মার্ক জুকেরবার্গের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদী। ছবি: রয়টার্স।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে সম্প্রতি রাজধানীতে বৈঠক করলেন ফেসবুকের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জুকেরবার্গ। আলোচনা হল ফেসবুককে সন্ত্রাসবাদীদের অপব্যবহার থেকে বাঁচাতে হবে এবং ভারতের পর্যটনের বিকাশে ফেসবুকের সাহায্য চাইলেন মোদী। সন্দেহ নেই, ফেসবুককে সামাজিক মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করতে বিশেষ ভাবে তত্পর নরেন্দ্র মোদী। আর সেটা বেশ কিছু দিন থেকেই। ফেসবুকের নেতিবাচক দিক যা-ই থাকুক, ফেসবুক, ওয়াটস আ্যাপ এবং টুইটারের ইতিবাচক বাস্তববাদী প্রয়োজনীয়তা আজ অনুভব করেন অধিকাংশ ভারতবাসী। ৭০টিরও বেশি ভাষায় এবং ৫০০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করেন গোটা পৃথিবীতে।
ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা এবং সিইও মার্ক জুকেরবার্গ এই অসাধ্যসাধন কী ভাবে করলেন? হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মাত্র ১৯ বছরের এক ছাত্র কী ভাবে এ রকম একটি সংস্থা খুললেন তা এক অসাধ্যসাধনের কাহিনি। ডেভিড কিকপ্যাট্রিকের ‘দ্য ফেসবুক এফেক্ট’ বইটি থেকে জানা যায় এক নয়া সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণের কাহিনি। এক ফেসবুক সাম্রাজ্য।
দেরিতে হলেও এই প্রতিবেদক ফেসবুক-ইন্টারনেট জগতে প্রবেশ করে বুঝতে পেরেছেন, যাঁরা এই ফেসবুকের সমালোচনায় মুখর, নানা সম্পাদকীয় স্তম্ভে ফেসবুকের মাধ্যমে বন্ধুদের আত্মরতিক্রিয়ার নির্মম সমালোচনা করেন সে সব সীমাবদ্ধতা অস্বীকার না করেও বলছি, ফেসবুক যোগাযোগের এক অসাধারণ আধুনিক মাধ্যমও বটে। উদাহরণ দিই: ফেসবুকের মাধ্যমেই পরিচয় হল লেখক ও ভাবুক রামকৃষ্ণ ভট্টচার্যের সঙ্গে। কলকাতা থেকে ১৫০০ কিলোমিটার দূরে বসেও জানতে পারলাম তাঁর রচিত চাপড়ঘণ্ট বা দোতলা বাস-এর মতো বইয়ের কথা। কলকাতা থেকে বই দু’টি আনিয়ে পড়লাম। বই দু’টি পড়ে যুগপত্ মুগ্ধ ও বিস্মিত হলাম। কলকাতা-সহ বাংলার এ হেন ইতিহাস, এ হেন সরস ভঙ্গিতে লেখা, শিবরাম চক্রবর্তীর সঙ্গে ঘনাদার কল্পিত সাক্ষাত্কার থেকে মালদহের ইতিহাস, কুশারী পরিবার থেকে রবীন্দ্রনাথ, আর সেখান থেকে বারেন্দ্র-রাঢ়ী সংঘাতও— অজস্র মণিমুক্তো ছড়ানো বই। কবীর সুমন তো ভূমিকায় উদ্ভাসিত। বৃহত্ সংবাদপত্রে এই রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের পরিসর থাক বা না থাক, ফেসবুক তাঁকে এক নিজস্ব পরিসর এ জীবনে দিয়েছে। এমনই আর এক চরিত্র প্রবীণ সাংবাদিক শঙ্কর রায়। মার্কসবাদী অন্বেষার এ হেন অধ্যবসায় ও উদ্যম আজকাল বিরল। লিটল ম্যাগাজিনের যেমন একটি পরিসর ছিল এবং আজও আছে। এই পরিসরটি ফেসবুক পরিসরের সঙ্গে সংঘাতের নয়। একে অন্যের পরিপূরক।
দিল্লিতে সে দিন ইন্ডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারে এক অভিজাত আমলা বললেন, ফেসবুক ডাউন মার্কেট। আমি শুধু টুইটার ফলো করি। আমি বললাম, দু’টির মধ্যেও শ্রেণি সংঘর্ষ কেন তৈরি করছেন? দু’টো দু’রকম। ট্যুইটারে শব্দের সীমাবদ্ধতা আছে, ফেসবুক ও ওয়াটস আ্যাপের তো তফাত্ আছে। তা ভদ্রলোক বললেন, না, ফেসবুক মানেই যৌনতা, অবৈধ সম্পর্ক পাতানো, আজেবাজে চ্যাট, প্রেমালাপ— এটা নন সিরিয়াস মাধ্যম। আর কিছু মানুষ নিজের অতৃপ্ত কামনা-বাসনা পূরণের মাধ্যম হিসেবে এটিকে ব্যবহার করছেন। নিজের ছবি দিয়ে আত্মপ্রচারের নার্সিসিজম। শোন হে বন্ধু, আজ আমি প্রেমে পড়লাম, শোন, আজ আমার খুব মনখারাপ, আজ আমার জ্বর হয়েছে, অথবা বল তো, এই শাড়িতে আমাকে কেমন লাগছে? অথবা, আজ রবিবার, দ্যাখো, আমি ইলিশ মাছ খাচ্ছি।
এ ব্যাপারে আমার অভিমত ভিন্ন। প্রথমত, ফেসবুকে বিপুল জনসমাজকে বন্ধু করার প্রাথমিক লক্ষ্য নয়, ফেসবুকই এই উপদেশ দেয়, তার কাছেই বন্ধুত্বের প্রস্তাব যাকে আপনি চেনেন তা নয় যিনি আপনাকে চেনেন। কাজেই বন্ধুর সংখ্যা আপনি সীমিত রাখতে পারেন। সেই ছোট্ট গণ্ডিতে নিজেদের কথা একে অন্যকে জানাতে পারেন, যেমন ওয়াটস অ্যাপেও ছোট ছোট বন্ধু গোষ্ঠী করা যায় এবং করা হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, কোনও কিছুই বাড়াবাড়ি ভাল নয়। ভারসাম্যহীনতা অনুচিত। কিন্তু অতীতে বন্ধুরা এক জন অন্য জনের বাড়িতে আসতেন অনেক বেশি। তখন ছুটির দিনে আত্মীয়-স্বজন বন্ধুবান্ধবেরা এলে খাওয়া-দাওয়ার পর অ্যালবাম খুলে দেশে-বিদেশে আমাদের ভ্রমণের ছবি দেখানোর রেওয়াজ ছিল। আজ এই ভার্চুয়াল রিয়েলিটির যুগে রবিবার বাড়িতে আত্মীয়স্বজন বন্ধু-পরিজনের আসার সময় যেমন কমেছে, তেমনই বেড়েছে ফেসবুকের মাধ্যমে এক জনের আরও এক জনের কাছে পৌঁছনোর অজুহাত। এতে কোনও অন্যায় দেখি না। কোনও কোনও ক্ষেত্রে নান্দনিক ভারসাম্য বিঘ্নিত হলে সেটা সেই ব্যক্তি-বন্ধুটির সমস্যা। ফেসবুকের সমস্যা নয়।
ন্যাশনাল বুক ট্রাস্টের বাংলা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত সম্পাদক অরুণ চক্রবর্তী তো ফেসবুকেই আত্মজীবনী লিখতে শুরু করেছেন। পুরনো ছবি আর আজকের স্মৃতি দিয়ে তিলতিল করে গড়ে উঠছে এক অনবদ্য সামগ্রিক রচনা। খণ্ড খণ্ড চিত্র থেকে গড়ে উঠছে এক অখণ্ড চালচিত্র। বাংলাদেশ থেকে কলকাতা, নানা স্মৃতির মালা গাঁথছেন তিনি। বর্তমানে সাউথ ব্লকে কর্মরত ফরেন সার্ভিসের ভারতীয় কূটনীতিক নভতেজ সারনা কর্মসূত্রে ওয়াশিংটনে থাকার সময়ে ফেসবুকে তাঁর কথোপকথনের ভিত্তিতে লিখে ফেলেছিলেন একটি উপন্যাস।
আসলে বিজ্ঞান যখন এগোয় তখন নানা অপব্যবহারও তার সঙ্গে সঙ্গে বিকশিত হয়। টেলিভিশন যখন প্রথম আসে তখনও এমনটাই হয়েছিল। ধীরে ধীরে টেলিভিশনের ব্যবহার শিখলাম আমরা। টেলিভিশন চললেও সব সময় যে আমি তা দেখতে বাধ্য নই, এই মানসিকতা গড়ে তোলা আবশ্যিক ছিল। মোবাইল সংস্কৃতিতেও এ কথা প্রযোজ্য। তাই ফেসবুকের ক্ষেত্রেও এই কী করিব আর কী করিব না এটা মেনে চললেই হয়। জল তো কল দিয়ে সারা ক্ষণ পড়ে, আমরা তো শুধু স্নানের সময়েই কল খুলি। সারা দিন অপ্রয়োজনে কল খুলে রাখি না।
তাই ফেসবুক প্রতিষ্ঠাতা মার্ক যখন ভারত সফরে এলেন, তখন আমার ৫২ বছর বয়সে আমি তাঁকে বলেছিলাম, “আই স্যালুট ইউ। জ্ঞানের এক নতুন জগত আপনি আবিষ্কার করেছেন!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy