গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
শাল-মহুলের ভরা জঙ্গল। মাঝে মাঝে কেন্দুপাতাও। আর আছে সাবুইঘাসের চাষ। এমনতরো ঝাড়গ্রামের এক প্রান্তে কংসাবতী আর অন্য প্রান্তে সুবর্ণরেখা নদী। আবার চিল্কিগড়ের কাছে তিরিতিরি বয়ে যাওয়া ডুলুং নদী। শুনতে বা দেখতে এমন ‘রোম্যান্টিক’ হলেও জীবন এখানে বড় কঠিন। আরও কঠিন এখানকার নির্বাচনের হাল-হকিকত বোঝা। এই তো ২০১৪ সালে দীর্ঘ দিন বামেদের হাতে-থাকা ঝাড়গ্রাম প্রায় পৌনে চার লাখ ভোটে জিতেছিল তৃণমূল। কিন্তু তার পাঁচ বছর পরে সেই আসন কম ব্যবধানে হলেও জিতে নিয়েছিল বিজেপি। সেই ভোটে এখানকার পাঁচটি বিধানসভায় জয় পেলেও বিজেপি আবার ২০২১ সালে নীলবাড়ির লড়াইয়ে সাতের মধ্যে সাতটিতেই হেরেছে। ঋতু পরিবর্তনে জঙ্গলের গাছগাছালির মতোই রং বদলায় জঙ্গলমহলের এই কেন্দ্র।
গত বার বিজেপির কুনার হেমব্রম জিতেছিলেন ১১ হাজারের বেশি ভোটে। সেই কুনার আবার গত রবিবার থেকে তৃণমূলের নেতা। পঞ্চম দফার ভোটগ্রহণের আগের দিন পদ্ম ছেড়ে ঘাসফুলকে আপন করে নিয়েছেন গত পাঁচ বছরের সাংসদ। এ বার বিজেপি তাঁকে টিকিট দেয়নি। দল যে এমন সিদ্ধান্ত নেবে, সেটা আন্দাজ করে বুদ্ধিমান কুনার আগে থেকেই রাজনীতি ছাড়ার কথা ঘোষণা করে রেখেছিলেন। কিন্তু শেষবেলায় যে তাঁর রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন হবে এবং একেবারে প্রধান প্রতিপক্ষ শিবিরে যোগ দেবেন, সেটা আর কে আন্দাজ করেছিল! তবে তৃণমূলের প্রার্থী হিসাবে কালীপদ সোরেনের নাম ঘোষণা হওয়ার পর প্রকাশ্যেই তাঁকে সমর্থন জানিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন কুনার।
একটা সময়ে ঝাড়গ্রাম আসনের বিস্তীর্ণ অংশে ছিল মাওবাদীদের দাপট। কেন্দুপাতা আর সাবুই ঘাসের যথাযথ দাম আদায়ের দাবিতেই মাওবাদীরা ‘জনপ্রিয়’ হয়েছিল ওই এলাকায়। বারংবার রক্তাক্ত হয়েছে এই লোকসভার মধ্যেই থাকা শালবনি, বিনপুর, বান্দোয়ান। মাওবাদীদের লাল চোখ দেখা গিয়েছিল লালগড়েও। তবে ভোট রাজনীতিতে এই এলাকায় বরাবরই সিপিএম ছিল প্রধান দল। শুরু ১৯৭৭ সালে। জিতেছিলেন যদুনাথ কিস্কু। এর পরে টানা তিন বার মতিলাল হাঁসদা। আর ১৯৯১ থেকে ২০০৪ টানা পাঁচ বার ঝাড়গ্রাম থেকে সংসদে গিয়েছেন রূপচাঁদ মুর্মু। ২০০৯ সালে শেষ জিতেছিল সিপিএম। কংগ্রেস প্রার্থী অমৃত হাঁসদাকে প্রায় তিন লাখ ভোটে হারিয়েছিলেন সিপিএমের পুলিনবিহারী বাস্কে। যিনি ছিলেন মেদিনীপুর জেলা পরিষদের প্রাক্তন সভাধিপতি।
কিন্তু ২০১৪ সালে ভোটের ফল হয় চমকে দেওয়ার মতো। পুলিনবিহারীর ভোট ৫৬.৯৬ শতাংশ থেকে কমে হয়ে যায় ২৬.৫০ শতাংশ। সেই বছর, অর্থাৎ ২০১৪ সালে তৃণমূলের উমা সরেন পান ৫৪.৬০ শতাংশ ভোট। জয়ের ব্যবধান দাঁড়ায় সাড়ে তিন লাখের মতো। বিজেপি তখনও ৯.৭৪ শতাংশ ভোট পেয়ে তিন নম্বরে।
ঠিক পাঁচ বছর পরে ২০১৯ সালে আবার চমক! বিজেপির ভোট প্রায় ৩৫ শতাংশ বেড়ে হয়ে যায় ৪৪.৫৬ শতাংশ। তৃণমূল প্রার্থী বিরবাহা সোরেনের প্রাপ্তি কমে ৪৩.৭২ শতাংশ। সিপিএম ‘সর্বহারা’ হয়ে ভোট পায় মাত্র ৫.৩৮ শতাংশ। তাদের প্রার্থী দেবলীনা হেমব্রম পেয়েছিলেন ৭৫ হাজার ভোট।
এ বারের প্রার্থিতালিকা একেবারে বদলে গিয়েছে। তিন প্রধান দলের তিন প্রার্থীই প্রথম বার নির্বাচনী ময়দানে। চিকিৎসক পুলিনবিহারীকে হারিয়ে জিতেছিলেন আর এক চিকিৎসক তৃণমূলের উমা। পরের বার ইঞ্জিনিয়ার কুনারকে জিতিয়েছিল ঝাড়গ্রাম। এ বার তাঁরা কেউই নেই। বিজেপি প্রার্থী করেছে আর এক চিকিৎসক প্রণত টুডুকে। তবে তাঁর বিরুদ্ধে তৃণমূলের প্রার্থীও পরিচিতিতে কম যান না। কেন্দ্রে বিজেপির সরকারের আমলেই ‘পদ্মশ্রী’ খেতাবপ্রাপক কালীপদ সোরেন। তিনি পেশায় ব্যাঙ্ককর্মী হলেও মূল খ্যাতি নাট্যকার হিসাবে। সাঁওতালি সাহিত্য জগতে অবশ্য তাঁর পরিচিতি ‘খেরওয়াল সোরেন’ নামে। ২০১৯ সালে সাহিত্য অকাদেমি এবং ২০২২ সালে পদ্মশ্রী খেতাব পান। তবে এ বার সিপিএম প্রার্থী একেবারে গৃহবধূ। পুরুলিয়া জেলার বান্দোয়ান বিধানসভা এই লোকসভার মধ্যেই। সেখানকার আসনপানি গ্রামের বধূ সোনামণি মুর্মুকে (টুডু) প্রার্থী করেছে সিপিএম। তাঁর স্বামী মণীশ টুডু বান্দোয়ানের কুমড়া পঞ্চয়েতের চুক্তিভিক্তিক কর্মী। সোনামণির দাদু সিপিএম কর্মী ছিলেন। সে জন্য দাদু মাওবাদীদের অত্যাচারের শিকারও হয়েছেন বলেও জানিয়েছেন সোনামণি।
তৃণমূলের কালীপদও সক্রিয় রাজনীতিতে নতুন। লেখালিখির জগতের মানুষ হলেও তাঁর উপরে তৃণমূল ভরসা করছে আদিবাসী সমাজে জনপ্রিয়তার কারণে। অন্য দিকে, বিজেপি প্রার্থী প্রণত গত ১২ বছর ঝাড়গ্রাম হাসপাতালের রেডিয়োলজি বিভাগের চিকিৎসক ছিলেন। কর্মসূত্রে ঝাড়গ্রাম শহরে থাকলেও বাড়ি ঝাড়গ্রাম লোকসভার অন্তর্গত পশ্চিম মেদিনীপুরের গোয়ালতোড় থানার দোবাটি গ্রামে। এলাকায় চিকিৎসক হিসাবেও তাঁর জনপ্রিয়তা রয়েছে। সেই কারণেই বিজেপির পক্ষে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি রাজি হন প্রার্থী হতে। দ্রুত সরকারি চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে ভোটের ময়দানে।
তবে জঙ্গলমহল অন্য এক জগৎ। তাই সেখানকার মানুষের দাবিদাওয়া এবং ভোটের বিষয়ও অন্য রকমের। ঝাড়গ্রাম লোকসভার গোটা এলাকাতেই হাতির উপদ্রব নিত্য সমস্যা। কখনও কখনও জঙ্গল ছেড়ে গ্রামের ফসল নষ্টের পর শহরেও ঢুকে পড়ে হাতির পাল। গজগমনে মৃত্যুও ঘটে হামেশাই। সে বাবদে রাজ্য সরকার মৃতের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেয় এককালীন পাঁচ লাখ টাকা। এখানেই আপত্তি বিজেপির। তুলনা টানা হচ্ছে ওড়িশা, কেরলের সঙ্গে। ওই দুই রাজ্যে ক্ষতিপূরণ এককালীন ছয় ও দশ লাখ টাকার। তবে তৃণমূলের পাল্টা যুক্তি, ওই দুই রাজ্যে যেটা হয় না, সেটা বাংলায় হয়। মৃতের পরিবারের এক জনকে চাকরিও দেয় রাজ্য সরকার। পক্ষান্তরে, বিজেপি এবং সিপিএমের এক কথা, হাতির হানা রোখার জন্য সঠিক পরিকল্পনাই নেই রাজ্যের। হতে পারে লোকসভা নির্বাচন। তবে স্থানীয় সমস্যা নিয়েই চাপানউতর বেশি টুসু, করম, ঝুমুরের ঝাড়গ্রামে।
এমন এক লোকসভার ভোটে এ বার ফল্গুধারার মতো বইছে আরও একটি বিষয়। বিধানসভা ভোটে তৃণমূল এখানে বিরাট জয় পেয়েও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে ২০২২ সালে নেওয়া প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর একটি সিদ্ধান্তে। ২০২২ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে এক আদিবাসী মহিলাকে রাইসিনা হিলসে পাঠানোর বন্দোবস্ত করেছেন তিনি। এ বারের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি জয়ী হলে আদিবাসী সমাজ থেকে আগত রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর কাছেই শপথ নিতে পারেন মোদী। দেশের শীর্ষ আসনে দ্রৌপদীর বসা আদিবাসী সমাজের কাছে শ্লাঘার বিষয়। সেই সমীকরণে দেশের আদিবাসী সমাজের ভোট পদ্ম প্রতীকের বাক্সে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি বলেই মনে করছে বিজেপি। যদিও তৃণমূলের ভরসা বিধানসভা নির্বাচনের ভাল ফল। তবে রাষ্ট্রপতি ভবনের আদিবাসী বাসিন্দাও তৃণমূলের হিসাবে ওলটপালট করে দিতে পারেন। কারণ, দ্রৌপদী সম্পর্কে রাজ্যের মন্ত্রী অখিল গিরির করা ‘কুমন্তব্য’ স্থান করে নিচ্ছে বিজেপির ভোটপ্রচারে। সঙ্গে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে যে তৃণমূল আদিবাসী সমাজের প্রতিনিধিকে ভোট দেয়নি, তা-ও প্রচারে তুলে ধরছে বিজেপি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy