—প্রতীকী চিত্র।
এক জমিতে এক-এক জনের দাবি এক-এক রকম। তাঁদের ‘রেট চার্ট’ও আলাদা। যেমন, যাঁর ছেলেরা নির্মাণ সামগ্রী সরবরাহ করবেন, তিনি প্রতি বর্গফুটে নেবেন ৩০০ টাকা। বিধি উড়িয়ে বাড়ি তৈরির অনুমোদন পাইয়ে দেওয়া জনপ্রতিনিধি নেবেন প্রতি বর্গফুটে ৫০০ টাকা। সব জেনেও ধরপাকড় না চালিয়ে ‘সহায়তাকারী’কে দিতে হবে প্রতি বর্গফুটে ৩৫০ টাকা! নির্মাণ ব্যবসার সিন্ডিকেট চালানোর এটাই নাকি অ-আ-ক-খ। সিন্ডিকেটে ঢোকার আগে কোন কোন দরজা পেরোতে কত টাকা করে ঢালতে হয়, তা জানাই নাকি প্রথম এবং প্রধান শর্ত।
লোকসভা নির্বাচনের মুখে গার্ডেনরিচে বাড়ি ভেঙে পড়ে ১৩ জনের মৃত্যুর পরে এমন নানা তথ্য সামনে এসেছিল। অভিযোগ, এই হিসাব জানলেই একতলা পর্যন্ত বাড়ি তৈরির অনুমোদন থাকা সত্ত্বেও সহজেই পাঁচতলা নির্মাণ ওঠে। জলাশয় বুজিয়ে তৈরি হয় ছ’তলার চারটি টাওয়ারবিশিষ্ট আবাসন। অভিযোগ, দখল হয় সরকারি রাস্তাও! পুর দফতর সূত্রে জানা যাচ্ছে, নির্বাচন এলে এই হিসাবের পুরোটাই নির্ধারিত হয় ভোটের হাওয়ার নিরিখে। জনপ্রতিনিধির দলের দিকে বেআইনি বাড়ির প্রোমোটার থাকলে হিসাব এক রকম। নয়তো দিতে হয় তিন-চার গুণ বেশি টাকা!
তবে ভুক্তভোগীদের মতে, নির্বাচন এলেই তোলাবাজি, কাটমানি বা সিন্ডিকেট নিয়ে হুঁশিয়ারি দেয় প্রশাসন, বিরোধীরা গলা চড়ান। কিন্তু ভোট মিটলেই শুরু হয় পুরনো ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’। ২০২১ সালে পুর নির্বাচনের আগে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘‘আমার এলাকায় কেউ ঘরবাড়ি করলে সমস্ত কিছু আমার থেকে কিনতে হবে, তা হবে না। কেউ ঘরবাড়ি করলেই আমাকে এত টাকা দেবে, তা-ও হবে না।’’ কিন্তু তার পরেও কি পরিস্থিতি বদলেছে? গার্ডেনরিচ-কাণ্ডের পরে ফের সেই প্রশ্ন উঠেছে।
বাম আমলে ‘ল্যান্ড লুজ়ার কোঅপারেটিভ সোসাইটি’ নামে একটি ছাতার নীচে অসংখ্য বেকার যুবক ইমারতি দ্রব্য সরবরাহের কাজ শুরু করেছিলেন নিউ টাউনে। ২০১১ সালে রাজ্যে পালাবদলের পরে তার জায়গা নেয় ‘সিন্ডিকেট’। দ্রুত ইতিউতি গজিয়ে ওঠে ওই সিন্ডিকেট ব্যবসার ঘর। মহিষবাথানের দিকের এক সিন্ডিকেট-পান্ডা তৎকালীন এক বর্ষীয়ান নেতার জন্য নিজের অফিসে আলাদা চেয়ার পর্যন্ত রেখেছিলেন। যা নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল। অভিযোগ, এই ঘরগুলি থেকেই নির্দেশ যেত, কোন কাজের কী দর উঠবে! এমনকি, ব্যক্তিগত উদ্যোগে করা বাড়ির ঢালাই-পিছু দাদাদের লক্ষ লক্ষ টাকা দেওয়ার আবদারও মেটাতে হত বলে অভিযোগ। সময় যত গড়ায়, বেকার যুবকদের এই ব্যবসা হয়ে দাঁড়ায় ওই এলাকার ক্ষমতার অন্যতম কেন্দ্র। বিধানসভা ভোটে জেতা এক নেতা-দাদার দল ক্রমশ ভারী হতে থাকে। ক্রমে তিনিই হয়ে ওঠেন ওই এলাকায় নির্মাণকাজের শেষ কথা। সিন্ডিকেটের সমর্থনে প্রকাশ্যে গলা ফাটাতেও শোনা যায় তাঁকে। ওই নেতা-দাদার নির্দেশে তাঁর সিন্ডিকেট বাহিনীকে একের পর এক নির্বাচন ‘পরিচালনা’ করতেও দেখা গিয়েছে।
খোঁজ করে জানা গেল, বিধাননগর, নিউ টাউন জুড়ে এখন আইনি নকশার বদলে পুরনো বাতিল নকশার উপরেই বহুতল তৈরির কাজ চলছে। কিন্তু এমন সব বহুতলের ফ্ল্যাট মিউটেশন হবে না কোনও দিনই। পুর ও নগরোন্নয়ন দফতর নির্ধারিত মূল্যের বিনিময়ে বাড়ি বিক্রির অধিকার অনুমোদনের পরে সল্টলেকেও দেদার প্রোমোটিং শুরু হয়েছে বলে অভিযোগ। বিধাননগর পুর এলাকায় গত কয়েক বছর ধরে দু’ধরনের সিন্ডিকেট বেশি সক্রিয়— প্রথমটি পুরনো বাড়ি ভাঙার। সেটির পান্ডারা ‘ভাঙাইওয়ালা’ বলে পরিচিত। এই সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করেন তিন জন। তাঁদের মাথার উপরে রয়েছেন সল্টলেক ও লেক টাউন এলাকার দুই প্রভাবশালী নেতা। দ্বিতীয়টি নির্মাণ সামগ্রী সরবরাহের সিন্ডিকেট। একই চিত্র দমদম এবং হাওড়াতেও। অভিযোগ, দমদমে ইমারতি দ্রব্য সরবরাহকারীদের সঙ্গে দু’ভাবে সমঝোতা চলে— হয় সিন্ডিকেটের থেকে নির্মাণ সামগ্রী নিতে হবে, নয়তো তাঁদের দিতে হবে নির্দিষ্ট অঙ্কের ‘প্রণামী’।
এই বেআইনি নির্মাণই শহরের জলের আকালের জন্য দায়ী বলে দাবি করছেন অনেকেই। কলকাতা পুরসভার ৫৯ নম্বর ওয়ার্ডের এক বাসিন্দার মন্তব্য, “ধরুন, একতলা বাড়িতে পাঁচ ঘর বাসিন্দা ছিলেন। প্রতি ঘরে গড়ে চার জন করে মোট ২০ জন। এখন সেই বাড়িই রাতারাতি পাঁচতলা হয়ে যাচ্ছে। বাসিন্দার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ৬০। কিন্তু বেআইনি নির্মাণ হওয়ায় এত জনের পর্যাপ্ত জল নেই।’’ এর পরে তাঁর দাবি, “প্রোমোটার জলের নয়া সংযোগ নেওয়ার টাকা খরচ করছেন না। বেআইনি বহুতলে যাঁরা ফ্ল্যাট কিনে আসছেন, তাঁরা পুরসভার দাদাদের ধরে রাস্তার জলের পাইপ থেকেই পাম্প লাগিয়ে জল টেনে নিচ্ছেন। ফলে জলের গতি গোটা পাড়াতেই গিয়ে পৌঁছচ্ছে তলানিতে।’’ শহরের প্রোমোটার মহল সূত্রের খবর, বেআইনি নির্মাণ হওয়ায় এই ধরনের বহুতলে জলের নতুন সংযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। ‘টেবিলের তলা দিয়ে’ কাজ করাতে বাড়ি-পিছু গুনতে হয় অন্তত এক লক্ষ টাকা। এ ক্ষেত্রেও কাছের লোক বা বিরোধী দলের লোক— ইত্যাদি বিভাজন আছে। দাদার মর্জির উপরেই ঠিক হয় টাকার হিসাব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy