মেদিনীপুর ছাড়তে হতে পারে ‘ভূমিপুত্র’ দিলীপ ঘোষকে। — ফাইল চিত্র।
তৃণমূলের কাছে নয়, দলের অন্দরের লড়াইতেই ভোটের আগে হেরে যেতে হচ্ছে দিলীপ ঘোষকে। শেষমুহূর্তে পরিকল্পনায় ‘নাটকীয়’ কিছু না-ঘটলে মেদিনীপুর লোকসভা আসনে দ্বিতীয় বার লড়ার সুযোগই পাচ্ছেন না তিনি! বিজেপি সূত্রে জানা গিয়েছে, মেদিনীপুর আসনের প্রার্থী হিসাবে প্রাক্তন আইপিএস ভারতী ঘোষের নাম আপাতত আনুষ্ঠানিক ঘোষণার অপেক্ষায়। ‘নিমরাজি’ দিলীপকে অন্য আসন থেকে লড়ানোর সিদ্ধান্তও বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব চূড়ান্ত করে নিয়েছেন বলেও জানা গিয়েছে। সেটা বাস্তবায়িত হলে দিলীপকে প্রার্থী করার কথা বর্ধমান-দুর্গাপুর আসন থেকে। সে ক্ষেত্রে সুতোয় ঝুলছে প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুরেন্দ্র সিংহ অহলুওয়ালিয়ার ভাগ্য। তাঁকে আদৌ প্রার্থী করা হবে, না কি অন্য কোনও আসন দেওয়া হবে, তা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। তবে বিজেপি সুত্রে জানা গিয়েছে বৃহস্পতি- শুক্রবারের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে।
২০১৯ সালে প্রথম বার লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থী হয়েই তৎকালীন রাজ্য বিজেপির সভাপতি লড়েছিলেন মেদিনীপুরে। তৃণমূলের মানস ভুঁইয়াকে তিনি হারিয়েছিলেন প্রায় ৮৯ হাজার ভোটে। অন্য দিকে, বর্ধমান-দুর্গাপুর আসনে বিজেপি জয় পেলেও অহলুওয়ালিয়া তৃণমূলের মমতাজ সঙ্ঘমিত্রাকে হারিয়েছিলেন মাত্র ২,৪৩৯ ভোটে। সেই হিসাবে বিজেপির কাছে ওই আসন মেদিনীপুরের তুলনায় ‘কঠিন’। ফলে এখন যা পরিস্থিতি, তাতে ‘চেনা এবং সহজ’ মাঠের বদলে ‘কঠিন এবং অচেনা’ মাঠেই নামতে হবে রাজ্য বিজেপির ইতিহাসে অদ্যাবধি ‘সফল’ সভাপতি দিলীপকে। গত লোকসভা নির্বাচনে তাঁর নেতৃত্বেই মেদিনীপুর-সহ ১৮ আসনে জিতেছিল বিজেপি। তার আগে বাংলায় দলের সাংসদ সংখ্যা ছিল মাত্র দুই!
কিন্তু দিলীপ কি মেনে নেবেন? কয়েক দিন আগে পর্যন্ত তাঁর অনুগামীরা বলছিলেন, এমনটা হলে ভোটেই লড়বেন না দিলীপ। তবে এখন তাঁরাই অন্য কথা বলছেন। ‘দিলীপ-ঘনিষ্ঠ’ হিসাবে পরিচিত রাজ্য বিজেপির এক নেতা বলেন, ‘‘দিলীপদা মনে করেন ব্যক্তির থেকে সংগঠন বড়। তার থেকেও বড় রাষ্ট্র। এমন নীতিতে বিশ্বাস করা দিলীপদা নিশ্চয়ই দলের সিদ্ধান্ত মেনে নেবেন। এখনও দুই আসনেরই প্রার্থীর নাম ঘোষণা হয়নি। তবে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব দিলীপদাকে যে আসনেই পাঠাক, তিনি লড়বেন এবং জিতবেন।’’
জানা গিয়েছে, গত কয়েক দিন ধরেই দিলীপ তাঁর আসন পরিবর্তনের জল্পনা নিয়ে দলের ভিতরে উষ্মাপ্রকাশ করছিলেন। ভোট লড়তে হলে সেটা শুধু মেদিনীপুর থেকেই— এমন জেদও ধরে ছিলেন। কিন্তু এখন নাকি দিলীপ অনেকটাই ‘নমনীয়’ হয়েছেন। তাঁকে মেদিনীপুর না দেওয়া এবং বর্ধমান-দুর্গাপুর আসনে দেওয়ার পিছনে দলের যে যুক্তি, তা মেনে নিয়েছেন বলেই জানা গিয়েছে। ফলে একেবারে শেষবেলায় নাটকীয় কোনও বদল না হলে দিলীপের আসনবদল এক রকম পাকা বলেই বিজেপি সূত্রে জানা গিয়েছে।
দিলীপকে কেন মেদিনীপুর আসন দেওয়া যাবে না, তা নিয়ে দলের অন্দরে অনেক যুক্তি ছিল। প্রথম যুক্তি হিসাবে বলা হয়, কেন্দ্রীয় বিজেপির পক্ষে বাংলায় যে সমীক্ষা করা হয়েছে, তাতে মেদিনীপুরে দিলীপের জয়ের সম্ভাবনা কম। তবে সেই সমীক্ষা ঠিক নয় বলেই দাবি ছিল দিলীপ গোষ্ঠীর। স্বয়ং দিলীপও ওই আসনে জয় নিয়ে নিশ্চিত বলেই জানান। গত এক বছর তিনি টানা ওই আসনে জনসংযোগের কাজ চালিয়ে গিয়েছেন। প্রায় সব গ্রামে গিয়েছেন।
তবে বিজেপির কাছে আরও একটি ‘বাধ্যবাধকতা’ ছিল। ২০১৯ সালে ঘাটাল লোকসভা আসন থেকে তৃণমূলের অভিনেতা-প্রার্থী দেবের কাছে হেরেছিলেন ভারতী। ২০১৪ সাল থেকেই দেব ওই আসনে জয়ী হচ্ছেন। এ বার তিনি প্রার্থী হবেন না বলেই প্রথমে জানিয়েছিলেন। পরে তৃণমূল তাঁকেই প্রার্থী করলে বিজেপিকে অঙ্ক বদলাতে হয়। ২০১৪ সালে ওই আসনে চার নম্বরে থাকা বিজেপি ২০১৯ সালে দু’নম্বরে উঠে এলেও পরাজয়ের ব্যবধান ছিল প্রায় ১ লাখ ৮ হাজার ভোট। এ বার দেবের বিরুদ্ধে শক্তিশালী লড়াই দিতে বিজেপি অভিনেতার পাল্টা অভিনেতাকেই প্রার্থী করেছে। খড়্গপুর সদর বিধানসভার বিধায়ক হিরণ চট্টোপাধ্যায় প্রার্থী হওয়ার পরেই ঠিক হয়, গত বার ঘাটালে অনেকটা লড়াই দেওয়া এবং অধুনা বিজেপির জাতীয় মুখপাত্র ভারতীকে মেদিনীপুরে প্রার্থী করা হবে। কিন্তু মেদিনীপুরে স্বয়ং দিলীপের জয়ের সম্ভাবনা কম হলে সেটা তো ভারতীর ক্ষেত্রে আরও সত্যি? এমন প্রশ্নও ওঠে বিজেপিতে। তবে সর্বশেষ যে যুক্তি দেওয়া হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, তৃণমূল মেদিনীপুরে এক জন মহিলাকে প্রার্থী করেছে। তাই মহিলা ভারতীই বিপক্ষের মহিলা জুন মালিয়ার বিরুদ্ধে ভাল লড়াই দিতে পারবেন।
অন্য দিকে, দিলীপকে বর্ধমান-দুর্গাপুর আসনে প্রার্থী করার পিছনে যে যুক্তি দেওয়া হচ্ছে, তা হল—তৃণমূলের প্রার্থী কীর্তি আজাদের মোকাবিলা করার জন্য দিলীপের মতো ‘জনপ্রিয়’ কোনও প্রার্থী দরকার। ভারতীয় ক্রিকেট দলের প্রাক্তন অলরাউন্ডার তথা ১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্য কীর্তির ‘রাজনৈতিক কীর্তি’ও অনেক। ১৯৯৯, ২০০৯ এবং ২০১৪ সালে বিজেপির টিকিটে বিহারের দ্বারভাঙ্গা আসন থেকে জয়ী হন রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ভগবত ঝা আজাদের পুত্র কীর্তি। কিন্তু ২০১৫ সালে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি সম্পর্কে কিছু মন্তব্যের জন্য বিজেপি তাঁকে বহিষ্কার করে। ২০১৯ সালে কংগ্রেসের টিকিটে তিনি ধানবাদ আসন থেকে লড়ে বিজেপির কাছেই পরাজিত হন। এর পরে তৃণমূলে যোগদান, গোয়ার দায়িত্বপ্রাপ্তি এবং বর্ধমান-দুর্গাপুর আসনে ঘাসফুলের প্রার্থী।
বিজেপি কীর্তিকে কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বী মনে না করলেও দিলীপকেই সেই লড়াইয়ে চায়। কিন্তু সেটা হলে অহলুওয়ালিয়ার কী হবে? ২০১৪ সালে দার্জিলিং থেকে জিতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হওয়া বাংলার একমাত্র শিখ সাংসদকে কি ফের লোকসভায় পাঠাতে চায় না বিজেপি? না কি তাঁর আসন বদলে যাবে? তবে অহলুওয়ালির আসন বদল ২০১৯ সালেই হয়েছিল। সে বার অবশ্য তিনি নিজেই দার্জিলিঙের পাহাড় থেকে সমতলে নামতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এ বার? তাঁকে আসানসোল থেকে প্রার্থী করা হতে পারে বলে রাজ্য বিজেপির কোনও কোনও মহলে আলোচনা হলেও নিশ্চিত করে এখনও কিছু বলা যাচ্ছে না। কারণ, ওই আসনে তৃণমূলের শত্রুঘ্ন সিন্হার বিরুদ্ধে কোনও ‘তারকা’ প্রার্থীকে চাইছে বিজেপি। প্রথমে ভোজপুরি সঙ্গীতশিল্পী পবন সিংহের নামও ঘোষণা করা হয়েছিল। তিনি সরে দাঁড়ানোর পরে অন্য তারকার খোঁজ চলছে। ফলে দিলীপের মতোই অহলুওয়ালিয়ারও ‘জেতা’ আসন মিলবে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy