গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
বিষ্ণুপুর লোকসভার ভোটে কি ‘প্রাক্তন’ ছবির জাতীয় পুরস্কারজয়ী গানটির সুর আছে? নেই। কারণ, প্রাক্তন হয়ে যাওয়া পাত্র-পাত্রীর কথায় বিষাদের গন্ধ নেই। বরং একে অপরকে ঝাঁজালো আক্রমণেই ব্যস্ত সৌমিত্র খাঁ ও সুজাতা মন্ডল। বিজেপি প্রার্থী সৌমিত্র অবশ্য অনেক কিছুতেই ‘প্রাক্তন’। তিনি তৃণমূল প্রার্থী সুজাতার প্রাক্তন স্বামী। তৃণমূলের প্রাক্তন সাংসদ। কংগ্রেসের প্রাক্তন বিধায়ক।
বাম জমানায় আশির দশকের মাঝামাঝি রাজ্য সরকারের শিল্প পরিকাঠামো উন্নয়ন নিগম ‘বিষ্ণুপুর ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ সেন্টার’ তৈরি করতে উদ্যোগী হয়েছিল। বিষ্ণুপুর শহরের উপকণ্ঠে দ্বারিকা-গোসাঁইপুর পঞ্চায়েত এলাকায় জমি অধিগ্রহণ হয়। তা নিয়ে বহু বিতর্কও হয়। তবে নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে প্রায় ১৯৬ একর জায়গা জুড়ে শিল্পতালুকের পথচলা শুরু হয়। সিসা, ফেরো অ্যালয়, সিমেন্ট, মুরগির খাবার তৈরির কারখানা তৈরি হয়। অন্য রাজ্য থেকেও সেখানে কাজ করতে আসতেন শ্রমিকরা। কিন্তু সে সবই এখন অতীত।
বিষ্ণুপুরের ভোটে আরও অনেক কিছুর সঙ্গেই প্রচারে ‘প্রাসঙ্গিক’ হতে পারত হারানো শিল্পতালুকটিও। কিন্তু বিষ্ণুপুর মজে রয়েছে প্রধান দুই দলের প্রার্থীর ঘর-ভাঙার চর্চায়। পাঁচ বছর আগে ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের সময় সৌমিত্র-সুজাতা দম্পতি লড়েছিলেন পদ্ম ফোটাতে। সে বার আইনি জটিলতায় সৌমিত্র বিষ্ণুপুরে ঢুকতেই পারেননি। গোটা লোকসভা এলাকা চষে ফেলেছিলেন সহধর্মিনী সুজাতা। শেষ পর্যন্ত বিষ্ণুপুরে জেতে বিজেপি। জেতেন সৌমিত্র। তাঁর জয়ে স্ত্রীর ভূমিকার কৃতিত্ব দিয়েছিলেন সৌমিত্র। তার বছর দুয়েকের মধ্যেই দম্পতির পথ দুই ফুলে বেঁকে যায়।
এখন সৌমিত্র বলছেন, “সেই সময়ে মোদীর সুনামি চলছিল। দিন পনেরো প্রচারে নামলেই কি নেত্রী হওয়া যায় নাকি! ওঁর সঙ্গে তিন হাজার কর্মী নেমেছিলেন। মানুষ সৌমিত্র খাঁর সততা দেখে ভোট দিয়েছিলেন।” আর এখন সুজাতা বলছেন, “সে বার স্ত্রীর কর্তব্য করেছিলাম। এ বার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছি। তবে তখন থেকে বিষ্ণুপুরের রাজনীতির জমিটা আমি চিনে ফেলেছি, চষে ফেলেছি। মমতাদি (মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়) ওঁকে প্রথম সাংসদ করেছিলেন। উনি বিষ্ণুপুরের জন্য কিছুই করেননি। শুধু বিলাসবহুল জীবন কাটিয়েছেন। আমি এখন মানুষের কাছে গিয়ে আমার অতীতের ভুলের জন্য ক্ষমা চাইছি।”
তৃণমূলে গিয়ে প্রথমে ধাক্কা খেলেও পরে জয় পেয়েছেন সুজাতা। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে আরামবাগ থেকে দাঁড়িয়ে বিজেপির মধুসূদন বাগের কাছে পরাজিত হন। তবে ২০২৩ সালের পঞ্চায়েত ভোটে বাঁকুড়া থেকেই শাসকদলের টিকিটে জেলা পরিষদ সদস্য হয়েছেন তিনি। ‘পুরস্কার’ হিসাবে তাঁকে দেওয়া হয়েছে জেলা পরিষদের কর্মাধ্যক্ষের দায়িত্বও। এ বার ‘প্রাক্তনের’ হাত থেকে কেন্দ্র পুনরুদ্ধারের গুরুভার। তবে হারানোর কিছু নেই সুজাতার। আসন ধরে রাখার বড় চ্যালেঞ্জ বরং সৌমিত্রেরই। অঙ্কের হিসাবে যদিও তিনি এগিয়ে। গত লোকসভায় এই কেন্দ্রের একটি ছাড়া সব বিধানসভা আসনেই এগিয়ে ছিল বিজেপি। ২০২১ সালে নীলবাড়ির লড়াইয়ে পাঁচটিতে জিতেছে তারা। যদিও বিষ্ণুপুর ও কোতুলপুরের বিজেপি বিধায়কেরা পরে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। তবে পদ্মশিবিরের দাবি, বিধায়করা দলবদল করলেও ভোটাররা মনবদল করেননি।
বিষ্ণুপুর লোকসভা একটা সময় পর্যন্ত ছিল বামেদের ‘শক্ত ঘাঁটি’। শুরুতে ১৯৬২ এবং ১৯৬৭ সালের ভোটে জয়ী হন কংগ্রেসের পশুপতি মণ্ডল। আর ১৯৭১ থেকে টানা জিতেছে সিপিএম। ২০১৪ সালে তৃণমূলের ঝোড়ো হাওয়ায় বাম প্রার্থী সুস্মিতা বাউড়িকে হারিয়ে জয়ী হন তখন কংগ্রেস থেকে তৃণমূলে যাওয়া সৌমিত্র।
অন্যদিকে, ২০০৯ সালে সিপিএমের সুস্মিতা বিষ্ণুপুরে প্রায় ৫২ শতাংশ ভোট পেয়ে ১ লক্ষ ৩০ হাজারের কাছাকাছি ভোটে জিতেছিলেন। দ্বিতীয় হন তৃণমূলের শিউলি সাহা। যিনি এখন কেশপুরের বিধায়ক। কিন্তু ২০১৪ সালে প্রায় দেড় লক্ষ ভোটে হারতে হয় সিপিএমকে। সৌমিত্র ৪৫.৫০ শতাংশ ভোট পেয়ে প্রায় দেড় লাখ ভোটে জেতেন তৃণমূলের টিকিটে। হেরেছিলেন সিপিএমের সুস্মিতা। তখনও পর্যন্ত তৃতীয় স্থানে থাকা বিজেপির ভোট ছিল ১৪.১১ শতাংশ ভোট। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের আগে ৯ জানুয়ারি মুকুল রায়ের হাত ধরে সৌমিত্র বিজেপিতে যান। বিষ্ণুপুরে তিনি ৪৬.২৫ শতাংশ ভোট পেয়ে জেতেন। বিজেপির ভোট ৩২ শতাংশেরও বেশি বৃদ্ধি পায়। তখনও কোতুলপুরের বিধায়ক তৃণমূল প্রার্থী শ্যামল সাঁতরা হারেন ৭৮ হাজার ভোটের ব্যবধানে। সাংসদ হন সৌমিত্র।
সৌমিত্র কংগ্রেস থেকে তৃণমূলে যোগ দেওয়ায় খালি হয়েছিল কোতুলপুর আসন। সেখানে উপনির্বাচনে জিতেছিলেন তৃণমূলের শ্যামল। পরে ২০১৬ সালেও বিধানসভা ভোটে জেতেন তিনি। কিন্তু এখন কোতুলপুর বিজেপির দখলে। তবে বিধায়ক হরকালী প্রতিহার তৃণমূলে চলে গিয়েছেন। তাঁর দলবদলের কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল, তাঁকে বিষ্ণুপুর লোকসভায় প্রার্থী করা হতে পারে। কিন্তু হরকালীর লোকসভায় প্রার্থী হওয়া হয়নি।
সৌমিত্র ২০১৪ সালে কোতুলপুর বিধানসভা ছেড়ে দেওয়ার পরে উপনির্বাচনে ওই আসে জিতে ভোট রাজনীতিতে আসেন সিপিএমের শীতল কৈবর্ত্য। এ বার তিনিই বিষ্ণুপুরের বাম-কংগ্রেস জোটের প্রার্থী। তবে টেরাকোটার বিষ্ণুপুরে মাটি লাল হলেও ভোটের পালে কোনও লাল হাওয়া নেই। বরং ঘর ভাঙার গল্পই নির্বাচনের রসদ। ভোটের সাদা-কালো ছকে একের নৌকোর সামনে অপরের সৈন্যদল। বিষ্ণুপুর জানতে চায় যুদ্ধশেষের দিনে কে বলবেন, ‘আমার মন্ত্রী খোয়া গেছে একটা চালের ভুল, কোথায় দাঁড়াই!’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy