Advertisement
E-Paper

বঙ্গে ওয়াকফ ‘জবরদখল’ নিয়ে দিল্লিকে রিপোর্ট কেন্দ্রীয় সংস্থার, তালিকায় নাম মন্ত্রী ফিরহাদের, ‘হেনস্থার চেষ্টা’, বললেন মেয়র

যাঁদের বিরুদ্ধে ওয়াকফ সম্পত্তি জবরদখলের অভিযোগ গোয়েন্দা রিপোর্টে পাঠানো হয়েছে, তাঁদের মধ্যে দু’জন বর্তমান বোর্ডের সদস্য। রয়েছে মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম এবং কলকাতা পুরসভার এক কাউন্সিলরের নামও।

গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০২৫ ১০:৪৫
Share
Save

রাজ্যে ওয়াকফ সম্পত্তির ‘জবরদখল’ নিয়ে অমিত শাহের মন্ত্রকে বিশদ রিপোর্ট পাঠাল কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা (কেন্দ্রীয় আইবি)। সেই রিপোর্টে অন্তত চার তৃণমূল নেতা-নেত্রীর নাম রয়েছে। রাজ্যের মন্ত্রী তথা কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম-সহ এক সাংসদ এবং কলকাতা পুরসভার এক কাউন্সিলরের নামও রিপোর্টে রয়েছে। রয়েছে কিছু দিন আগে প্রয়াত এক বিধায়কের নামও। রিপোর্টে রয়েছে ওয়াকফ সম্পত্তি ‘ব্যক্তিগত স্বার্থে জবরদখল’ করা এবং ‘অবৈধ উপায়ে হস্তান্তর’ করার তালিকা। সংসদে ওয়াকফ বিল নিয়ে আলোচনা শুরুর আগেই ওই রিপোর্ট দিল্লিতে পাঠানো হয়েছিল বলে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রের খবর।

যাঁদের বিরুদ্ধে ওয়াকফ সম্পত্তি জবরদখলের অভিযোগ গোয়েন্দা রিপোর্টে পাঠানো হয়েছে, তাঁদের মধ্যে দু’জন বর্তমান বোর্ডের সদস্য। প্রথম জন নাসিরুদ্দিন আহমেদ। তিনি নদিয়ার কালীগঞ্জের বিধায়ক ছিলেন। গত ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি প্রয়াত হয়েছেন। কৃষ্ণনগরে ‘সাহিবুল্লা ওয়াকফ এস্টেটে’ ৩,০০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট তিনি ‘জবরদখল’ করেছিলেন বলে রিপোর্টে লিখেছে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা। ওয়াকফ বোর্ডের অপর যে সদস্যের নামে রিপোর্ট গিয়েছে, তিনি তৃণমূলের রাজ্যসভা সাংসদ নাদিমুল হক। ১০/৮, তালবাগান রোডে ওয়াকফের ২২ কাঠা জমি তিনি ‘কব্জা’ করেছেন বলে গোয়েন্দা রিপোর্টে লেখা হয়েছে।

এর পরেই এসেছে কলকাতার মেয়র তথা রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ এবং কলকাতা পুরসভার ৬৪ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর শাম্মি জাহান বেগমের নাম। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছে পাঠানো রিপোর্টে লেখা হয়েছে, ‘মহাবীরতলা মসজিদ থেকে আলিপুর পর্যন্ত বিস্তৃত জোহুরা বিবি ওয়াকফ এস্টেটের ৩৫ বিঘা জমির মধ্যে ফিরহাদ হাকিম ৫ বিঘার বেশি জমি জবরদখল করেছেন বলে জানা গিয়েছে। সেখানে তিনি একটি মার্বেল পাথরের শো রুমও চালাচ্ছেন (স্ত্রীর সঙ্গে যৌথ ভাবে)।’ আর শাম্মি জাহান হাজরা রোডে টিপু সুলতান গোরস্থানে জমি ‘জবরদখল’ করে রেখেছেন বলে লেখা হয়েছে। তবে কতটা জমি তিনি ‘জবরদখল’ করেছেন বা সে জমিকে কোন কাজে লাগাচ্ছেন, রিপোর্টে তা লেখা হয়নি।

মন্ত্রী তথা কলকাতার মেয়র ফিরহাদ অবশ্য তাঁর বিরুদ্ধে পাঠানো পুরো রিপোর্টটিকেই নস্যাৎ করছেন। আনন্দবাজার ডট কমকে মেয়র বলেন, ‘‘এগুলো সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন অভিযোগ! এ সব অভিযোগের সমর্থনে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা কোনও তথ্যপ্রমাণ দেখাতে পারবে না।’’ ওই রিপোর্ট তৈরি করানোর নেপথ্যে ‘রাজনৈতিক অভিসন্ধি’ রয়েছে বলেও মেয়রের দাবি। ফিরহাদের কথায়, ‘‘এর আগে ইডি, সিবিআইকে দিয়ে হেনস্থা করানোর চেষ্টা করেছে। তাতে লাভ হয়নি। এখন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাকে দিয়ে করানোর চেষ্টা করছে। এদের কাজই হচ্ছে হেনস্থা করা আর অমিত শাহকে সন্তুষ্ট করা।’’

মেয়র ফিরহাদের মতো ৬৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শাম্মিও অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলছেন, ‘‘এমন কোনও রিপোর্ট তৈরি হয়েছে বলে তো জানতানই না! আমি ওয়াকফ বোর্ডের কেউ নই। কোথায় কী ওয়াকফ সম্পত্তি রয়েছে, আমার সে সব জানাও নেই। জবরদখল করা তো অনেক দূরের কথা! কে কী উদ্দেশ্যে আমার নামে এ সব রিপোর্ট দিয়ে দিলেন, বুঝতে পারছি না।’’ নাদিমুলের কোনও প্রতিক্রিয়া প্রথমে পাওয়া যায়নি। খবরটি প্রকাশের পরে অবশ‍্য নাদিমুল নিজেই যোগাযোগ করে জানান, ওই জমিতে তাঁরা ভাড়াটে হিসেবে রয়েছেন। নাদিমুলের কথায়, ‘‘১৯৭২ সালে আমার বাবা ওই জায়গাটা ভাড়া নেন। ৫০ বছরেরও বেশি আগের কথা। সেই থেকে ওখানে আমরা ভাড়াটে হিসেবেই রয়েছি। আমাদের সংবাদপত্রের ছাপাখানাও ওখানেই। তবে জমির পরিমাণটা ২২ কাঠা নয়, ওটা ১০ কাঠা।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘ভাড়াটে হিসেবে থাকা কি বেআইনি? যদি বেআইনি হয়, তা হলে তো যে যেখানে যা কিছু ভাড়া নিয়ে রেখেছে, সেই সব কিছুকেই বেআইনি বলতে হবে।’’

বাম জমানায় পুলিশের কাছে জমা পড়া তিনটি অভিযোগের তথ্যও রিপোর্টে রয়েছে। তাতে এক প্রোমোটারের নাম উঠে এসেছে। সেই প্রোমোটার ফিরহাদের ‘ঘনিষ্ঠ’ বলেই কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের দাবি। রিপোর্টে লেখা হয়েছে, ‘৩০ মার্চ, ২০০৬ তারিখে পশ্চিমবঙ্গ ওয়াকফ বোর্ডের তৎকালীন সিইও জিএইচ ওবাইদুর রহমান নিউ আলিপুর থানার ওসিকে লিখিত ভাবে জানান যে, ৩২-এ টালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে জোহরা বেগম ওয়াকফ এস্টেটের জমিতে অবৈধ নির্মাণ করছেন জনৈক প্রোমোটার অজয়নারায়ণ ঘোষ এবং তাঁর সঙ্গীরা। পুলিশকে ওই নির্মাণ বন্ধ করতে বলেছিলেন সিইও। পরে ১৮ মার্চ, ২০০৮ তারিখে রাজ্য ওয়াকফ বোর্ডের তৎকালীন সিইও আরফান আলি বিশ্বাস আবার নিউ আলিপুর থানার ওসিকে লিখিত ভাবে ‘সোমনাথ লাহিড়ি সরণি, টালিগঞ্জ সার্কুলার রোড, কলকাতা’ ঠিকানায় অজয়নারায়ণ ঘোষ এবং ফিরহাদ হাকিম দ্বারা চলতে থাকা অবৈধ নির্মাণ বন্ধ করতে বলেন।’ রিপোর্টে লেখা হয়েছে, ১৫ মে, ২০০৯ তারিখে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের যুগ্ম সচিব পর্যায়ের এক আধিকারিক আবার নিউ আলিপুর থানাকে একই রকম চিঠি লিখে জোহরা বেগম ওয়াকফ এস্টেটে অবৈধ নির্মাণ বন্ধ করতে বলেন। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, ‘এত বার চিঠি লেখা সত্ত্বেও অজয়নারায়ণ ঘোষ বা ফিরহাদ হাকিমের বিরুদ্ধে কোনও এফআইআর দায়ের হয়নি। ২৮ বিঘার বেশি এলাকা জুড়ে অবৈধ নির্মাণ চলছিল। তা কিছু দিন থেমে গিয়েছিল। ২০১১ সালে তৃণমূল ক্ষমতায় আসতেই আবার কাজ শুরু হয়ে যায়।’

মেটিয়াবুরুজে নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের দান করা ওয়াকফ সম্পত্তিও ‘জবরদখল’ হয়েছে বলে এ রাজ্যে কর্মরত কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা দিল্লিকে জানিয়েছেন। রিপোর্টে যা লেখা হয়েছে, তার সারকথা— নবাবের বংশধর তথা উত্তরাধিকারীদের নিয়ে তৈরি একটি ‘ট্রাস্ট’ ওই সম্পত্তির দেখভাল করত। কিন্তু ২০২০ সালে হুমায়ুন আলি মির্জা নামে ট্রাস্টের এক সদস্য অন্য সদস্যদের মতামত না নিয়েই নতুন ‘ট্রাস্ট ডিড’ (দলিল) তৈরি করেন। সেই‘ ট্রাস্ট ডিড’কে কাজে লাগিয়ে ওই জমি একটি নবগঠিত হাসপাতাল ট্রাস্টকে ‘সাব-লিজ়’ দিয়ে দেওয়া হয়। সেই হাসপাতাল ট্রাস্টের চেয়ারম্যান ফিরহাদ। তাই রাজ্য ওয়াকফ বোর্ড কোনও নিয়ম না মেনে সেই ‘লিজ় ডিড’কে একদিনেই অনুমোদন দিয়ে দেয়।

আফাকুজ্জামান নামে ওয়াকফ বোর্ডের এক সদস্যের কথা বিশেষ ভাবে লেখা হয়েছে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টে। তিনি ফিরহাদের ‘ঘনিষ্ঠ’ এবং এই মুহূর্তে ওয়াকফ বোর্ডের ‘সবচেয়ে প্রভাবশালী সদস্য’ বলে দিল্লিকে জানিয়েছেন গোয়েন্দারা। আফাকুজ্জামান ‘অবৈধ’ ভাবে ওয়াকফ বোর্ডের সদস্য হয়েছেন বলেও দাবি করা হয়েছে। রিপোর্টে লেখা হয়েছে, আফাকুজ্জামানের নিজের নামে কোনও পারিবারিক ওয়াকফ এস্টেট নেই। তা সত্ত্বেও তাঁকে মুতাওয়াল্লিদের (বিভিন্ন ওয়াকফ সম্পত্তির তত্ত্বাবধায়ক) দ্বারা নির্বাচিত করিয়ে বোর্ডে পাঠানো হয়েছে, যা বেআইনি। আফাকুজ্জামানকে যে ওয়াকফ এস্টেটের প্রতিনিধি হিসেবে দেখিয়ে বোর্ডের সদস্য নির্বাচিত হওয়ার যোগ্য করে তোলা হয়েছে, সেই ওয়াকফ এস্টেটকে তিনি ‘অবৈধ’ ভাবে নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন বলে কেন্দ্রীয় সংস্থার রিপোর্টে লেখা হয়েছে।

কেন্দ্রীয় সরকার সম্প্রতি যে নতুন ওয়াকফ আইন তৈরি করেছে, তাতে ওয়াকফ বোর্ডে কয়েক জন অমুসলিম সদস্যের অন্তর্ভুক্তির সংস্থান রাখা হয়েছে। তৃণমূল-সহ ‘ইন্ডিয়া’ জোটের সব দল এই সংস্থানের বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টে বলা হয়েছে, এই আইন তৈরির অনেক আগে তৃণমূল শাসিত পশ্চিমবঙ্গেই ওয়াকফ এস্টেটের কমিটিতে হিন্দু পদাধিকারীদের অন্তর্ভুক্তি ঘটেছে। জলপাইগুড়ি জেলার সরবত আলি মুহাম্মদ ওয়াকফ এস্টেটের মুতাওয়াল্লি কমিটিতে সভাপতি করা হয়েছিল জনৈক সুধীররঞ্জন ধাড়াকে এবং কোষাধ্যক্ষ করা হয়েছিল জনৈক শঙ্করপ্রসাদ সেনকে। ওই ওয়াকফ এস্টেটের মূল্য হাজার কোটি টাকা বলেও রিপোর্টে জানানো হয়েছে।

তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের তৈরি করা এই রিপোর্টে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি ভূমিকার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। লেখা হয়েছে যে, ১৯৯৬ সালে মমতা যখন দক্ষিণ কলকাতার কংগ্রেস সাংসদ, সে সময়ে তিনি সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিকে চিঠি লিখে পশ্চিমবঙ্গে ওয়াকফ সম্পত্তি নয়ছয়ের অভিযোগ জানিয়েছিলেন। তার ফলে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন সরকার কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি গীতেশরঞ্জন ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে তদন্ত কমিশন গঠন করে। তৎকালীন বাজারদর অনুযায়ী এক হাজার কোটি টাকা মূল্যের ১৬০টি ওয়াকফ সম্পত্তি লিজ় দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রচুর অনিয়ম করা হয়েছে বলে মমতার সেই চিঠিতে উল্লেখ ছিল। বিচারপতি ভট্টাচার্যের নেতৃত্বাধীন কমিশন ২০০১ সালের ৩১ ডিসেম্বর তদন্ত রিপোর্ট জমা দিয়ে অনিয়মের অভিযোগেই সিলমোহর দিয়েছিল বলেও কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের সাম্প্রতিক রিপোর্টে লেখা হয়েছে।

Waqf Bill IB Report Mamata Banerjee West Bengal Politics WAQF Amendment Bill

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}