Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪
প্রবন্ধ ১

কত্তাবাবুর কমিটি

ভাল ভাল কথাগুলো শুনতে শুনতে মেয়েরা কখন ভাবতে শুরু করেছে, শরীরটা আমার, যৌনতা আমার, জীবনটাও আমার। স্বাধীনতাকে তারা নিতান্ত স্বাভাবিক প্রাপ্য বলে মনে করছে। আর অমনি তাদের ওপর নেমে আসছে দুঃশাসন। স্বাতী ভট্টাচার্যকাঁচা বাংলায় একটা কথা রয়েছে যা ভদ্র ভাষায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, মাথায় যার লম্বা ঘোমটা তার পশ্চাদ্দেশ উন্মুক্ত। বিশ্বভারতী এবং যাদবপুরের উনিশ-কুড়ি বছরের দুটো মেয়ে দেখিয়ে দিল, নারী অধিকারের প্রশ্নে এ রাজ্যের ওই একই দশা।

শেষ আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

কাঁচা বাংলায় একটা কথা রয়েছে যা ভদ্র ভাষায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, মাথায় যার লম্বা ঘোমটা তার পশ্চাদ্দেশ উন্মুক্ত। বিশ্বভারতী এবং যাদবপুরের উনিশ-কুড়ি বছরের দুটো মেয়ে দেখিয়ে দিল, নারী অধিকারের প্রশ্নে এ রাজ্যের ওই একই দশা। এ দিকে মেয়েদের উপর নির্যাতন নিয়ে মাসে পাঁচটা-সাতটা করে সেমিনার-ওয়ার্কশপ, তার প্রতিরোধে হ্যান কমিশন, বিচারের জন্য ত্যান কমিটি, নিপীড়নের রকমফের নিয়ে গবেষণার জন্য উইমেন্স স্টাডিজ সেন্টার, জেন্ডার স্টাডিজ ডিপার্টমেন্ট— আয়োজনের অন্ত নেই। অথচ যেটা একেবারে গোড়ার কাজ— একটি মেয়ে নির্যাতনের অভিযোগ করলে তদন্তটা ঠিক মতো করা— সেটুকু হচ্ছে না। দুই ছাত্রীই অভিযোগ করেছেন, তদন্ত যাঁরা করছেন তাঁরা বার বার আপত্তিকর প্রশ্ন করছেন, অসঙ্গত প্রস্তাব দিচ্ছেন, ভয় দেখাচ্ছেন, চাপ দিচ্ছেন। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা হওয়ার আগে অভিযোগকারীই জেরবার হয়ে যাচ্ছেন।

এ অবশ্য নতুন নয়। শ্লীলতাহানির অভিযোগ করা মানে কাচ-ছড়ানো রাস্তায় খালি পায়ে হাঁটা। পা কাটলে তোমারই দোষ। কে বলেছিল তোমায় ওই রাস্তায় হাঁটতে? অসম্মানের অভিযোগ তুললে তোমাকেই অসম্মানিত হতে হবে। বাসে কোনও মেয়ে ‘কী করছেন?’ বলে চিৎকার করলে পাল্টা আক্রমণ আসে, ‘কী করেছি, বলুন?’ মায়ের কাছে নালিশ করে শিশুকন্যা শুনেছে, ‘আর কারও সঙ্গে করল না, তোর সঙ্গেই করল?’ কলেজে শুনতে হয়েছে, ক্লাসে ফাঁকি দিয়ে নম্বর বাড়ানোর ফিকির। অফিসে বলা হয়েছে, কাজ পারে না, গল্প বানাতে পারে। বাড়াবাড়ি। সেন্স অব হিউমার নেই। অ্যাডজাস্ট করতে শেখেনি। স্কুল থেকে শ্বশুরবাড়ি, থানা থেকে আদালত, এই কোরাস চলছে।

তা-ই যদি হবে, তা হলে দু’দশক আন্দোলন করে যৌন নির্যাতন প্রতিরোধের জন্য কমিটি বাগিয়ে হলটা কী? বাইশ বছর আগে এই সেপ্টেম্বর মাসেই রাজস্থানে ভাঁওরি দেবী ধর্ষিত হ’ন। যার জেরে প্রথমে সুপ্রিম কোর্টের ‘বিশাখা নির্দেশিকা’ (১৯৯৭), পরে ‘কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ আইন’ (২০১৩) তৈরি হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের যে অভ্যন্তরীণ অনুসন্ধান কমিটির কাছে ওই দুই ছাত্রী অভিযোগ করেছে, তা সেই লড়াইয়ের ফল।

আজ দেখা যাচ্ছে কমিটি হয়েছে, কমিশন হয়েছে, সে সবে মহিলা সদস্যরাও রয়েছেন, কিন্তু বোল বদলায়নি। যৌথ পরিবারের পিসি-কাকি যে কথাগুলো বলেন, পোশাকি ভাষায় সেগুলোই বলছে কমিটিরা। পিসি যাকে বলতেন ‘ঢং’, কমিটি তাকে বলে ‘কোয়েশ্চেনেবল বিহেভিয়ার।’ পিসি নিদান হাঁকতেন, ‘ফের ও-দিকে গেলে হাড় গুঁড়ো করে দেব।’ আর কমিটি বলে, ‘কোর্স শেষ হয়ে যাওয়ার পর এই ভবনের সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখবে না।’ (শিক্ষকের বিরুদ্ধে অশালীনতার অভিযোগ আনায় ছাত্রীকে এই ‘অর্ডার’ দিয়েছে একটি বিশ্ববিদ্যালয়, গত বছর ১৪ সেপ্টেম্বর)। ভারী সুবিধে। নিয়মরক্ষাও হল, কত্তাবাবুর মুখরক্ষাও হল।

পিসির অন্তত মন-মুখ এক ছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন মেয়েদের কথা বলতে নেই, তাই মেয়েরা কথা বললে ধমকে দিতেন। আজকের ‘ম্যাম’ ক্ষমতায়নের বুলি ঝেড়ে কমিটিতে ঢুকে, তার পর বাড়ি গিয়ে চমকাচ্ছেন, মিটিং ডেকে ধমকাচ্ছেন। নইলে মধুর স্বরে বোঝাচ্ছেন, ‘আহা, ক্ষমা তো চেয়েই নিয়েছে। ওর কেরিয়ারটা নষ্ট করাটা কি ঠিক হবে? একটু কমপ্রোমাইজ তো করতেই হবে।’ এই নিপাট ন্যাকামিকে ‘জেন্ডার জাস্টিস’ লেবেল সেঁটে চালানো হচ্ছে। এর আগেও বহু বার, বহু অভিযোগের এমন বিচার হয়েছে, যাবতীয় ডঃ এবং পোস্ট-ডঃ টুঁ শব্দটি করেননি। হয়তো তার কারণ, পড়াশোনা-চাকরি, সংসার-কেরিয়ার তৈরি করতে গিয়ে কলেজের ম্যাম শিখে গিয়েছেন, বাড়িতে কতটুকু মুখ খোলা যায়, বাইরে কতটা।

কিন্তু ম্যাম কি টের পেয়েছেন, তাঁর ছাত্রীরা কখন মুখের কথাটা সত্যি বলে ধরে নিয়েছে? কখন ভাবতে শুরু করেছে, শরীরটা আমার, যৌনতা আমার, জীবনটাও আমার? চাকরিতে নাইট ডিউটি, লিভ-ইন বয়ফ্রেন্ড, পৈতৃক সম্পত্তির উত্তরাধিকার, পার্টনারশিপে ব্যবসা, ভোটে লড়াই, নৈশপার্টিতে মদ খাওয়া, এর কোনওটা আজকের কলেজ-পড়ুয়া মেয়ের কাছে আশাতীত নয়, উচ্চাকাঙ্ক্ষাও নয়। এগুলো সে নিতান্ত স্বাভাবিক মনে করে। এগুলো তার প্রাপ্য। ডিগ্রি দিয়ে, প্রতিযোগিতায় জিতে এগুলো সে পেতেই পারে। তাকে এই ধারণা দিয়েছে মিডিয়া, যা মহাকাশচারী, কর্পোরেট কর্তা কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান মেয়েদের জয়গান গায়। দিয়েছে মুক্ত অর্থনীতি, যা বোঝায় যে মানুষের পরিচয় তার দক্ষতা আর উৎপাদনশীলতায়। তার এই ধারণাকে সমর্থন করে রাষ্ট্র, যখন মেয়েদের উচ্চশিক্ষা, চাকরি, গবেষণার জন্য নতুন নতুন স্কলারশিপ তৈরি হয়।

এক কথায়, একটা মেয়ে ভাল কি না, তার পরিচয়— সে সৎ, দক্ষ, স্মার্ট, নির্ভরযোগ্য বন্ধু কি না। যৌনতা নিয়ে ছুচিবাই মেয়েদের কাছে আর ‘ভাল’ হওয়ার সংজ্ঞা নয়।

ছেলেরা তা মনে করে কি? একের পর এক নির্যাতনের ঘটনায় এই খটকা ক্রমশ বড় হয়ে উঠছে। এখন একটা খুব পরিচিত ঘটনাক্রম হল, এক বা একাধিক ছেলের সঙ্গে মেয়েটির ঘনিষ্ঠতা, এক দিন তার উপর একক বা সমবেত ভাবে যৌন নির্যাতন, মেয়েটির অস্বস্তিকর ছবি তুলে তা ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে মুখ বন্ধ করা। বিশ্বভারতীতে তেমনই হয়েছে বলে অভিযোগ। যাদবপুরের ঘটনার ইঙ্গিত, ছেলেরা মনে করছে সহপাঠী মেয়ে ‘বাড়াবাড়ি’ করলে তাকে শাসন করা যায়। এই ছেলেরা জন্মের সাল-তারিখে মেয়েটির প্রজন্মের, মনে তার ঠাকুমার প্রজন্মের।

এদের গোটাকতক বাচ্চা ডাইনোসর বলে ধরে নিলেও চলত। কালের নিয়মেই যারা নিশ্চিহ্ন হবে। মুশকিল হল, স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়, ব্যাঙ্ক কিংবা বেসরকারি দফতর, এমন সব মহা মহা প্রতিষ্ঠানে ওই ডাইনোদের ডিএনএ ঢুকে বসে আছে। যা লজ্জা দিয়ে, ভয় দিয়ে, মেয়েদের নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। যা মেয়েদের প্রাপ্য (এমনকী প্রাপ্য ন্যায়বিচার) ঠিক করে তাদের যৌনজীবনের কলুষের নিরিখে। বিশ্বভারতী আর যাদবপুর, দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রীরই নালিশ, কমিটির সদস্যরা তাঁদের সঙ্গে যা ব্যবহার করেছেন তাতে তাঁরা অসম্মানিত বোধ করেছেন। তাঁরা চেয়েছিলেন হয়রানির প্রতিকার, অথচ তাঁদের প্রতি নতুন অন্যায় করা হয়েছে। বিশ্বভারতীর ছাত্রী যাতে মিডিয়ার কাছে, পুলিশের কাছে মুখ না খোলেন, সে জন্য তাঁকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ‘বুঝিয়েছেন’ কমিটির সদস্যরা। যাদবপুরের মেয়েটিকে তদন্তের নামে অশালীন প্রশ্ন করা হয়েছে। এই মেয়েরা বন্ধুদের কাছে, পুলিশের কাছে, মিডিয়ার কাছে ন্যায় দাবি করেছেন।

অথচ যৌথ পরিবারের জেঠামশাইয়ের মতো দুই উপাচার্য দাবি করে চলেছেন, সব ঠিক আছে। তদন্ত কমিটি বৈধ, তার সব কাজ নিয়মমাফিক, তার সিদ্ধান্ত যথাযথ। সব হচ্ছে আইন মেনে। তদন্ত সম্পর্কে ছাত্রীদের অসন্তোষ নিয়ে কোনও প্রশ্ন করাটাও প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতায় পৌঁছে গিয়েছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে প্রতিবাদী ছাত্রীদের পাশে দাঁড়ানো মানে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপক্ষে দাঁড়ানো। তাদের কাঁধে হাত রেখে ‘কেমন আছ’ বলার লোক পাওয়া যাচ্ছে না দুই ক্যাম্পাসে। ম্যাম-স্যরেদের বোঝানো হয়েছে, হয়রানির অভিযোগের বিচার বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘অভ্যন্তরীণ’ ব্যাপার। যেমন এক সময়ে বিচার করত পরিবার। মাথাই মুড়িয়ে দাও আর হাত কেটে নাও, বাইরে তা নিয়ে টুঁ শব্দটি চলবে না।

যে আইন বহু ঘাম-রক্তে মেয়েরা আদায় করেছিল স্বচ্ছ, সংবেদনশীল সুবিচার পাওয়ার আশায়, সেই আইন দেখিয়ে আজ মেয়েদের ‘কেলেঙ্কারি’ ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে। আইন দেখিয়ে যাদবপুরে পুলিশ ঢুকছে, আইন দেখিয়ে বিশ্বভারতীতে মিডিয়ার ঢোকা বন্ধ করা হয়েছে। সুবিচারের এই ধুন্ধমার কাণ্ডে কেউ প্রশ্ন করছে না, ‘পাখিটাকে দেখিয়াছেন কি?’ ছাত্রীটি কি শরীরে-মনে সুস্থ আছে, নিঃশঙ্ক, অস্বস্তিহীন আছে? যখন দেখি ভিনরাজ্যের ছাত্রী ফের ভর্তি হাসপাতালে, যাদবপুরের ছাত্রী মুখে কুলুপ এঁটে কার্যত গৃহবন্দি, তখন চিন্তা হয়, অভ্যন্তরীণ কমিটি তৈরির মূল উদ্দেশ্যই কি ব্যর্থ হয়েছে? না হলে কেন হয়রানি এখনও এতটা ট্রমা তৈরি করছে?

মেয়েরা বাঁচার পথ খুঁজতে গিয়ে দেওয়ালে মাথা ঠুকে মরছে, জ্যেঠামশাইরা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলছেন, আইন আইনের পথে চলবে। সে পথ কোন পথ? কার পথ? আজ অর্থনীতিও নারী সুরক্ষা, নারী স্বাধীনতার পথে হাঁটছে। যে বিপুল বিনিয়োগ মেয়েদের উচ্চশিক্ষায়, প্রশিক্ষণে ব্যয় হচ্ছে, তা কর্মক্ষেত্রে লাভজনক না হলে মস্ত ক্ষতি হবে। অথচ কর্মক্ষেত্র, রাস্তাঘাট, সুরক্ষিত না হলে মেয়েরা আসবে না, এলেও টিকবে না। ফলে বিচারের যে প্রক্রিয়া, আইনের যে ধারণা ‘বেচাল’ মেয়েদের এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে দায় ঝেড়ে ফেলত, তা এখন শুধু অন্যায় নয়, ক্ষতিকর। সেই বিপুল ক্ষতি পরিবার থেকে রাষ্ট্র, কেউ বহন করতে পারে না। বাবা থেকে বয়ফ্রেন্ড, তরুণী মেয়েদের নির্যাতনে সবাই তাই রাস্তায় নামে। মেয়েদের ঝুঁকি আজ গোটা অর্থব্যবস্থার ঝুঁকি। নইলে দুটো পুঁচকে মেয়েকে চুপ করাতে গিয়ে গোটা রাজ্যে শোরগোল পড়ে গেল কেন?

মেয়েদের ভরসা সেখানে। আর আশঙ্কা হল, বুড়ো আঙুলটি যেমন চাঁদ-সূর্য ঢেকে দেয়, তেমনই ছোট স্বার্থ, ছোট ভয়, সমাজ-রাষ্ট্রের মহত্তর ন্যায়কে, বৃহত্তর স্বার্থকে সহজেই আড়াল করে। কর্মক্ষেত্রে বিচার চেয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে গেলে মেয়েরা সেই ঝুঁকির সামনে পড়ে। মিডিয়া, ছাত্র আন্দোলন, হইহট্টগোলে যদি কমিটির ম্যাম-স্যরগণ একটু নড়েচড়ে বসেন, যদি অবিচারের ঝুঁকিটা আগের চাইতে একটু বেশি মনে হয়, সেটুকুই লাভ।

অন্য বিষয়গুলি:

post editorial swati bhattacharya
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE