মহাভারতের শেষের দিকে ঘটনা। যাদবদের দ্বারকায় এসেছেন তিন প্রাজ্ঞ ঋষি: বিশ্বামিত্র, কণ্ব আর নারদ। দ্বারকার ছেলেছোকরার দল তখন বেজায় উজিয়েছে। এরা তো আর খেটে-খাওয়া মানুষ নয়। আহারবিহারের প্রাচুর্য তাদের জীবনে যথেষ্ট। দায়িত্বজ্ঞানহীন রগড় করার সময়-সুযোগ দুইই তাদের আছে। হাসি-রঙ্গ ছাড়া আর কোনও কাজে বা ভাবনাতে আর মনই বসে না। সব কিছু নিয়ে রসিকতা করাই তাদের অন্যতম বিনোদন। তিন ঋষিকে একসঙ্গে দেখে তাদের বেজায় আমোদের শখ হল। কৃষ্ণের ছেলে শাম্বকে মেয়ে সাজিয়ে প্রবীণ ঋষিদের কাছে নিয়ে এল তারা। বলল, ‘এ হল বভ্রুর পত্নী। বলুন তো এ কী প্রসব করবে?’ ঋষিরা নির্বোধ নন, কোনও মানুষের শারীরিক ও সামাজিক সামর্থ্য কতটা, কর্তব্যই বা কী, এই সব ভেদ ও সামঞ্জস্য বিষয়ে তাঁদের জ্ঞান প্রখর। তাই অর্বাচীনদের রসিকতায় ক্রুদ্ধ প্রাজ্ঞেরা অভিশাপ দিলেন: ‘শাম্ব মুষল প্রসব করবে। আর সেই মুষলই হবে যদুবংশের পতনের কারণ।’ অতঃপর প্রভাস তীর্থে যদুবংশীয় জমায়েত। মাতাল হয়ে ভব্যতা সভ্যতা ভুলে তারা পরস্পরকে ক্রমাগত উপহাস করতে লাগল। ণত্ব-ষত্ব জ্ঞান তখন তাদের একেবারেই লোপ পেয়েছে। রসিকতা, মত্ত উপহাস থেকে ক্রমে কথা কাটাকাটি। তার পর শুরু হল একে অন্যের সঙ্গে লড়াই। কৃষ্ণের সামনেই সাত্যকি কৃতবর্মার মাথা কেটে ফেলল। শুরু হয়ে গেল মুষল নিয়ে ভয়ংকর হানাহানি। মুষল এল কোথা থেকে? কালীপ্রসন্ন সিংহের ভাষায়, ‘ওই স্থানের সমুদয় এরকাই
বাঙালি নাগরিক সমাজ এখন প্রায় রোজই কিছু না কিছু রগড়ের ‘খোরাক’ পেয়ে যাচ্ছে। শীতের সন্ধেগুলো অমনি গুলতানি-মশগুল। সোশ্যাল নেটওয়ার্কে হাসি, ঠাট্টা, মশকরার বান ডাকছে। কত রকম যে শ্লেষ, ভাঙা, আধভাঙা। সারদা কাণ্ডে যাঁরা বিচারাধীন, জেলে গেছেন তাঁদের নিয়ে হরেক মজা, রঙ্গ। কে যে কত রকম উদ্ভাবনী শক্তি দেখাতে পারেন তার ঠিকঠিকানা নেই। কেউ বলছেন, সারদা কাণ্ডে যাঁরা জেলে গেছেন তাঁদের জাতীয় সংগীত ‘কারার ঐ লৌহকপাট/ ভেঙে ফেল কর রে লোপাট’, কেউ লিখছেন রবীন্দ্রনাথের সহজ পাঠের লাইন মনে পড়ছে, ‘সঙ্গে যে যায়
এবং ভাবতাম, এ কোন পশ্চিমবঙ্গ? এ কোন বাঙালি? টাকাপয়সা, বড়লোকি, এ-সবের জন্য তো ‘অপর’ ভারতীয়রা আমাদের সমীহ করত না। শিক্ষা, সংস্কৃতি, ভদ্রতা, সৌজন্য, সততা ইত্যাদির জন্য ‘জাতি’ হিসেবে বাঙালি অন্য প্রদেশের মানুষদের কাছে স্বীকৃতি পেয়েছিল। এই শিক্ষা-সংস্কৃতি-সততার জন্য বাঙালির গোপন ও প্রকাশ্য দেমাকও কিছু কম ছিল না। বাঙালি পরশুরাম চুরি শেখানোর ইস্কুল নিয়ে ‘মহাবিদ্যা’ নামে একটি গল্প লিখেছিলেন। মহাবিদ্যা শেখানোর ইস্কুলে প্রথম শ্রেণির ছাত্র যাঁরা, তাঁরা হোমরাও সিং, চোমরাও আলি, খুদীন্দ্রনারায়ণ, মিস্টার গ্র্যাব, মিস্টার হাউলার... খুদীন্দ্রনারায়ণ বাঙালি জমিদার বলে মনে হয়, বাকিরা নাম ও পদবির নিরিখে অবাঙালি। পেশায় মহারাজা, নবাব, বণিক, সম্পাদক। বাঙালির মধ্যে চোর নেই তা নয়, তবে এ-সব জিনিসের অতিকায় মূর্তি অন্য প্রদেশে যতটা দেখা গিয়েছে, বঙ্গদেশে সেটা সুলভ ছিল না। সেই ‘অক্ষমতা’ নিয়ে আমাদের একটা গর্বও ছিল বইকী।
বাঙালির সেই দেমাক আর রইল না। গোটা দেশ পশ্চিমবঙ্গের দিকে তাকিয়ে এখন হাসছে। মনে মনে ভাবছে, কী, কেমন! আমাদের তো খুব বলতে! এখন তোমাদের সততা, শিক্ষা, সংস্কৃতির বেলুন তো ফুটো হয়ে গেল। এই প্রথম পশ্চিমবঙ্গের কোনও ক্ষমতাসীন মন্ত্রীর, তদুপরি ক্যাবিনেট মন্ত্রীর, হাজতবাস হল। এ বড় উল্লাসের সময় নয়।
জবাবে কোনও নাগরিক যদি বলেন, ‘রাজনীতিবিদরা রাজনীতিবিদ, আমরা শিক্ষিত নাগরিক সমাজ; আমরা আমরা, ওরা ওরা’, তা হলে তার চেয়ে পিঠ বাঁচানো কথা কিন্তু আর হয় না। এই রাজনীতির জন্ম তো শূন্য থেকে হয়নি। পশ্চিমবঙ্গে কেবল লুম্পেন আর প্রোলেতারিয়েত মিলেমিশে যায়নি, অনেকটা সময় ধরে পার্টিরাজ লুম্পেনকে প্রোলেতারিয়েত বলে ভাবতে চেয়েছে। সুবিধেবাদের ও পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি বাঙালি ভদ্রলোকের স্বাভাবিক সৌজন্যবোধকে নষ্ট করেছে, নীতিকে তাঁরা জলাঞ্জলি দিয়েছেন। তারই পরিণাম এখনকার এই রাজ্য রাজনীতি।
তাই এটা ইন্টারনেটের সামনে অলস ভাবে বসে রসিকতার সময় নয়, এটা গভীর এবং তীব্র বিষাদের সময়। মা কী ছিলেন, মা কী হয়েছেন! বাঙালি কী ছিল, বাঙালি কী হয়েছে! এই বিষাদ থেকে যে ন্যায়সংগত ক্রোধের জন্ম হয়, এখন সেই ক্রোধের সময়। কিন্তু বাঙালি এখন আর বিষণ্ণ বা ক্রুদ্ধ হয়ে নিজের হ্যাপিনেস নষ্ট করার বান্দা নয়। সে মশকরা করে পিঠ বাঁচিয়ে নাগরিক সমাজ নিজেদের ‘খারাপ’ রাজনীতি থেকে আলাদা করে রাখবে। কিন্তু রাজপুরীতে আগুন লাগলে নগর বাঁচবে কি? এই রসিকতাকে তাই এখন বড় ‘আত্মঘাতী’ মনে হচ্ছে। একটা জাত সংকটের সময় স্রেফ তামাশা করে কাটিয়ে দিলে মুষলপর্বের স্মৃতি কেন বাধ্যতে।
বিশ্বভারতীতে বাংলার শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy