Advertisement
E-Paper

আলোর দিশা দেখাত মুশকিল আসানের চিরাগ

বাংলার নিজস্ব লোককথা-কিংবদন্তির ভিড়ে এও এক বিস্ময়। ধপধপে সাদা দাড়ি-গোঁফ, দীর্ঘ পাগড়ি, তাপ্পি মারা লম্বা জোব্বা, হাতে জ্বলন্ত লণ্ঠন নিয়ে মুশকিল আসানরা একদা এ শহরের পথে পথে ঘুরতেন। কালের নিয়মে মানুষের বিশ্বাসে ক্রমশ একাকার হয়ে গেছে মুশকিল আসান থেকে আসানবিবি, সত্যপির থেকে সত্যনারায়ণ।

ছবি কুনাল বর্মণ।

ছবি কুনাল বর্মণ।

প্রজিতবিহারী মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৭ এপ্রিল ২০২৫ ০৬:০০
Share
Save

হঠাৎ এক-এক দিন জোড়াসাঁকোর সেই কিংবদন্তি ঘেরা বাড়িটিতে ভর সন্ধেবেলায় খিড়কির দোরে একটি মানুষ এসে হাঁক পাড়ত,“মুশকিল আসান!”

মানুষটির শ্বেতশুভ্র শ্মশ্রুগুম্ফরাশি, দীর্ঘ পাগড়ি, তাপ্পি মারা লম্বা জোব্বা, হাতের জ্বলন্ত লণ্ঠন— সব মিলিয়ে বালক অবন ঠাকুরের মনে হত, লোকটি মানুষই নয়। কোনও অশরীরী বা তৎসদৃশ সমধিক ভয়াল কোনও জীব। ভয়ে হাত-পা গুটিয়ে যেত। গা-টা কেমন ছমছম করত। তবে ঠাকুরবাড়ির তৎকালীন কর্তাদের কাছারিতে হুকুম দেওয়া থাকত, মানুষটি এলেই তাকে চারটি পয়সা ও খানিকটা চাল দেওয়া হবে। তা-ই নিয়ে, সেই না-প্রেত না-মানুষটি আবার হাঁক পাড়তে পাড়তে চলে যেত। রয়ে যেত কেবল তার সেই অদ্ভুত শব্দবন্ধের প্রতিধ্বনিটুকু— ‘মুশকিল আসান!’

তৎকালীন কলকাতার পথে-ঘাটে এই মুশকিল আসান চরিত্রটি যে বেশ উল্লেখযোগ্য ছিল, তা অবনীন্দ্রনাথের স্মৃতি ছাড়াও নানা ভাবে জানা যায়। একদা নাকি খোদ রাজভবনের উত্তর দিকের একটি ঘরে ত্রিপুরার মহারাজা বীরচন্দ্রের তৈলচিত্রের ঠিক পাশেই ঝুলত ইংরেজ শিল্পী আলেকজ়ান্ডার ক্যাডির আঁকা একটি মুশকিল আসানের চিত্র। ছবির তলায় লেখা ছিল: ‘মুশকিল আসান: এ মহামেডান বেগার’। প্রায় একশো বছর পরেও মুশকিল আসানের স্মৃতি এতটাই প্রকট যে, তা সমগ্র বাঙালি জাতীয় সত্তার উপমা হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন কবি বেলাল চৌধুরী— “জয় বাংলা ছিল আছে, একদিন চিরদিন, হরি বোষ্টুমীর কীর্তনে মুশকিল আসান ফকিরের হায়দারি হাঁকে।”

সেই হায়দারি হাঁকের নস্টালজিয়া বাঙালির চলতি ভাষার অবচেতনে আজও ঘুরপাক খাচ্ছে। আজও কেউ হঠাৎ কোনও একটা জটিল সমস্যার সমাধান করে দিলে বলি, ‘এ যেন মুশকিল আসান!’ তবে যার মুখ থেকে এই শব্দটি পাড়ায় পাড়ায় ছড়িয়ে পড়ত, সেই চরিত্রটি আজ বিস্মৃতির অন্ধকারে হারিয়ে গেছে। তার হাতের সেই জাদুচিরাগও যেন সেই অন্ধকূপের নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের গণ্ডি পেরোতে অক্ষম। কিন্তু কে ছিল সেই চরিত্রটি? আর কেনই বা সে এমন অদ্ভুত একটি ডাক দিয়ে বেড়াত?

উনিশ শতকের মাঝামাঝি ঢাকার ডাক্তার জেমস ওয়াইজ় সম্ভবত প্রথম এই মুশকিল আসানদের উল্লেখ করেন। ওয়াইজ়ের বাবাও ছিলেন ঢাকার ডাক্তার এবং সেই সূত্রে জেমসের জন্মও সুবে বাংলার মোগল রাজধানীটিতে। তৎকালীন ঢাকাইয়া সমাজের সঙ্গে তাঁর পরিচিতি তাই জন্মলগ্ন থেকেই। পরবর্তী কালে তিনি ডাক্তারির পাশাপাশি নৃতত্ত্বে মনোনিয়োগ করেন। সেই সুবাদে বাংলার বিভিন্ন জাতি এবং সম্প্রদায় নিয়ে লেখেন। এবং সেখানেই উল্লেখ করেন মুশকিল আসানদের।

ওয়াইজ় সাহেব জানান যে, এই মুশকিল আসানরা প্রতি বৃহস্পতিবার, অর্থাৎ জুম্মা রাতে, সন্ধেবেলা হাতে একটি প্রদীপ নিয়ে পথে পথে ঘুরে শহরের মানুষকে মনে করিয়ে দিতেন যে, একমাত্র সর্বশক্তিমান আল্লাতালাই পারেন সকল মুশকিলের আসান করতে। তাঁর দরজা সকলের জন্য সব সময় খোলা। মুশকিল আসানরা কখনও ভিক্ষা চাইতেন না। তবে যে সব বাড়িতে তাঁরা যেতেন, সেখানে তাঁদের যা দেওয়া হত, তা-ই তাঁরা গ্রহণ করতেন। পরিবর্তে দাতার কপালে একটি বিশেষ তিলক এঁকে দিয়ে চলে যেতেন।

ওয়াইজ়ের মতে এই মুশকিল আসানরা আদতে ছিলেন নক্সবন্দিয়া তরিকার ফকির। ফকিরদের মধ্যে দুটি বৃহৎ গোষ্ঠী রয়েছে— বে-শারা আর বা-শারা। বে-শারা ফকিররা শরিয়তি অনুশাসনের বাধানিষেধ মানেন না। বা-শারারা তা মেনে চলেন। মুশকিল আসানরা ছিলেন বা-শারা, অর্থাৎ তাঁরা শরিয়তের অনুশাসন মেনেই প্রার্থনা করতেন।

এই নক্সবন্দি তরিকা ছিল ভারতের সুফি তরিকাগুলির মধ্যে অন্যতম। ওয়াইজ় সাহেব বলেন, যে এই তরিকার মূল প্রবর্তক ছিলেন ওবায়দুল্লা এবং পরবর্তী কালে সেই ওবায়দুল্লার প্রবর্তিত দর্শনকে একত্রিত করে একটি পরিষ্কৃত রূপ দেন চতুর্দশ শতকের মহম্মদ বাহাউদ্দিন নক্সবন্দ। এই বাহাউদ্দিন নক্সবন্দের দরগা রয়েছে মোগল বাদশাদের অকুস্থল মধ্য এশিয়ায়, বোখারার একটু বাইরে সমরখন্দের রাস্তায়। দরগাটির সঙ্গে জড়িত নানা কিংবদন্তির খবরও দিয়েছেন ওয়াইজ় সাহেব। দরগার উপর নাকি কোনও ছাদ থাকে না। আকাশ ছাড়া কোনও আচ্ছাদনই দরগাটিকে ঢাকা দিতে পারে না। তবে প্রতি বছর যে হাজার হাজার ভক্ত এই বাহাউদ্দিনের দরগায় যান, তাঁদের আগ্রহ ছাদের দিকে নয়, বরং দরগার সামনে একটিপ্রস্তরখণ্ডের দিকে। ‘সাং-ই-মুরাদ’ নামক এই পাথরটিতে কপাল ঠেকিয়ে ভক্তিভরে প্রার্থনা করলে নাকি সকল মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়। তাই শতকের পর শতক ধরে ভক্তদের কপালের স্পর্শে পাথরটি মসৃণ হয়ে গেছে।

ওয়াইজ় সাহেব-লিখিত ইতিহাসে কিন্তু একটি ভুল আছে। ওবায়দুল্লা মোটেই নক্সবন্দি তরিকার প্রবর্তক নন। তরিকার প্রবর্তন বাহাউদ্দিনই করেন। তবে পরবর্তী কালে এই তরিকার প্রচারে যাঁরা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ওবায়দুল্লা আহরার। এঁর বংশধরদের এবং ভক্তদের মাধ্যমেই এই তরিকার সঙ্গে মোগল রাজবংশের ঘনিষ্ঠতা সৃষ্টি হয়। কিংবদন্তি, দিল্লির সুলতান ইব্রাহিম লোদির সঙ্গে যুদ্ধের প্রাক্কালে পরবর্তী কালের বাদশা বাবর এই ওবায়দুল্লার স্বপ্নাদেশ প্রাপ্ত হন। বাবরের ছোট সৈন্যদলটিতে তখন তাঁর সঙ্গে শামিল ছিলেন ওবায়দুল্লার এক পুত্র, মহম্মদ আমিন। পরে বাদশা বাবর তাঁর এক কন্যার বিবাহ পর্যন্ত দেন এই তরিকার এক পির, নুরউদ্দিন মহম্মদ নক্সবন্দির সঙ্গে।

যদিও মোগল বংশের সঙ্গে নক্সবন্দি তরিকার পিরদের আত্মীয়তা পরবর্তী প্রজন্মেও বজায় থাকে, কিন্তু বাদশা হুমায়ুনের সময় থেকে বাদশার উপর তাঁদের প্রত্যক্ষ প্রভাব কমতে থাকে। হুমায়ুনপুত্র বাদশা আকবর আজমিরের চিশতি তরিকাভুক্ত পির, সেলিম চিশতি-কে গুরুরূপে গ্রহণ করেন এবং সেই কারণে নক্সবন্দিদের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব বেড়ে যায়। আকবরের পর বাদশা জাহাঙ্গির এক সময় ভারতে এই তরিকার সবচেয়ে প্রভাবশালী পির, আহমেদ সিরহিন্দিকে কারাবাস করিয়ে সেই সম্পর্ক আরও শিথিল করেন। তবে বাদশারা বীতরাগ হলেও তরিকার সঙ্গে অন্য রাজপুরুষদের নক্সবন্দিদের সম্পর্ক রয়েই যায়। রাজশক্তির সঙ্গে এই আত্মীয়তার দ্বারাই উত্তর ও পশ্চিম ভারতে এই তরিকার প্রতিপত্তি ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছিল।

তবে রাজানুগ্রহ ছাড়াও এই তরিকার পিরদের অলৌকিক ক্ষমতা সম্বন্ধে সাধারণ মানুষ এবং বাদশার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল। এই বিশ্বাস লালিত হত নানা প্রচলিত কিংবদন্তির মাধ্যমে। যেমন একটি বেশ প্রচলিত বিশ্বাস, বাদশা হুমায়ুন নক্সবন্দি পিরদের অপমান করার পাপেই শের শাহ সুরির কাছে পরাজিত হয়ে পৈতৃক মসনদ হারান। তাই বিদ্রোহী ঔরঙ্গজেব যখন তাঁর দাদা দারাশুকোর সঙ্গে যুদ্ধ করছেন, তখন তিনি এই নক্সবন্দিদের সমর্থন পাওয়ার চেষ্টা করেন। সে কালে অনেকেরই ধারণা জন্মেছিল যে, শাহজাহানের কোন পুত্র মসনদে আসীন হবেন, তা ঠিক করবেন আল্লা স্বয়ং। এবং তাই নক্সবন্দিদের অনুগ্রহপ্রার্থী হয়েছিলেন ঔরঙ্গজেব। তবে বাদশা হওয়ার পর তিনি আর এই তরিকার পিরদের তেমন আমল দেননি।

ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর শাহ ওয়ালিউল্লা দেহলভি ও মির দরদ-এর মতো পিরদের নেতৃত্বে নক্সবন্দিরা অনেকটা প্রভাব-প্রতিপত্তি ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হন। তত দিনে তরিকা আটটি পৃথক ধারায় বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। শাহ ওয়ালিউল্লা সেগুলিকে একত্রিত করে তরিকাটির একটি স্বতন্ত্র পরিচয় সৃষ্টি করেন। সেই সময় থেকেই এই তরিকাটি মূলত ‘মুজাদ্দিদিয়া’ নামে পরিচিত হতে থাকে।

তবে বাংলার মুশকিল আসান দরবেশদের এই সব রাজকীয় ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্ক বেশ শিথিল। উনিশ শতকের শেষে যখন অবন ঠাকুর তাঁর জোড়াসাঁকোর বাড়িতে এদের দেখছেন,তখন মোগল সাম্রাজ্য অস্তাচলে হলেও উত্তর ভারতে মুজাদ্দিদিয়া তরিকার কিন্তু একটা বেশ বর্ধিষ্ণু পরিচয় বজায় রয়েছে। কিন্তু পথচারী চিরাগধারী এক দরবেশের সঙ্গে সেই বর্ধিষ্ণু পরিচয়ের আত্মীয়তা অনেকটা বৃন্দাবনের গোস্বামীদের সঙ্গে মাধুকরী করা বাউলদের সংযোগের সমগোত্রীয়। অর্থাৎ নামমাত্র।

তবে সেটুকু সম্পর্কের অস্তিত্ব নিয়েও সন্দিহান হওয়ার কারণ আছে। বাদশা আকবর প্রবর্তিত দিন-ই-ইলাহি ধর্মের ইতিহাস আলোচনা করতে গিয়ে ১৯৫২ সালে ইতিহাসবিদ মাখনলাল রায়চৌধুরী মুশকিল আসানদের একটি সম্পূর্ণ পৃথক ইতিহাসের সম্ভাবনা প্রকাশ করেন। তাঁর মতে, মুশকিল আসানদের মধ্যেই বেঁচে আছে প্রাচীন হিন্দুদের অগ্নিপূজার ধারা। সম্ভাবনাটি অনুধাবনযোগ্য।

প্রাচীন অগ্নিপূজার সঙ্গে মুশকিল আসানদের সম্ভাব্য যোগসূত্রের চিহ্ন পার্সিদের জ়রথুস্ট্রীয় ধর্মেও লক্ষণীয়। পার্সি সম্প্রদায়ের মধ্যে আজও চালু আছে মুশকিল আসান নামের একটি অনুষ্ঠানের। অনুষ্ঠানটি বেশির ভাগ পার্সিদের মধ্যে শুক্রবার উদ্‌যাপিত হয়, কিছু ক্ষেত্রে এটি মঙ্গলবারেও পালন করার চল রয়েছে। অনুষ্ঠানটির সময় একটি রুপোর থালায় মিছরি, ছোলা, নারকেলগুঁড়ো, ফুল ইত্যাদি সাজিয়ে, একটি প্রদীপ জ্বেলে বেহরাম ইয়াজ়াদের কাছে প্রার্থনা জানানো হয়। এই ইয়াজ়াদরা হলেন পার্সি ধর্মে পরিচিত এক ধরনের দেবতা বা ফেরেস্তা। বেহরাম এঁদের মধ্যে অন্যতম। সাধারণত পার্সিরা তাঁকে ‘মুশকিল আসান’ নামে ডাকেন।

পার্সিরা মূলত অগ্নি-উপাসক এবং এঁদের প্রাচীনতম ধর্মগ্রন্থ ‘জ়েন্দ আবেস্তা’র সঙ্গে ঋগ্বেদের একটি ঐতিহাসিক সম্পর্ক সুপ্রতিষ্ঠিত। দু’টি গ্রন্থের সঙ্গে ভাষাগত মিল রয়েছে, এবং ঋগ্বেদে উল্লিখিত অনেক দেবতাদের দেখা মেলে আবেস্তাতেও। সেখানে অবশ্য তাঁরা প্রায়ই দেবতা নন, অপশক্তি। তবে সে সব আলোচনা বাদ দিলেও জ়রথুস্ট্রীয়দের মধ্যে মুশকিল আসানের পুজোর প্রচলন থেকে নিশ্চয়ই মাখনলাল রায়চৌধুরীর উল্লিখিত সম্ভাবনাটির একটি পরোক্ষ সমর্থন মেলে।

তবে প্রাচীন ধর্মীয় গ্রন্থের পরিসরের বাইরেও কিন্তু মুশকিল আসানের নানা গল্প শোনা যায়। যেমন গুজরাতে পার্সিদের মধ্যে মুশকিল আসান বিষয়ক এক ধরনের ব্রতকথার প্রচলন রয়েছে। যেমন বাংলাদেশে, তেমনই গুজরাতের পার্সিদের মধ্যে, ব্রতকথাগুলি হল শাস্ত্রীয় ধর্মানুষ্ঠান এবং লোকায়ত দৈনন্দিন ধর্মের সমন্বয় ক্ষেত্র। তাই এই ব্রতকথায় আমরা দেখতে পাই মুশকিল আসানরূপী বেহরাম ইয়াজ়াদের এক লোকায়ত অবয়ব। এই ব্রতকথাটির মূল চরিত্র হল মিশকিন নামক এক অতি দরিদ্র কাঠুরিয়া। স্মরণীয়, আরবি ভাষায় ভিখারিকে বলে মিশকিন।

মিশকিন এক দিন তার ক্ষুধার্ত কন্যার কান্না সহ্য না করতে পেরে খুব ভোরে জঙ্গলে যায়। ইচ্ছে ছিল, অনেক কাঠ কেটে তা বেচে কন্যার জন্য খাবার কিনে আনবে। অথচ সে দিন জঙ্গলে ভীষণ দাবানল। কাঠ আর কাটা সম্ভব নয়। হতাশ মিশকিন কান্নায় ভেঙে পড়ে। সেই কান্না শুনে বেহরাম-সহ পাঁচ ইয়াজ়াদ তাকে দেখা দিয়ে তার দুঃখ জানতে চায়। সব শুনে বেহরাম তার হাতে তিন মুঠো মাটি তুলে দিয়ে বলে যে, এই তিন মুঠো মাটি সযত্নে রাখলে তার সব দুঃখ দূর হবে। এবং তখন সে যেন বেহরামের এই সাহায্যের গল্প প্রচার করে। কথামতো কাজ হয়। তিন মুঠো মাটি সেই রাতেই তিনটি অমূল্য রত্নে পরিণত হয় এবং মিশকিন বিরাট ধনী হয়ে ওঠে।

এক সময় তার সঙ্গে রাজার আলাপ হয় এবং সে রাজাকে একটি বহুমূল্য রত্ন উপহার দেয়। পরে ধর্মপ্রাণ মিশকিন তীর্থে গেলে তার মেয়েকে মনে করে বেহরামের পুজো করতে বলে যায়। কন্যাটি অবশ্য তার সঙ্গিনীদের সঙ্গে খেলতে গিয়ে পুজো করতে ভুলে যায়। আর তাতেই বিপদ নেমে আসে।

রাজকন্যা তত দিনে মিশকিনের কন্যার বন্ধু। দুই বন্ধু পুকুরধারে খেলার সময় রাজকন্যার সাঁতার কাটার ইচ্ছে হয়। সে গয়নাগাঁটি খুলে রেখে, মিশকিনের মেয়েকে তার উপর নজর রাখতে বলে জলে ঝাঁপ দেয়। এই গয়নার মধ্যে মিশকিনের রাজাকে দেওয়া সেই বহুমূল্য হিরে দিয়ে বানানো একটি দামি হারও ছিল। সাঁতার কেটে উঠে রাজকন্যা দেখে হারটি নেই। সকলের ধারণা হয় যে মিশকিনের মেয়েই তা চুরি করেছে। রাজা রেগে মিশকিনের স্ত্রী-কন্যাকে কারাদণ্ড দেন ও তাদের সকল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেন।

মিশকিন তীর্থযাত্রা থেকে ফিরে, সব শুনে রাজার কাছে গিয়ে বলে যে, তার স্ত্রী-কন্যার বদলে তাকেই কারাবদ্ধ করা হোক। রাজা সম্মত হন। সেই রাতেই বেহরাম আবার তাকে দর্শন দিয়ে জানায় যে, তার সকল আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও সে বেহরামের পুজো করেনি। মিশকিন বোঝে যে, তার মেয়ে পুজো করতে ভুলে গেছে এবং বেহরামের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করে। বেহরাম দয়াপরবশ হয় তাকে আবার একটি সুযোগ দেয়। বলে, বালিশের তলায় সে কিছু পয়সা পাবে। তাই দিয়ে কোনও পথচারীকে ডেকে পুজোর সরঞ্জাম কিনিয়ে পুজো করলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।

মিশকিন আবার কথামতো কাজ করে। যে পথচারীরা তাকে অগ্রাহ্য করে তাদের অনিষ্ট হয় এবং যারা বাজার করতে সাহায্য করে তাদের নিজেদেরও ভাল হয়। ও দিকে রাজা-রানি যখন প্রাসাদের ছাদে হাওয়া খাচ্ছেন, একটি উড়ন্ত পাখির মুখ থেকে হিরের হারটি তাদের পায়ের কাছে পড়ে যায়। রাজা তাঁর ভুল বুঝতে পেরে মিশকিনকে সসম্মানে মুক্তি দেন। রানি তার পুজোর কথা শুনে নিজেও বেহরামের পুজো করেন এবং তাঁর সাতটি মৃত ভাইকে ফিরে পান।

অদ্ভুত ভাবে বিশ শতকের প্রথমার্ধে, ঢাকার বিক্রমপুর অঞ্চলের হিন্দু রমণীদের থেকে সংগৃহীত একটি ব্রতকথার সঙ্গে এই ব্রতকথাটির যথেষ্ট মিল। যদিও সেখানে কাঠুরিয়ার গল্প মাঝপথে পল্লবিত হয়েছে এক বণিকপুত্রের গল্পে, কিন্তু হিরের হার চুরি এবং সেই হার পরে একটি পাখির কাছ থেকেউদ্ধার হওয়ার বয়ানটি প্রায় এক। সব থেকে লক্ষণীয় যে, বিক্রমপুরের হিন্দু ব্রতকথাটির নামও ‘মুশকিল আসান ব্রত’।

মুশকিল আসান ব্রতটির দু’টি রূপ পৃথক ভাবে বিশ শতকের গোড়ার দিকে সংগৃহীত হয়। একটি রামপ্রাণ গুপ্তর দ্বারা ও একটি হিরণবালা দেবীর দ্বারা। রামপ্রাণ গুপ্তর সংগৃহীত কথাটিতে সরাসরি জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, “মুশকিল আসানের পূজা বিষ্ণুপূজা ভিন্ন আর কিছুই নয়।”

তাই এখানে বেহরামের জায়গায় উপস্থাপিত হয়েছে মুশকিল আসান নামধারী, ব্রাহ্মণবেশী বিষ্ণুর এক অবতার।

বাংলার জলজ পরিবেশে কাঠুরিয়া আর দাবানলের জায়গা নিয়েছে বণিকের তরী আর সমুদ্রের প্লাবন। এমনকি ‘চণ্ডীমঙ্গল’-এর সূত্র ধরে ধনপতি সদাগরেরও দেখা মেলে এই ব্রতকথাগুলিতে। একমাত্র পাখিতে হিরের হার চুরি করার বিরল ঘটনাটিই দু’টি আখ্যানের মধ্যে আত্মীয়তাসূচক। তবে গুজরাতে যেখানে পাখি উড়তে উড়তে হার ফেলে দিচ্ছে, বাংলায় সেখানে ময়ূর নাচতে নাচতে বমি করে হার বার করে দিয়েছে।

তবে পার্সি-হিন্দু আদানপ্রদানের মাঝখানে কিন্তু বাঙালি ইসলামের কথা ভোলার উপায় নেই। নক্সবন্দিয়া-মুজাদ্দিদিয়াদের আড়ম্বর বাদ দিয়ে সাধারণ মুসলমান ঘরের গৃহলক্ষ্মীদের মধ্যেও মুশকিল আসানের ব্রত উদ্‌যাপনের চল ছিল। ওয়াইজ় সাহেব জানান যে, বাঙালি মুসলমান মহিলারা এই মুশকিল আসানদের সঙ্গে যুক্ত দু’টি আচার পালন করতেন। প্রথমটি পালিত হত ইংরেজি নভেম্বর মাসের প্রতি বৃহস্পতিবার। যাঁরা এই আচার পালন করতেন, তাঁরা বৃহস্পতিবার সারা দিন উপোস করে, শুক্রবার হালুয়া এবং ‘চিৎওয়াহ’ বলে এক ধরনের মিষ্টি খেয়ে উপোস ভাঙতেন। দ্বিতীয় আচারটি পালন করা যেত যে কোনও ইসলামি মাসের সাত, সতেরো বা সাতাশ তারিখে। আচারটিকে বলা হত ‘মুশকিল কুশা’, যা মোটামুটি মুশকিল আসানেরই সমার্থক। এই মুশকিল কুশার আচারবিধির মধ্যে ছিল বাড়ির কোথাও একটি নুনের পাত্র ও কুঁজো স্থাপন করে বৃহস্পতিবার উপোস করা। উপোস ভাঙা হত জিলিপি এবং নকুলদানা সহকারে।

যদিও ওয়াইজ় সাহেব ‘ব্রত’ শব্দটির ব্যবহার করেননি, তবুও দু’টি আচারের বিবরণ থেকে মনে হয়, এগুলো সাধারণ মেয়েলি ব্রতই ছিল। এর সঙ্গে হয়তো কোনও ব্রতকথাও যুক্ত থেকে থাকতে পারে। কিন্তু ওয়াইজ় সাহেব সে কথা জানাননি।

তবে এখানেই যদি মুশকিল আসানের ইতিহাসের ইতি হত, তবে একটা বেশ পরিচ্ছন্ন আখ্যান সাজানো যেত। প্রাচীন ঋগ্বেদীয় যুগের অগ্নি-উপাসনার ছায়া কী ভাবে বিভিন্ন ধারায় বিভক্ত হয়ে বিবর্তিত হয়েছে, তাই দেখিয়ে ব্যাপারটাকে সমাধা করা যেত। কিন্তু সমকালীন ইতিহাস এমন সরল সমাধানের পক্ষপাতী নয়।

ষাটের দশকের পরে, সম্ভবত আশি-নব্বইয়ের দশকে কোনও সময়, ক্যানিং স্ট্রিটের একটি ছাপাখানা থেকে ছাপা হয় একটি চটি বই। বইটির নাম ‘মুশকিল আসান ব্রতকথা’। লেখক মহসিন পির। প্রচ্ছদে রয়েছে অবন ঠাকুরের বাল্যস্মৃতির সেই মুশকিল আসানের ছবি। কিন্তু ভিতরের গল্পের সঙ্গে গুজরাতি ব্রতকথা কিংবা বিক্রমপুরের কথার কোনও মিল নেই। এমনকি এই ব্রতকথাটি মুশকিল আসান বলে কোনও সত্তার গল্পই নয়। এই নতুন আখ্যানের উপাসনার কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছেন আসানবিবি।

যদিও বনবিবি, ওলাবিবি প্রমুখ বাংলার নানা মুসলমান দেবীস্বরূপা বিবিদের মধ্যে কদাচিৎ আসানবিবির নামও শোনা যায়, তবে তিনি যে তেমন জনপ্রিয় বিবি তা বলা চলে না। বাংলার পির-সাহিত্যের অক্লান্ত গবেষক গিরীন্দ্রনাথ দাস তাঁর দু’টি বইতে বাংলার নানা বিবি, গাজি, পির, পিরানির সন্ধান দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর লেখায় কোথাও আসানবিবির উল্লেখ নেই। বছর বিশেক আগে লোকসংস্কৃতি-গবেষক দেবব্রত নস্কর যখন দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় পালাগানের বিস্তীর্ণ ক্ষেত্রসমীক্ষা করেন, তখন তিনিও আসানবিবি সংক্রান্ত মাত্র একটিই গান খুঁজে পান। সেই একটিমাত্র গানও আবার অনেক জায়গায় ওলাবিবির গান হিসেবেই গাওয়া হয়ে থাকে।

আরও অভাবনীয় ঘটনা হচ্ছে এই নতুন ব্রতকথাটির গল্পটি। বিক্রমপুরের ব্রতকথাটিতে যেখানে সকল চরিত্রই মোটামুটি হিন্দু বলে মনে হয়, নতুনটিতে প্রত্যেকটি চরিত্রের নামই ইসলামধর্মী। আখ্যানটির অকুস্থল হল ইশা খাঁ নামক এক বাঙালি রাজার রাজত্ব। গল্পের বিষয়বস্তু কিছুটা এই রকম: মগ দস্যুদের উৎপাতের চোটে, এবং তাদের কমবয়সি মেয়ে চুরি করার প্রবণতার চোটে রাজ্যে এক অদ্ভুত আইন জারি করা হয়— কারও কন্যাসন্তান জন্মালেই সন্তানটিকে হত্যা করা হবে। তবে রাজা বহুকাল রাজত্ব করে ক্লান্ত। তিনি চান মৃগয়া করতে যেতে। এ দিকে রানি আবার অন্তঃসত্ত্বা। তাই রাজা যাওয়ার আগে তাঁর প্রিয় জ্যেষ্ঠপুত্র চাঁদ খাঁকে সিংহাসনে বসিয়ে নির্দেশ দিয়ে যান যে, রানির কন্যাসন্তান জন্মালে যেন তৎক্ষণাৎ তাকে হত্যা করা হয়।

চাঁদ খাঁ-র কিন্তু এই আইন ঘোরতর অন্যায় বলে মনে হয়। যখন সত্যিই তার মায়ের একটি কন্যাসন্তান হয়, সে শিশুটিকে হত্যা তো করেই না, বরং সারা রাজত্বে হুকুম জারি করে যে, তার বোনের কোনও রকম অনিষ্ট হলে সেই অনিষ্টের জন্য যে দায়ী, চাঁদ খাঁ নিজে তাকে বধ করবে। রাজকন্যা শিরিন তাই রক্ষা পেয়ে আদরে মানুষ হতে থাকে। চোদ্দো বছর পরে যখন ইশা খাঁ ফিরে আসেন, তখন তাঁর আইন ও হুকুম দুই-ই অমান্য করা হয়েছে দেখে তিনি ভীষণ ক্রুদ্ধ হন। তবে কন্যাকে বধ করতে গিয়েও তিনি তা করতে পারেন না, হাজার হোক বাবা তো। তাই শিরিনকে তিনি নির্বাসিত করেন। এ দিকে চাঁদ খাঁ বলে, দোষ যদি কেউ করে থাকে তো সে, অর্থাৎ চাঁদ খাঁ নিজে। বোনের কোনও দোষ নেই। এটা অবিচার। যুক্তির অকাট্যতা স্বীকার করে ইশাকে তাই তাঁর প্রিয় পুত্র চাঁদকেও নির্বাসিত করতে হয়।

নির্বাসনে ভাই-বোন কোনও মতে দিন চালায়। চাঁদ আর এক রাজার সৈন্যদলে ভর্তি হয়ে মোটামুটি উপার্জন করতে থাকে। বোনকে সে কয়েকটি পাখি কিনে দেয়। সে বলে, যত দিন শিরিন পাখিগুলিকে খাইয়েদাইয়ে বাঁচিয়ে রাখবে, চাঁদও সুস্থ থাকবে। এ দিকে শিরিন কিছু দিন বাদে পাখিগুলোকে খাওয়াতে ভুলে যায়। পাখিদের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে চাঁদও মারা যায়। তখন শোকাহত শিরিন আসানবিবির দেখা পায়। শিরিন তাঁর পুজো করায় চাঁদ তো বেঁচে ওঠেই, ইশা খাঁ-ও তাঁর পুত্রকন্যাকে ফিরিয়ে নিতেবাধ্য হন। চাঁদের কথায় ইশা কন্যা-হত্যার আইনও প্রত্যাহার করেন।

সম্প্রতি এই আখ্যানটির আর একটু বিবর্তন হয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে লেখকের নাম মহসিন পিরের জায়গায় শ্যামাচরণ ভট্টাচার্যের ছাপা হচ্ছে। দুটোর কোনও নামই ঠিক কি না সন্দেহজনক। খুব সম্ভব দু’টিই ছদ্মনাম। আখ্যানের সামান্য রদবদল হয়েছে, তবে তা এখানে আলোচনার অবকাশ নেই।

গত কয়েক দশকের এই ইতিহাসটি কিন্তু আমাদের আগের ইতিহাসটিকেও পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করে। সত্যিই কি ইতিহাসের ধারাকে প্রাচীন হিন্দু, মধ্যযুগীয় ইসলামীয় বা উনিশ শতকীয় আধুনিকতার মতো কয়েকটি ক্রমিক বর্গে সুবিন্যস্ত করা যায়? বিশেষ করে আলোচনার বিষয় যখন মানুষের বিশ্বাস বা আচার! রাষ্ট্রের ইতিহাস হয়তো বা রৈখিক হতে পারে। ধর্মের তাত্ত্বিক আলোচনারও হয়তো একটা রৈখিক মানচিত্র এঁকে ফেলা সম্ভব। কিন্তু বিশ্বাস? আচার? এ সব কি কখনও সোজা পথে চলে? সময়ই তো সেখানে বহু ঘূর্ণাবর্তে আবদ্ধ, বিবিধ জটে জড়ানো। চোখের সামনে দেখছি মুশকিল আসানের জোব্বা-জুব্বি পরা চিত্রটা ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে আসানবিবির নবকলেবরে। এর কতটা হিন্দু, কতটা পার্সি, আর কতটা মুসলমানি— কে বলে দেবে? এই একুশ শতকেও নতুন দেবী, থুড়ি বিবির, আবির্ভাব ঘটছে। একে কি প্রাচীন বলব, না অর্বাচীন?

ইতিহাসের মাপা সময়ের গণ্ডির বাইরে কত গল্প যে ধীরে ধীরে অন্য গল্পে মিলে যাচ্ছে, নিভৃতে নব রূপে রূপান্তরিত হচ্ছে, কে তার হিসাব রাখবে? আর সে হিসাবে কাজই বা কী? তার চেয়ে গল্পগুলিই বরং ভাল। ইতিহাসের ও সব বর্গীকরণের ধাঁধায় না পড়ে বরং অবন ঠাকুরের সুরে সুর মিলিয়ে বলি, “গরিব পরবৎ সেলাম। অব আগাজ কিসসেকা করতা হুন— জ়রা কান দে কে সুনো...”

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Folklore

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}