গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
‘ব’-এ বাঁকুড়া, ‘ব’-এ বাসুদেব। বাম জমানায় এ ভাবেই পরিচয় দেওয়া যেত বাঁকুড়া লোকসভা আসনের। ১৯৮০ থেকে ২০০৯ টানা ন’বার এই আসন থেকে লোকসভায় গিয়েছেন সিপিএমের বাসুদেব আচারিয়া। ১৯৮০ সালের লোকসভা ভোটে বাঁকুড়া কেন্দ্রে সিপিএম প্রার্থী করতে চেয়েছিল বিমান বসুকে। কিন্তু সিপিএমের তৎকালীন রাজ্য সম্পাদক প্রমোদ দাশগুপ্তকে বিমান জানিয়ে দেন, তিনি সংগঠনেই থাকতে চান। ভোটে দাঁড়াতে না-চাওয়া বিমানকেই অতএব প্রমোদ বাঁকুড়ার জন্য প্রার্থী খোঁজার ভার দেন। সেই সূত্রেই বাঁকুড়ায় বাসুদেব।
সিপিএমের অনেক নেতা বিভিন্ন সময়ে ঘরোয়া আলোচনায় বলতেন, বাসুদেব আসলে বিমানের ‘আবিষ্কার’। এক সময়ের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা তথা পুরুলিয়ার ভূমিপুত্র বাসুদেবকে হারাতে পারেননি অনেক পোড়খাওয়া রাজনীতিক। কিন্তু রাজ্যে পালাবদলের পরে ২০১৪ সালের ভোটে তাক লাগিয়ে দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অভিনেত্রী মুনমুন সেনকে বাঁকুড়ায় প্রার্থী করে জিতিয়ে আনেন তিনি।
তার পরে আর ভোটেই দাঁড়াননি বাসুদেব। অধুনাপ্রয়াত এই সিপিএম নেতা ২০০৯ সালের নির্বাচনে হারিয়েছিলেন তৎকালীন কংগ্রেস প্রার্থী সুব্রত মুখোপাধ্যায়কে এক লাখেরও বেশি ভোটে। বাঁকুড়ায় বামেদের ভোট তখন ৪৭.৬৬ শতাংশ। তৃণমূলের সঙ্গে জোট ছিল কংগ্রেসের। সুব্রত কংগ্রেস প্রার্থী হয়ে পেয়েছিলেন ৩৬.৭১ শতাংশ ভোট। বিজেপির প্রার্থী ছিলেন দলের তৎকালীন রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ। যিনি ভোট পেয়েছিলেন মাত্র ৪.৩৩ শতাংশ। কিন্তু ২০১৪ সালে পাশা বদলে যায়। রাজনীতিতে পা রেখেই শ্রীমতী দেববর্মা ওরফে মুনমুন ন’বারের সাংসদ বাসুদেবকে হারিয়ে দেন সাড়ে ৯৮ হাজার ভোটে। অন্য দিকে, তৃতীয় স্থানে থাকলেও ‘মোদী হাওয়া’য় ভর করে বিজেপির চিকিৎসক প্রার্থী সুভাষ সরকার ২০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে যান।
বিজেপি খেলা পুরোপুরি ঘুরিয়ে দেয় ২০১৯ সালে। সে বার আর মুনমুন নয়, তখন তৃণমূল সরকারের মন্ত্রী সুব্রতকে প্রার্থী করেছিল তৃণমূল। ‘হাত’ প্রতীক ছেড়ে জোড়াফুলের প্রার্থী হয়েও বাঁকুড়ার ললাট লিখন বদলায়নি সুব্রতের। বাঁকুড়া থেকে মুনমুনকে পাঠানো হয়েছিল আসানসোলে। সেখানে মুনমুন হারেন। যেমন সুব্রত হারেন বাঁকুড়ায়। প্রায় ২৯ শতাংশ ভোট বাড়িয়ে সুব্রতকে পিছনে ফেলে বিজেপির সুভাষ এক নম্বর হন প্রায় পৌনে দু’লাখ ভোটে জিতে। ৭.৩ শতাংশ ভোট নিয়ে তৃতীয় স্থানে ছিলেন সিপিএমের অমিয় পাত্র।
এমনই অঙ্ক নিয়ে এ বারের দিল্লিবাড়ির লড়াই। কেন্দ্রের মন্ত্রী চিকিৎসক সুভাষকেই প্রার্থী করেছে বিজেপি। তবে বাকি দুই দলের প্রার্থী বদলে গিয়েছে। তৃণমূলের প্রার্থী বাঁকুড়া লোকসভারই অন্তর্গত তালড্যাংরার বিধায়ক অরূপ চক্রবর্তী। যিনি এক সময়ে বাঁকুড়া জেলা তৃণমূলের সভাপতি এবং বাঁকুড়া জেলা পরিষদের সভাধিপতিও ছিলেন। প্রসঙ্গত, গত লোকসভা নির্বাচনের নিরিখে বাঁকুড়ার সাতটি বিধানসভাতেই পদ্মশিবির এগিয়ে থাকলেও ২০২১ সালে সাতটির মধ্যে তিনটি জিতে নিয়েছিল ঘাসফুল। তালড্যাংরা, রায়পুর এবং রানিবাঁধ। বিজেপি পায় বাঁকুড়া, ছাতনা, রঘুনাথপুর এবং শালতোড়া বিধানসভা। বাঁকুড়ার প্রাক্তন জেলা সভাপতি অরূপের উপরে তৃণমূলের ভরসা করার কারণ রয়েছে। বাঁকুড়ার রাজনীতিতে বরাবর সুভাষ তথা বিজেপিকে ‘চাপ’-এ রাখায় সফল হয়েছেন অরূপ। এ ছাড়াও পর পর তিন বার বাইরে থাকে প্রার্থী আনায় স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্বের একাংশের ক্ষোভ ছিল। এ বার তাই বাঁকুড়ার ‘ভূমিপুত্র’ অরূপেই ভরসা রেখেছেন শীর্ষ নেতৃত্ব।
তবে অরূপের লড়াই সহজও নয়। কারণ, বাঁকুড়া জানে রাজনীতি নয়, মুনমুন জিতেছিলেন তিনি ‘মুনমুন সেন’ বলে। তাঁর চলচ্চিত্রের জনপ্রিয়তায় ভর করেই ওই এক বার বাঁকুড়া দখলে আনতে পেরেছিল তৃণমূল। সে বার মুনমুন পেয়েছিলেন ৪,৮৩,৪৫৫ ভোট। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী সিপিএমের বাসুদেব পেয়েছিলেন, ৩,৮৪,৯৪৯ ভোট। শক্তি অনেকটা বাড়িয়ে পদ্মের প্রার্থী সুভাষ পেয়েছিলেন ২,৫১,১৮৩ ভোট।
পাঁচ বছর আগে তৃণমূলের কাছ থেকে বাঁকুড়া ছিনিয়ে নিয়ে গেরুয়া আবির উড়িয়েছিল বিজেপি। এ বার কি ফল উল্টে দিতে পারবে তৃণমূল? না কি এ বারও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা বিজেপির প্রার্থী সুভাষের হাত ধরে ‘খেলা’ দেখাবে বিজেপি?
তবে বাঁকুড়ায় লড়াই সরাসরি দুই ফুলের। বাম প্রার্থী নীলাঞ্জন দাশগুপ্ত। আইনজীবী নীলাঞ্জন ছাত্রাবস্থা থেকেই বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। এখন সিপিএম এর আইনজীবী সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। ২০১২ সালে বাঁকুড়ার তৎকালীন বিধায়ক কাশীনাথ মিশ্রের মৃত্যুতে বাঁকুড়া বিধানসভা কেন্দ্রে উপনির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন নীলাঞ্জন। তৃণমূল জিতলেও দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন তিনি। এ বার সম্বল বলতে বাঁকুড়া লোকসভায় গত বারের ৭.৩ শতাংশ ভোট।
উন্নয়নের নিরিখে বাঁকুড়া এখনও বাকি রাজ্যের তুলনায় খানিক পিছিয়ে। ঘরোয়া আলোচনায় তা স্বীকার করে নেন তৃণমূলের নেতাদের একাংশও। তার কারণ কেন্দ্রীয় সরকার না রাজ্য সরকার, তা নিয়ে ভোটের আবহে চাপানউতর চলছে। অনুন্নয়নকে ‘হাতিয়ার’ করেই একটা সময়ে মাওবাদী সক্রিয়তা বেড়েছিল বাঁকুড়ায়। তবে তা এখন অতীত। কিন্তু অনুন্নয়ন বর্তমান। তাই কংসাবতী, দামোদর এবং দ্বারকেশ্বর দিয়ে ঘেরা বাঁকুড়ায় কোন নদী বা নদের জল কোন দিকে গড়াবে, তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। কারণ, স্রোত অঙ্ক মানে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy