কল্পনা সোরেন। — নিজস্ব চিত্র।
প্রথম বক্তৃতাতেই বাজিমাত।
মার্চের ৩ তারিখ রবিবার ৪৮-এ পা দিলেন কল্পনা। সেই দিনই সমাজমাধ্যমে ঘোষণা করলেন, দ্বিধা ছেড়ে রাজনীতির জগতে প্রবেশ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। সোমবার ৪ মার্চ গিরিডিতে ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা (জেএমএম)-র ৫১তম প্রতিষ্ঠা দিবসের জনসভায় কারাবন্দি স্বামী হেমন্ত সোরেনের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি প্রথম বক্তৃতাটি দেবেন। সকলের শুভেচ্ছা প্রয়োজন।
সোমবার ভোর ভোর স্নান সেরে চুলে হলুদ ফুল লাগিয়ে কল্পনা চলে আসেন রাঁচীর কর্মটোলির অদূরে একতলা সরকারি বাংলোটিতে। স্ত্রী রুপিদেবীকে নিয়ে এখানেই থাকেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এবং জেএমএমের সভাপতি শিবু সোরেন। কল্পনা সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করে পা ধুইয়ে দেন বর্ষীয়ান শ্বশুর-শাশুড়ির। সেখান থেকে বাড়ি ফিরে খানিক পরে রওনা হন
গিরিডির উদ্দেশে।
সেখানে তখন ফুলে ফুলে ছেয়ে গিয়েছে মঞ্চ। ধামসা মাদলের বোল, হাতে হাতে ফিরছে কাঁড়-ধনু, যা আবার জেএমএম-এর নির্বাচনী প্রতীকও। মঞ্চের উপরে মুখ্যমন্ত্রী বৃদ্ধ চম্পাই সোরেন, দলের আর সব নেতা।
ডাক পড়তে মঞ্চে উঠে নিজেই মুখের সঙ্গে মাইক্রোফেনের দূরত্ব ঠিক করে নিলেন। নিজের পরিচয় দিলেন, ‘ঘটনাক্রমে রাজনীতির মঞ্চে এসে পড়া’, ঝাড়খণ্ডের সদ্যপ্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর ধর্মপত্নী হিসাবে। জানালেন— পদের লোভে নয়, নেতৃত্ব বা মন্ত্রিত্বের আকর্ষণে নয়, তিনি রাজনীতিতে এলেন তাঁর স্বামী আদিবাসী নেতা হেমন্তের বিরুদ্ধে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার যে ভয়ানক অবিচার করেছে, তার জবাব চাইতে। ডান হাতে মাইক ধরে বাঁ হাতের তর্জনী বাতাসে আস্ফালন করে কল্পনা বললেন, “জবাব চাই, জবাব চাই, জবাব চাই!”
আপন সমাজের এক মহিলার আর্জি, ‘গুরুজি’ শিবু সোরেনের বহুজির আর্তি তখন স্পর্শ করেছে ভিড়ের অন্তরমহলকে। ৪৪ ডিগ্রির গুমোটের মতো ডেলা পাকানো নৈঃশব্দ। কল্পনা বলে চলেছেন, “হেমন্তের দোষ ছিল। দোষ এই— চিরটা কাল ঘাড় ধাক্কা খেয়ে এক কোণে পড়ে থাকা গরিব সাঁওতাল, মুন্ডা, ওঁরাও, হো মানুষগুলার কাছে তিনি সরকারি সুযোগ সুবিধা পৌঁছে দিচ্ছিলেন। ‘আপ কি দুয়ার মে সরকার’ প্রকল্পে সরকারি অফিসারদেরই পৌঁছে দিচ্ছিলেন আদিবাসী জনেদের দোরে দোরে। অন্য রাজ্য এই প্রকল্পের সাফল্য দেখে সেখানেও এই কাজ শুরু করে হাততালি কুড়োচ্ছে। আর দিল্লির বিজেপি দেখল, কিছুতেই যখন এঁটে ওঠা যাচ্ছে না, জেলে ঢোকা মুখ্যমন্ত্রী হেমন্তকে।”
বিন্দুমাত্র হোঁচট না-খেয়ে কল্পনা বলে চলেন, “আপনারাই বলুন, একটা রাজ্যের নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রীকে এ ভাবে গ্রেফতার করে জেলে বন্দি করা যায়? আপনাদের সকলের হয়ে আমি জবাব চাইছি বিজেপিওয়ালাদের কাছে। সামনে ভোট। হেমন্তের অপমান, আদিবাসী সমাজের অপমানের জবাব আপনারাও দিন।” বক্তৃতা শেষে নির্দিষ্ট আসনে ফিরে গিয়ে বসলেন কল্পনা। গ্লাসের জলে গলা ভেজালেন। তত ক্ষণে ফেটে পড়ছে গিরিডির জনতা। সপ্রশংস হাসিতে চম্পাই বললেন, ‘বধাই হো!’
স্লোগান, উন্মাদনা, ধামসার আওয়াজ অতিক্রম করে গিরিডির এক নেতা তখন পৌঁছে গিয়েছেন পোডিয়ামে। দু’বার মাইক ঠুকে তিনি ঘোষণা করলেন— “সামনে এই গিরিডি লোকসভার ভোটের সঙ্গেই গান্ডে বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচন। জনতার তরফে প্রস্তাব দিচ্ছি, ‘গুরুজি কি বহু’ এখানে কাঁড়-ধনুকের প্রার্থী হোন! গান্ডের বাসিন্দারা কী বলেন?”
জনতার গর্জনে গণ-রায় স্পষ্ট। মঞ্চে বসে মুখ চাওয়াচাওয়ি করেন জেএমএম-এর নেতা-মন্ত্রীরা। তৎক্ষণাৎ নেতৃত্বের সিদ্ধান্ত জানতে চান মানুষ। পণ্ড হওয়ার উপক্রম সভা। মাইক ধরলেন চম্পাই সোরেন। সবুজ উত্তরীয় গলা পেঁচিয়ে বাঁ কাঁধে ছুড়ে দিয়ে বলেন, “জেএমএম শৃঙ্খলাবদ্ধ দল। নেতৃত্ব বৈঠকে বসবেন গান্ডে-য় প্রার্থী মনোনয়ন করতে। তখন আপনাদের প্রস্তাব বিবেচনা করব।”
এক সপ্তাহ পরে কল্পনার নামই গান্ডে বিধানসভা আসনে প্রার্থী হিসাবে ঘোষণা করল জেএমএম। কিন্তু ৩ মার্চের আগে সত্যিই কি কল্পনা রাজনীতিতে আসার কথা ভাবেননি? এত সাবলীল বক্তৃতা কি এক দিনের প্রস্তুতিতে হয়?
“কল্পনাও করিনি কখনও রাজনীতিতে আসব। আমার স্বামী হেমন্তও চাননি। ডিসেম্বরের ৩১ তারিখে হেমন্তকে গ্রেফতারের ঘটনা আমাদের রাজ্য তো বটেই, পরিবারেও সব হিসাব উল্টে দিয়েছে,” প্রচারের ব্যস্ততার মধ্যে ছোট্ট কথোপকথনে বলেন কল্পনা। “তবে বক্তৃতা দেওয়া এই প্রথম নয়। আমি একটা ছোট প্লে-স্কুল চালাই। নানা অনুষ্ঠানে বলতে হয়। ভুবনেশ্বরে এমবিএ পড়ার সময়ে পাবলিক স্পিকিং শিখতে হয়েছে। কিন্তু গিরিডির জনসভায় বলতে গিয়ে সেই প্রশিক্ষণের মাথামুন্ডু কিছুই মনে আসেনি। মনের কথাটুকুই বলেছি। এই অবিচারের জবাব চাই!”
আদতে ওড়িশার ময়ূরভঞ্জের কল্পনা মুর্মু সেনা অফিসারের কন্যা। তাঁর কথায়, “এই জন্যই হয়তো ভয়ডর কম আমার। সে ছোটদের স্কুল পরিচালনা হোক, বা দুই সন্তানকে মানুষ করা, কিংবা ধরুন রাজনীতি। সবই পরিপাটি ভাবে করার
চেষ্টা করি।”
গ্রেফতার আসন্ন বুঝে স্ত্রীর উপরেই কিন্তু ভরসা করেছিলেন হেমন্ত। অতি ঘনিষ্ঠ কয়েক জনকে বলেছিলেন, তিনি ইস্তফা দিলে কল্পনাকেই মুখ্যমন্ত্রিত্বের দায়িত্ব তুলে দিক দল। সেই বার্তা শোনাতে হেমন্ত ৩০ ডিসেম্বর দলের যে বৈঠক ডাকেন, ৭ জন বিধায়ক তাতে গরহাজির থাকলেন। সেই তালিকায় ছিলেন তাঁর প্রয়াত দাদা দুর্গার স্ত্রী সীতা সোরেন এবং ছোট ভাই বসন্ত। বুঝে গেলেন, রাজনীতিতে নবাগত কল্পনাকে এত ঘরশত্রুর মধ্যে ফেলে যাওয়াটা ঠিক হবে না।
৩১ তারিখ দুপুরে ফের বৈঠক। কল্পনা নয়, পাঁচ বছর আগে জামশেদপুর লোকসভা আসনে ৩ লক্ষের বেশি ভোটে হেরে যাওয়া চম্পাই সোরেনের নামে সিলমোহর দিলেন দলের নেতৃত্ব। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে চম্পাইয়ের নাম ঘোষণার ঘণ্টা খানেকের মধ্যে হেমন্তের নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়ে হাজির হলেন ইডি-র অফিসারেরা।
অনেকের ধারণা, প্রচারে রাজ্য চষে ফেলা কল্পনাই এক দিন হেমন্তের উত্তরাধিকারী হিসেবে উঠে আসবেন। বিধায়ক হওয়ার পরে তিনি মুখ্যমন্ত্রী হবেন, চম্পাইকে রাজ্যসভায় পাঠিয়ে সন্তুষ্ট করা হবে। কিন্তু জেএমএম-এর এক শীর্ষ নেতার কথায়, “প্রশ্নই ওঠে না। কিসের উত্তরাধিকারী? হেমন্ত জেল থেকে বেরিয়ে এলেন বলে। ডিসেম্বরে ভোটে জিতে তিনিই মুখ্যমন্ত্রী হবেন। দলকেও নেতৃত্ব দেবেন। কত আর বয়স তাঁর?” আর গলা নামিয়ে বললেন — “শুনুন, আদিবাসী সমাজে ভাই-ছেলেরা থাকতে মেয়ে-বউকে উত্তরাধিকারী বাছা রীতি নয়। সমাজই মানবে না।”
পুরুষতন্ত্র জিন্দাবাদ!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy