Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪
Entertainment News

আরডি-র গানে সারা পৃথিবীর মিউজিক উঠে এসেছিল

বহু বার আরডি এসেছেন সলিলদার বাড়িতে। সামনে থেকে দু’জনের কথোপকথন শুনেছি। দু’জনে দু’জনের প্রতি অসম্ভব শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। সলিলদার মুখে শোনা একটা মজার গল্প শেয়ার করি।

আর ডি বর্মণ।

আর ডি বর্মণ।

দেবজ্যোতি মিশ্র
শেষ আপডেট: ০৪ জানুয়ারি ২০১৮ ০৯:৩০
Share: Save:

আমার তখন ২১-২২ বছর বয়স। সলিলদা, অর্থাত্ সলিল চৌধুরী আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন। আলাদা করে পঞ্চমদা বলে কোনওদিন ডেকেছিলাম বলে মনে পড়ে না। বয়স আন্দাজে আমার হয়তো কাকু বলে ডাকা উচিত ছিল। ‘এটা করেছি বা এটা বানিয়েছি, আপনি একটু দেখুন’- রাহুল দেব বর্মণকে এ ভাবেই সম্বোধন করতাম।

বহু বার আরডি এসেছেন সলিলদার বাড়িতে। সামনে থেকে দু’জনের কথোপকথন শুনেছি। দু’জনে দু’জনের প্রতি অসম্ভব শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। সলিলদার মুখে শোনা একটা মজার গল্প শেয়ার করি।

তখন ‘দম মারো দম’-এর সময়। আরডি ওই ধরনের গান তৈরি করছেন। তাঁর বাবা অর্থাত্ শচীন দেব বর্মণ সে সব গান শুনে একদম খুশি ছিলেন না। বরং পঞ্চমদার কাজকর্ম নিয়ে বেশ বিরক্ত ছিলেন। এক দিন সলিলদাকে ডেকে বলেছিলেন, ‘‘ও আমার পোলা, তোমার চেলা। কী করতাসে আমি বুঝতে পারি না। তুমি ওরে কও।’’ সলিলদা শচীনকত্তাকে আশ্বস্ত করেছিলেন, ‘‘শচীনদা আপনি যে ঘরানার, আমি সেই ঘরানার নই। পঞ্চমকে ওর মতো হতে দিন। দেখবেন ও সংস্কৃতিও হারাবে না আবার নিজের জায়গাও তৈরি করে নেবে।’’

চেনা মেজাজে পঞ্চম। — ফাইল চিত্র।

১৯৯৪-এ পঞ্চমদা চলে গিয়েছেন। আজ সেই দিন। আমার মনে হয় দূরত্ব থেকে দেখলে যেন সৃষ্টিশীল মানুষকে আরও বেশি করে বোঝা যায়। বলতে চাইছি, কারও ব্যক্তিজীবন যখন ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে থাকে তখন যেন তাঁর কাজ আরও বেশি করে উঠে আসে। পঞ্চমদার কথা বলতে গেলে প্রথমেই যেটা মনে হয় তা হল ওঁর ফ্রেশনেস। যেটা সে সময় সাঙ্ঘাতিক বৈপ্লবিক ছিল। আর আজও সমান প্রাসঙ্গিক।

রাহুল দেব বর্মণের গানে সারা পৃথিবীর মিউজিক উঠে এসেছিল। সারা পৃথিবীর মিউজিক শুনতেনও। এক জন মিউজিশিয়ান যখন ছবিতে কাজ করেন অনেক রকম ভাবে বদ্ধ থাকতে হয়। সেটা অতিক্রম করে এত দিন যখন কোনও কাজ থেকে যায় তখন বুঝতে হবে মূল রসদটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

তখন কলকাতা-মুম্বই এখনকার থেকে অনেক বেশি কাছাকাছি ছিল। কলকাতায় আরডি খুব বেশি থাকেননি, তবে কলকাতার সঙ্গে যোগাযোগ ঘনিষ্ঠ ছিল। বাবার গানের থেকেও অনেক কিছু পেয়েছেন। আসলে গানকে গান হিসেবে দেখার থেকেও অনেক বেশি মিউজিক হিসেবে দেখতেন উনি। ফলে প্রচুর মিউজিক্যাল ফ্রেজিং আমরা পাই ওঁর গানে।

একটা কথা ভুলে গেলে চলবে না, যে সময় রাহুল কাজ করেছেন সে সময় ইন্ডাস্ট্রিতে অনেক পাওয়ারফুল মিউজিক ডিরেক্টর রয়েছেন। ফলে যা-ই করেছেন খুব বুদ্ধি করে করতে হয়েছে। যেমন ধরুন, ‘র‌্যায়না বিত যায়ে…’ রাগরাগিণীর জায়গা থেকে তৈরি। তবে তাতেই আবদ্ধ না থেকে ওয়ার্ল্ড মিউজিকের দিকে নিয়ে গেলেন।

বিশ্বসঙ্গীতের পপুলিস্ট ফর্মগুলো ধরেছিলেন পঞ্চমদা। লাতিন আমেরিকান মিউজিকের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। লাতিন আমেরিকান পারকাশনের সঙ্গে তবলার বোল অদ্ভুত ভাবে মিলিয়েছেন। ধরুন, তবলা তবলাকে ছাড়িয়ে বেরোচ্ছে। থুম্বা থুম্বাকে ছাড়িয়ে বেরোচ্ছে। দু’টো একটা মিডওয়েতে গিয়ে মিট করেছে। সেটাই আরডি তৈরি করেছিলেন।

আমরা এখনও বিদেশে গিয়ে যে মিউজিক শুনি তা সেই সত্তরের দশকেই আরডি একটু একটু করে আমাদের গানে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। টানা টানা সুরের বাইরে ওর গানে অনেক ছন্দ তৈরি হয়েছে। ওই গানটা মনে পড়ে? ‘মহুয়ায় জমেছে আজ মৌ গো’— লোকসঙ্গীত, ক্লাসিক্যাল সব কিছু ভেঙেচুরে তছনছ করে দিয়েছেন। আবার ‘তেরে বিনা…’-য় নেপালী মাদল ব্যবহার করে যে ছন্দটা তৈরি করে সেটা লাতিন। অর্থাত্ সব কিছু নিচ্ছেন, কিন্তু সেটাকে নিজের মতো করে নিচ্ছেন।

আসলে সে সময় ইউরোপিয়ান ক্লাসিক্যাল মিউজিককে সলিল চৌধুরী এমন ভাবে ব্যবহার করে দিয়েছেন যে পঞ্চমদাকে আলাদা কিছু করতেই হত। সেটাই ওই লাতিন আমেরিকান মিউজিক। ‘পুরুষোত্তম’ নামের একটি ছবিতে আমি ব্যাকগ্রাউন্ড করেছিলাম। সেখানে গান গেয়েছিলেন রাহুল দেব বর্মণ। সে-ও এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা!

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE