(বাঁ দিক থেকে) অর্জুন সিংহ, শান্তনু সেন, সায়ন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুনীল মণ্ডল, মৌসম নুর। —ফাইল চিত্র।
কেউ কান্নাকাটি করেছেন। কেউ যোগ দিয়ে দিয়েছেন অন্য দলে। ব্রিগেডের পরেই টিকিট না পাওয়ায় ক্ষোভের কথা জানাতে শুরু করেছিলেন অর্জুন সিংহ। তিনি ফের বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। তার পর একে একে শান্তনু সেন, সুনীল মণ্ডল, সায়ন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায়রা তাঁদের ক্ষোভ, অভিমান, অসন্তোষের কথা প্রকাশ্যে জানিয়েছেন। যে তালিকায় বৃহস্পতিবার নবতম সংযোজন রাজ্যসভার সাংসদ মৌসম বেনজ়ির নুর। তবে অর্জুন ছাড়া বাকি চার জনই বলেছেন, তাঁরা ভেবেছিলেন প্রার্থী হবেন। কিন্তু এখন দলের ‘অনুগত সৈনিক’ হিসাবেই কাজ করবেন।
কিন্তু ওই পাঁচ জনকে কেন টিকিট দিল না তৃণমূল? শাসকদলের শীর্ষ নেতৃত্বের এঁদের সম্পর্কে মূল্যায়ন কী ছিল?
অর্জুন সিংহ
২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের আগে তৃণমূলের টিকিট না পেয়ে বিজেপিতে গিয়েছিলেন ব্যারাকপুরের এই নেতা। পদ্মশিবির তাঁকে প্রার্থী করেছিল। দীনেশ ত্রিবেদীকে হারিয়ে অর্জুন জিতেওছিলেন। কিন্তু সেই অর্জুনই ২০২২ সালে ফিরেছিলেন তৃণমূলে। তার পর শাসকদলে ছিলেন বটে। তবে তৃণমূল নেতৃত্ব ঘরোয়া আলোচনায় বলছেন, তাঁর সঙ্গে বিজেপির নিত্য যোগাযোগ ছিল বলে তাঁদের কাছে খবর ছিল। অর্জুন ঘনিষ্ঠমহলে বারেবারেই বলে এসেছেন, তৃণমূলের টিকিট পাওয়ার বিষয়ে ‘নিশ্চয়তা’ পেয়েই তিনি বিজেপি ছেড়েছিলেন। আবার তৃণমূলে খোঁজ নিলে জানা যাচ্ছে, এমন কোনও ‘নিশ্চয়তা’ অর্জুনকে দেওয়া হয়নি। বরং দলীয় নেতৃত্ব মনে করছিলেন, তৃণমূলের টিকিটে জিতলেও ভোটের ছ’মাসের মধ্যে অর্জুন আবার বিজেপিতে ফিরে যেতে পারেন। যে ভাবে তিনি বিজেপি থেকে তৃণমূলে এসেছিলেন।
দ্বিতীয়ত, ব্যারাকপুর এমনিতেই তৃণমূলের ‘হারা’ আসন। এ বার সেই আসন পুনরুদ্ধারে দলের ‘আস্থাভাজন’ কাউকেই প্রার্থী করার ভাবনা ছিল তৃণমূলের। সে কারণেই ‘পরীক্ষিত’ এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ঘনিষ্ঠ’ বলে পরিচিত মন্ত্রী পার্থ ভৌমিককে টিকিট দেওয়া হয়েছে। জিতলে তৃণমূলের ‘লাভ’। হারলে ‘লোকসান’ নেই। তা ছাড়া, অর্জুনকে ঘিরে দলের মধ্যেও ক্ষোভ ছিল। সোমনাথ শ্যাম, সুবোধ অধিকারীর মতো বিধায়কেরা যে ভাবে অর্জুন-বিরোধিতাকে গত কয়েক মাস ধরে রুটিনে পরিণত করেছিলেন এবং তাঁর প্রার্থিপদের বিরোধিতা করে দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিঠি লিখেছিলেন, তাতে অর্জুনকে প্রার্থী করা হলে শাসকদলের মধ্যে অন্তর্ঘাতের আশঙ্কাও ছিল।
শান্তনু সেন
লোকসভায় প্রার্থী হতে না পেরে শান্তনু বেশ দুঃখিত বলেই তৃণমূলের অন্দরে সকলে জানেন। তিনি প্রকাশ্যে ততটা ভেঙে না-পড়লেও লোকসভায় যে মনোনয়ন চেয়েছিলেন, তা খোলাখুলিই জানিয়েছেন। কিন্তু তাঁকে কেন লোকসভার টিকিট দিল না দল? দলের একাংশের ব্যাখ্যা: সদ্য রাজ্যসভার সাংসদ পদে শান্তনুর মেয়াদ ফুরিয়েছে। তাই তাঁকে এখনই লোকসভায় প্রার্থী করতে চায়নি তৃণমূল। নেপথ্যে আরও বিবিধ কারণের কথা শোনা যাচ্ছে শাসকদল সূত্রে। এক, শান্তনু কাউন্সিলর থাকাকালীন তাঁর এলাকার বাসিন্দা এক প্রভাবশালী গায়ক তাঁর নামে মমতার কাছে অভিযোগ জানিয়েছিলেন। যদিও শান্তনু এবং তাঁর হিতৈষীরা তা মানতে চাননি। শান্তনু এখন আর কাউন্সিলর নন। তবে তাঁর স্ত্রী কাকলি সেন ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। দলের একাংশের বক্তব্য, তাঁকে নিয়েও নাকি কিছু অভিযোগ দলের সর্বোচ্চ স্তরে জমা পড়েছে। একটি চ্যানেলের বিতর্কে সিপিএমের মুখপাত্র কৌস্তভ চট্টোপাধ্যায়ের মন্তব্যের মুখে মেজাজ হারিয়ে মাইক্রোফোন খুলে স্টুডিয়ো ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন শান্তনু। যা মুখপাত্রের কাছে কাম্য নয় বলেই অভিমত দলের অনেকের। তবে শান্তনু এখনও শাসকদলের অন্যতম মুখপাত্র।
তবে তৃণমূল সূত্রে জানা যাচ্ছে, লোকসভায় টিকিট না পেয়ে শান্তনু আপাতত বরাহনগর বিধানসভার উপনির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার কথা চিন্তাভাবনা করছেন। তাপস রায়ের ইস্তফার কারণে ওই আসনে উপনির্বাচন হবে ১ জুন। যদিও প্রকাশ্যে শান্তনু এমন দাবি কোথাও করেননি। তবে তৃণমূল সূত্রের খবর, বরাহনগরের স্থানীয় নেতৃত্ব শান্তনুকে নিয়ে তত ‘উৎসাহী’ নন।
সায়ন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায়
এই অভিনেত্রীকে গত বিধানসভা ভোটে বাঁকুড়া বিধানসভায় টিকিট দিয়েছিল তৃণমূল। কিন্তু তাঁকে পরাস্ত হতে হয়েছিল। তার পরেও অবশ্য সায়ন্তিকা ধারাবাহিক ভাবে বাঁকুড়ায় যেতেন, সভাসমিতি করতেন। অর্থাৎ, তিনি বাঁকুড়ার মাটি কামড়ে পড়েছিলেন। বিধানসভায় হারলেও একাধিক সরকারি সংস্থার বিভিন্ন পদে তিনি ছিলেন। সে সব কারণেই সায়ন্তিকার এবং শাসকদলের একাংশে এমন ধারণা হয়েছিল যে, তাঁকে দল লোকসভায় টিকিট দেবে বাঁকুড়া কেন্দ্র থেকে। কিন্তু তৃণমূলের প্রথম সারির নেতাদের মধ্যে একাংশের দাবি, লোকসভায় প্রার্থী করার বিষয়ে সায়ন্তিকার নাম সে ভাবে বিবেচনার মধ্যে ছিল না। ব্রিগেডের ‘জনগর্জন’ সভার মঞ্চে ছিলেন সায়ন্তিকা। প্রার্থীদের নাম ঘোষণার পরেই তিনি বেরিয়ে যান। পরে অবশ্য তিনি বলেন, অসুস্থ লাগছিল বলে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গিয়েছিলেন। প্রার্থী হতে না পেরে সংবাদমাধ্যমকে নিজের অভিমানের কথা বলে ফেলেছিলেন। তার পর অবশ্য বলেছেন, দলে রয়েছেন, দলেই থাকবেন।
অন্য দিকে, তৃণমূল সূত্রের খবর, বাঁকুড়া কেন্দ্রে প্রাথমিক ভাবে প্রার্থী করার বিষয়ে এক কৃতী চিকিৎসকের কথা ভাবা হয়েছিল। মাস দেড়েক আগে মমতার বাঁকুড়া সফরের সময়ে সেই চিকিৎসকের সঙ্গে মুখোমুখি তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেত্রীর সাক্ষাতেরও কথা হয়েছিল। কিন্তু সেই চিকিৎসক তৃণমূলকে জানান, তিনি মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে পারেন। কিন্তু ভোটে লড়বেন না। শেষ পর্যন্ত সেই চিকিৎসকের সঙ্গে মমতার সাক্ষাৎ হয়নি। সেই অবস্থানে দাঁড়িয়েই তালড্যাংরার বিধায়ক অরূপ চক্রবর্তীর নাম চূড়ান্ত করেন তৃণমূল নেতৃত্ব।
সুনীল মণ্ডল
বর্ধমান পূর্ব আসনে গত লোকসভায় তৃণমূলের টিকিটে জিতেছিলেন সুনীল মণ্ডল। কিন্তু শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন সুনীল। তার পর আবার তিনি তৃণমূলে ফিরে গিয়েছিলেন। তবে ‘নিজ উদ্যোগে’। সুনীলকে কখনও তৃণমূল আনুষ্ঠানিক ভাবে ফেরায়নি। তবে তিনি ‘ভুল বুঝতে পেরে’ সংসদে তৃণমূলের ধর্না, অবস্থানে থাকতে শুরু করেন ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের কয়েক মাস পর থেকেই। হয়তো ভেবেছিলেন টিকিট পাবেন। না পেয়ে তাঁর মনও খারাপ হয়েছিল। কিন্তু তৃণমূল তাঁকে খরচের খাতাতে ফেলে দিয়েছিল অনেক আগেই।
মৌসম বেনজ়ির নুর
গত লোকসভার ভোটের কয়েক মাস আগে কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দিয়েছিলেন মৌসম। তাঁকে তৃণমূল প্রার্থী করে মালদহ উত্তর কেন্দ্রে। কিন্তু বিজেপির খগেন মুর্মুর কাছে হারতে হয়েছিল মৌসমকে। মৌসমের বিরুদ্ধে কংগ্রেসের প্রার্থী ছিলেন তাঁর মামাতো ভাই ইশা খান চৌধুরী। মৌসমের বক্তব্য, মূলত ভোট কাটাকাটির কারণেই হারতে হয়েছিল তাঁকে। কিন্তু হেরে গেলেও মৌসমকে ‘পুনর্বাসন’ দিয়েছে তৃণমূল। তাঁকে রাজ্যসভায় সাংসদ করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু তাঁকে আবার লোকসভায় প্রার্থী করেনি দল। যদিও মৌসম জানিয়েছেন, তিনি বিজেপিকে হারানোর বিষয়ে প্রত্যয়ী ছিলেন।
দল অবশ্য মনে করছে, মৌসম এখনই রাজ্যসভার সাংসদ। রাজনীতির অলিখিত নিয়ম হল, পরাজিত প্রার্থীকে আবার দাঁড় না-করানো উচিত। দ্বিতীয়ত, মালদহে এখন গনি খানের ‘গড়’ ক্ষয়িষ্ণু। গনির মৃত্যুর পরে ১৮ বছর কেটে গিয়েছে। তরুণ প্রজন্মের কাছে গনি পরিবারের সদস্যদের সেই ‘আবেদন’ আর নেই। ফলে গনির ভাগ্নি মৌসম পরিবারের নামে ভোট টানবেন, এমন আশা কম। টানতে পারলেও ইশা এ বারেও প্রার্থী হলে গত বারের ভোট কাটাকাটির পুনরাবৃত্তি হওয়ার সম্ভাবনাও রয়ে যাচ্ছে। ফলে সব দিক ভেবেচিন্তেই প্রাক্তন আইপিএস প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়কে সেখানে টিকিট দিয়েছে তৃণমূল। ঘটনাচক্রে, প্রসূন নিজে ‘উৎসাহী’ ছিলেন বালুরঘাট কেন্দ্রটি নিয়ে। বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারকে হারানোর বিষয়ে আশাবাদীও ছিলেন। কিন্তু তৃণমূল নেতৃত্ব মনে করেছেন, বালুরঘাটে ‘স্থানীয়’ প্রার্থী দেওয়া উচিত। তা হলে আসনটি পুনরুদ্ধার করা যাবে। সে কারণেই বিপ্লব মিত্রকে সেখানে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। প্রসূন একদা কর্মসূত্রে মালদহ রেঞ্জের ডিআইজি ছিলেন। ফলে ওই জেলা তাঁর চেনা। সেই অঙ্কেই এগিয়েছেন মমতা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy