বাঁশুরী স্বরাজ। — নিজস্ব চিত্র।
প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, আসল চ্যালেঞ্জ মা!
সুষমা স্বরাজের ভাবমূর্তির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে স্বকীয়তা প্রমাণে দিনরাত এক করে ফেলছেন নয়াদিল্লি আসনের বিজেপি প্রার্থী তথা সুষমার মেয়ে বাঁশুরী স্বরাজ। বিজেপিতে সদ্য যোগদান করেও যিনি লোকসভা নির্বাচনের টিকিট পেয়েছেন নয়াদিল্লি কেন্দ্র থেকে। যেখান থেকে এক সময়ে জিতে এসেছেন অটলবিহারী বাজপেয়ী, লালকৃষ্ণ আডবাণীর মতো শীর্ষ বিজেপি নেতারা। যে দুর্গ রক্ষার এখন দায়িত্ব পড়েছে সুষমার আইনজীবী কন্যা বাঁশুরীর।
মা ছিলেন কৃষ্ণের উপাসক। বাবা সঙ্গীতপ্রিয়। চেয়েছিলেন মেয়ের নাম রাখা হোক কোনও বাদ্যযন্ত্রের নামে। তাই কৃষ্ণের সর্বক্ষণের সঙ্গী বাঁশুরীকে মেয়ের নাম হিসেবে বেছে নেন স্বরাজ দম্পতি। বিদেশ থেকে প্রথমে ইংরেজি সাহিত্য ও পরে আইন নিয়ে পড়া শেষ করে ভারতে ফিরে, ২০০৭ সাল থেকে মায়ের মতো সুপ্রিম কোর্টে ওকালতি শুরু করেন বাঁশুরী। পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর মামলাই হোক বা কামদুনি কাণ্ডের পুনর্বিবেচনার আর্জি—সুপ্রিম কোর্টে বিভিন্ন সময়ে ওকালতি করতে দেখা গিয়েছে তাঁকে। ২০২৩ সালে দলের আইনি শাখার সহ-আহ্বায়ক হিসাবে বাঁশুরীকে বেছে নেয় বিজেপি। পরবর্তী ধাপে তাঁকে লোকসভার টিকিট দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় দল। যদিও তিনি কেন ললিত মোদীর হয়ে আদালতে সওয়াল করেছিলেন, কেন মণিপুর কাণ্ডে সরকারের হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, সেই প্রশ্ন তুলেছেন বিরোধীরা।
ভোট মরসুমে অধিকাংশ নেতাই যখন শোভাযাত্রা, রাজনৈতিক সভায় বক্তৃতা দিতে পছন্দ করেন, তখন বাঁশুরী অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ ছোট ছোট গোষ্ঠীর সঙ্গে আলাদা করে কথা বলায়। মা সুষমা যেমন আমজনতার সঙ্গে ব্যক্তিগত স্তরে সংযোগ রক্ষা করে চলতেন, মেয়েও তেমনই ব্যক্তিগত সম্পর্ক তৈরিতে অগ্রাধিকার দিয়েছেন বলে জানালেন তাঁর সঙ্গে দৌড়ে বেড়ানো আশিস। সেই কারণে বাঁশুরী কখনও পৌঁছে যাচ্ছেন করোলবাগের সোনার ব্যবসায়ীদের কাছে, কথা বলছেন আর কে পুরমে তামিল জনগোষ্ঠী বা রাজেন্দ্র নগরের সিন্ধ্রি সমাজের সঙ্গে। মায়ের সঙ্গে তুলনা প্রসঙ্গে বাঁশুরীর বক্তব্য, ‘‘জানি সব ক্ষেত্রেই মায়ের সঙ্গে তুলনা হবে। তবে আমি আমার মতো করে এগোতে চাইছি।’’
বুধবার সকাল পৌনে এগারোটা নাগাদ বাঁশুরীর গাড়ি যখন গ্রেটার কৈলাস-১ মার্কেটে এসে থামল, তখন সবে দোকান খুলছে। তাতেই হইহই করে দোকানে দোকানে ঢুকে প্রচার শুরু করে দেন বাঁশুরী। বয়সে বড় হলেই সটান পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম। সঙ্গে অনুরোধ, ‘‘মায়ের মতো আমাকেও আপনাদের সেবা করার সুযোগ দিন।’’ বললেন, ‘‘ছোট বেলায় সময় পেলেই বন্ধুদের সঙ্গে এখানে খেতে আসতাম।’’
ওই বাজারে তিন পুরুষের শাড়ির ব্যবসায়ী ওমপ্রকাশ শর্মা। বাঁশুরী চলে যাওয়ার পরে দোকানে রাখা পুতুল সাজাতে সাজাতে শর্মা বলেন, ‘‘নোটবাতিল ও জিএসটির ফলে ব্যবসায় মন্দা এসেছিল। এর পরে করোনার ধাক্কা। ফলে গত কয়েক বছর খুব খারাপ গিয়েছে। কিন্তু অন্য দিকে, গত দশ বছরের দিল্লির বিভিন্ন বাজারে পার্কিং-এর সুব্যবস্থা হয়েছে। যার ফলে দূরদরান্ত থেকে ক্রেতা আসছেন। ফলে ব্যবসা বাড়ছে। আমরা এতেই খুশি।’’ তবে ক্ষোভ যে একেবারে নেই তা নয়। পার্কিং যা বেড়েছে তার চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। বিদ্যুৎ বিভ্রাট এখনও বড় সমস্যা। রয়েছে ‘পুলিশি উপদ্রব’। হাসিমুখে সব শুনে সমস্যার সমাধানে আশ্বাস দিয়ে গাড়িতে উঠে পড়েন বাঁশুরী।
নয়াদিল্লির ব্যবসায়ী সমাজ, উচ্চবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্তের ভোট ঢালাও ভাবে বাঁশুরী যে পাবেন সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু ছেড়ে কথা বলবেন না নয়াদিল্লি কেন্দ্রের ‘ইন্ডিয়া’র প্রার্থী, আম আদমি পার্টির সোমনাথ ভারতী। বাঁশুরীর কাছে চিন্তার হল, নয়াদিল্লি লোকসভা কেন্দ্রের অধীনে দশটি বিধানসভাতেই জিতেছে আপ। কেজরীওয়াল জামিন পাওয়ায় উজ্জীবিত সেই বিধায়কেরা। দলীয় প্রার্থীকে জেতাতে তাঁরা মরিয়া। উপরন্তু সোমনাথ নিজে মালব্য নগরের বিধায়ক। ফলে লড়াই যে সেয়ানে সেয়ানে, তা মেনে নিচ্ছেন খোদ বিজেপি নেতৃত্ব।
উপরন্তু গত দশ বছর নয়াদিল্লি কেন্দ্রের সাংসদ বিজেপি নেত্রী মীনাক্ষী লেখির বিরুদ্ধে হাওয়া ছিল প্রবল। যে কারণে তাঁকে বসিয়ে দেয় দল। তা হলেও, লেখি তথা বিজেপির বিরুদ্ধে হাওয়ার সঙ্গে লড়তে হচ্ছে বাঁশুরীকে। বিশেষ করে বিনামূল্যে জল, বিদ্যুতের বিলের দু’শো ইউনিট ফ্রি করে দেওয়া, মহিলাদের নিখরচায় বাসে যাতায়াতের সুযোগ, মহল্লা ক্লিনিকের ফায়দা—গত দশ বছর ধরে টানা ওই সুবিধা পাওয়ায় কেজরীওয়ালের যে নিজস্ব ভোটব্যাঙ্ক তৈরি হয়েছে তা বিজেপির কাছে যথেষ্ট চিন্তার কারণ। উপরন্তু, ‘ইন্ডিয়া’র শরিক হিসেবে ওই কেন্দ্রের কংগ্রেসের ভোটও ভারতীর পাওয়ার কথা। স্থানীয় আপ নেতা রাঘবেন্দ্র কুমারের মতে, ‘‘ওই কেন্দ্রে ২০০৪ ও ২০০৯ সালে কংগ্রেসের অজয় মাকেন জিতেছিলেন। ফলে কংগ্রেসের চিরাচরিত ভোটব্যাঙ্ক রয়েছে। আপ ও কংগ্রেসের ভোটব্যাঙ্ক একজোট হলে বাঁশুরীর জেতা বেশ কঠিন।’’
মা সুষমা এক সময়ে দক্ষিণ দিল্লির সাংসদ ছিলেন। পরবর্তী ধাপে দিল্লির প্রথম মহিলা মুখ্যমন্ত্রী হন সুষমা। যদিও তা কয়েক মাসের জন্য। রাজনীতির অনেকের মতে, পেঁয়াজের দামবৃদ্ধিতে সে সময়ে কুর্সি হারাতে হয়েছিল সুষমাকে। তার পরে আর দিল্লি থেকে কোনও দিন নির্বাচনী লড়াইয়ে নামেননি সুষমা। প্রায় আড়াই দশক পরে ফের মেয়ে দিল্লিতে লড়াইয়ে নেমেছেন।
মা সুষমা পরবর্তী সময়ে বিদিশা থেকে লড়তেন বলে এ বার প্রচারের শুরুতেই সুষমা-কন্যাকে ‘বহিরাগত’ বলে দাগিয়ে দিতে চেয়েছিলেন বিরোধীরা। জবাবে বাঁশুরী বলেছিলেন, ‘‘আমার জন্ম-কর্ম সবই তো দিল্লিতে। আমি আবার বহিরাগত হলাম কবে? আমি তো দিল্লির কুড়ী (মেয়ে)।’’
তবে দিল্লির ‘কুড়ী’ কি পারবেন ঝাড়ুকে সামলাতে? প্রশ্ন সেটাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy