর ফস ফস করে ইউনিটের লোককে সে গুলো দিয়ে দেবে। আমিও অবশ্য খুব শপিং করি। নিজের জন্য নয়, সকলকে দেওয়ার জন্য।
এই দেওয়া-নেওয়া ইউনিটের লোকজন সকলকে নিয়ে থাকতে চাইত ঋতু, আসলে তো খুব একা ছিল...
যখন নিজের শরীর নিয়ে খেলতে শুরু করল, তখন থেকেই নিজেকে আমার কাছ থেকে আড়াল করে রাখতে শুরু করল। জানত আমি বাধা দেব। আমাকে না জানিয়ে লুকিয়ে অপারেশন করিয়ে আসত। যে ঋতু জোর করে ভোর ছ’টায় আমায় ঘুম থেকে উঠিয়ে ওর চিত্রনাট্য শোনাত, আমি শুনতে না চাইলে রেগে যেত। আমার সঙ্গে ঝগড়া করে আমার বাড়িতে এসেই অর্পিতার হাতের রান্না খেত...অথচ আমার সঙ্গে একটা কথাও বলত না...সেই ঋতু চলে যাওয়ার আগেই আসতে আসতে আমার কাছ থেকে চলে যাচ্ছিল! অদ্ভুত একটা ট্রান্সে নিজেকে নিয়ে গিয়ে ফেলেছিল। ওই 'চিত্রাঙ্গদা'র সময় থেকেই। আমি তো বলেছিলাম তোর 'চিত্রাঙ্গদা-র অঞ্জন দত্ত তো আমি।' বলেছিল, 'তুই অতো ছোট চরিত্র তো আর করবি না'।
চলে যাওয়ার ভয় আমাদের নিরন্তর। যে প্রিয়জনের আজীবন পাশে থাকার অন্য কোন দায় ছিল না, শুধুমাত্র হৃদয়ের অঙ্গীকার ছাড়া- সে ও তো চলেই যায়।
ঋতু এরকম বলতো। এ ভাবে ভাবত। আজ আমি ভাবি...
আমার মধ্যেও তো একটা ঋতু বেঁচে আছে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy