শেষের কবিতা?
বয়স এখন ৭১ বছর। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে এখনও যে সামান্য কয়েক জন নাম ধরে সম্বোধন করেন, তিনি তাঁদের একজন। তৃণমূলের প্রবীণদের মধ্যে তিনি অন্যতম। দলের অন্দরে নবীন-প্রবীণ দ্বন্দ্বে তিনি উত্তর কলকাতায় টিকিট পাবেন কি পাবেন না, তা নিয়ে একটা জল্পনা তৈরি হচ্ছিল বটে। কিন্তু সুদীপ বড় প্লেয়ার। থার্ড আম্পায়ারকে সঙ্গে নিয়ে সেই সম্ভাবনাকে মাঠের বাইরে ফেলে দিয়েছেন। কিন্তু এটাই কি সুদীপের শেষ নির্বাচন? প্রবীণ নিজে কিছু বলেননি। তবে থার্ড আম্পায়ার বলেছেন, “আগামী দিন সুদীপদা আর দাঁড়াবেন কি না জানি না! আপনারা এ বার ওঁকেই ভোটটা দেবেন।”
সাইকেল জ্যাকসন
জন্ম মুর্শিদাবাদে। বহরমপুরের বিখ্যাত কেএন কলেজ থেকে পড়াশোনা। সেখানেই ছাত্র রাজনীতি করতে করতে রাজনৈতিক যাত্রা শুরু। সেই যাত্রা লম্বা হতে হতে জাতীয় রাজনীতি পর্যন্ত পৌঁছেছে। কিন্তু এখনও ‘অধীরপুর’-এর প্রবীণেরা কোনও এক ‘সাইকেলকাণ্ড’ নিয়ে রসিকতা করেন। যদিও আড়ালে-আবডালে। যেমন বহরমপুরে সুদীপের এক প্রাক্তন সতীর্থ বললেন, আমরা তো তখন দু’জনকেই চিনতাম— মাইকেল জ্যাকসন আর সাইকেল জ্যাকসন!
বৌবাজার ১
প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির হাত ধরে কলকাতায় আগমন সুদীপের। সেই সুবাদেই রাজ্য যুব কংগ্রেসের সভাপতি। পরে যে পদে আসবেন মমতা। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি থাকাকালীন ১৯৮৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনে আব্দুল রউফ আনসারির বদলে বৌবাজার কেন্দ্র থেকে সুদীপকে টিকিট দেয় কংগ্রেস। তখন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রিয়রঞ্জন। সে ঘটনা নিয়ে প্রদেশ কংগ্রেসের মধ্যে তোলপাড় হয়েছিল। সেই নির্বাচনে বৌবাজার থেকে জিতে প্রথম বিধায়ক হন সুদীপ। বৌবাজার থেকেই তাঁর পরিষদীয় ও সংসদীয় রাজনীতির যাত্রা শুরু।
বৌবাজার ২
১৯৮৭-১৯৯৮ পর্যন্ত টানা বৌবাজারের কংগ্রেস বিধায়ক ছিলেন সুদীপ। ১৯৯৮ সালে মমতা তৃণমূল তৈরি করেন। সুদীপ কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দেন। ১৯৯৮ সালের লোকসভা ভোটে কলকাতা উত্তর-পশ্চিম লোকসভা আসনে তৃণমূলের প্রার্থী হন সুদীপ। জিতে সাংসদ হন। তাঁর ছেড়ে যাওয়া বৌবাজার কেন্দ্রের উপনির্বাচনে জিতে বিধায়ক হন সুদীপের বৌ নয়না বন্দ্যোপাধ্যায়!
প্রমোদে ঢালিয়া দিনু মন
১৯৯৮ এবং ১৯৯৯— পর পর দু’টি লোকসভা ভোটেই জেতেন সুদীপ। আশ্চর্য নয় যে, তিনি চেয়েছিলেন কেন্দ্রে একটা মন্ত্রী-টন্ত্রী হতে। তৃণমূলে অন্দরে সকলেই জানেন (যদিও প্রকাশ্যে বলা নৈব নৈব চ) সুদীপ মমতাকে হালকা ‘ডজ’ করে লালকৃষ্ণ আডবাণীর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন। এ-ও শোনা যায় (যদিও তৃণমূলে প্রকাশ্যে বলা যায় না) যে, মন্ত্রী হওয়ার জন্য বাজপেয়ী মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ এবং ওজনদার সদস্য প্রমোদ মহাজনের সঙ্গেও লাইন খুলেছিলেন। কিন্তু দিদির কানে কে বা কারা ‘বিষ’ ঢালে। মমতা স্পষ্ট জানিয়ে দেন, তাঁর দল থেকে কে মন্ত্রী হবেন বা হবেন না, সেটা তিনিই ঠিক করবেন।
মোম জোছনা
মমতাকে এড়িয়ে দিল্লিতে লাইন খুলতে গিয়ে ‘বেলাইন’ হয়ে পড়েন সুদীপ। ২০০৪ সালে তাঁকে আর কলকাতা উত্তর-পশ্চিমে টিকিট দেননি মমতা। প্রার্থী করেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়কে। কিন্তু ভোটের ভবি অত সহজে ভোলে না। অতএব সুদীপ ‘জোড়া মোমবাতি’ প্রতীক নিয়ে নির্দল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন লোকসভা ভোটে। হারেন। যেমন হারেন সুব্রতও। সেই কাটাকুটির খেলায় জিতে যান সিপিএমের সুধাংশু শীল। আর ‘দলবিরোধী’ কার্যকলাপের জন্য সুদীপকে ছ’বছরের জন্য সাসপেন্ড করে তৃণমূল।
ঘর ওয়াপসি
তৃণমূল সাসপেন্ড করার পরে সুদীপ তাঁর ‘ঘরে’ ফিরে যান। অর্থাৎ, কংগ্রেসে। ২০০৬ সালের বিধানসভা ভোটে বৌবাজার থেকেই তাঁকে প্রার্থী করে কংগ্রেস। সুদীপ জিতে বিধায়ক হন। তবে কংগ্রেসের বিধায়ক থাকতে থাকতেই মমতার দিকে ‘হাত’ বাড়াতে শুরু করেছিলেন তিনি। ধুরন্ধর রাজনীতিক সুদীপ জানতেন, বাংলায় রাজনীতি করতে গেলে মমতাই ‘সেরা বাজি’। অতঃপর বাংলা দেখিল, ২০০৯ সালে উত্তর কলকাতা লোকসভা আসনে আবার তৃণমূলের প্রার্থী সেই একমেবাদ্বিতীয়ম বন্দ্যো সুদীপ। সেই থেকে উত্তরের ‘উত্তর’ তিনিই।
ও মন্ত্রীমশাই!
বহু দিন মনে ছিল আশা। কেন্দ্রে মন্ত্রী হওয়ার। সেই বাসনা পূরণ হয়েছিল ২০১১ সালে। বাংলায় পালাবদলের পর মুখ্যমন্ত্রী হন মমতা। তাঁর হাতে থাকা রেল মন্ত্রক পান দীনেশ ত্রিবেদী। আর দীনেশ যে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন, সেখানে জায়গা পান সুদীপ। তবে তাঁর কেন্দ্রীয় মন্ত্রিত্ব বেশি দিন থাকেনি। ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে ইউপিএ-২ সরকারের সঙ্গে মতবিরোধে জোট ছাড়েন মমতা। (প্রতি)মন্ত্রিত্বও শেষ হয়ে যায় সুদীপের।
বক বকম
২০১৭ সালের শুরুতে রোজ় ভ্যালি মামলায় গ্রেফতার হন সুদীপ। তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় ভুবনেশ্বরে। ১৩৬ দিন কারাবাস করতে হয়েছে তাঁকে। তার পরে জামিন পেয়েছেন। যদিও কুণাল ঘোষের মতো তাঁর ‘হিতৈষী’রা বলেন, জেলের চেয়ে সুদীপ বেশি সময় ছিলেন ভুবনেশ্বরের এক বেসরকারি হাসপাতালে। তার বিল-টিল নিয়েও চিন্তা ব্যক্ত করেছেন কুণাল। তবে সুদীপ জামিন পাওয়ার পরে সেরা মন্তব্য করেছিলেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়, ‘‘সুদীপ কাক হয়ে ঢুকেছিল। বক হয়ে বেরিয়েছে!’’ কারণ সহজবোধ্য— কারান্তরালে সাদা চুল-দাড়িতে কলপ করানো যায়নি। তার পর থেকে অবশ্য সুদীপ ‘বক’ই রয়েছেন।
কোট-আনকোট
অটলবিহারী বাজপেয়ীর জমানায় আডবাণীর সঙ্গে সুদীপের বিশেষ সখ্য ছিল। নরেন্দ্র মোদীর জমানায় স্বয়ং মোদীর সঙ্গেই নাকি তাঁর দারুণ যোগাযোগ। সংসদে মোদীর জ্যাকেট দেখে সুদীপ আহ্লাদ প্রকাশ করায় স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী মোদী নাকি তৃণমূলের লোকসভার নেতাকে কোট বানানোর কাপড় উপহার পাঠিয়েছিলেন। যদিও তাপস রায়েরা বলেন, সুদীপ আবদার জুড়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী ‘ছিটকাপড়’ পাঠিয়ে দিয়েছেন। তবে এই আখ্যানের পিঠোপিঠি অন্য আখ্যানও আছে। আসলে নাকি সুদীপের জহরকোট দেখে মোদীর ভাল লেগেছিল। শুনে সুদীপই সেই কাপড় পাঠিয়েছিলেন মোদীর জন্য। মোদী আবার তা দিয়ে জ্যাকেট বানিয়ে সংসদে একটি অনুষ্ঠানের ফাঁকে প্রকাশ্যেই সুদীপকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন। তাতে নাকি সুদীপ একটু ‘অস্বস্তি’তেই পড়ে যান। তবে এ বিষয়ে কারও কোনও উদ্ধৃতি (কোট) পাওয়া দুষ্কর!
‘লাল পাগুড়ি বেঁধে মাথে’
মান্না দে’র বিখ্যাত গান। সুর সুধীন দাশগুপ্তের। ছবির নাম ‘ডাকহরকরা’। ভোটের প্রচারে নেমে অবাঙালি এলাকায় গেলেই সুদীপের মস্তক শোভিত লাল ঝকমকে পাগড়িতে। হালকা অবাঙালি ছোঁয়া। আবার বাঙালিপাড়ায় তিনি চিরপরিচিত জোড়হাত, হাসিমুখ। হাজার হোক, তিনি তো আসলে এক ‘হরকরা’ই বটে। ‘মমতার ডাক’ নিয়ে যিনি পৌঁছে যাচ্ছেন দোরে দোরে।
রেখাচিত্র: সুমন চৌধুরী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy