নিজস্ব আধুনিকতা। লাল মেঝে, লম্বা ছিটকিনি, খড়খড়ির জানলা। শহর কলকাতা।
সেই বিখ্যাত খড়খড়ির জানলাটা কোথায়?
কোনটা?
যেটা একডালিয়ায় একটা ভাঙা বাড়ির নীচে ডাঁই হয়ে পড়েছিল, আপনি কিনেছিলেন?
ওই যে, প্যাসেজের পাশের দেওয়ালে লাগিয়েছি। দরজাটা ওই বুককেসের পিছনে।
এই সবুজ খড়খড়ির গল্পটা গত বছরই আপনার ‘ক্যালকাটা: টু ইয়ার্স ইন এ সিটি’ বইতে লিখেছিলেন। এই শহরে পঞ্চাশের দশকেও মধ্যবিত্তরা যে সব বাড়ি তৈরি করেছিলেন, সেগুলি নির্বিচারে না ভেঙে ফেলার জন্যও সম্প্রতি লিখেছেন। হেরিটেজ কমিশনে যাতায়াত করছেন। ব্যাপারটা যদি বুঝিয়ে বলেন!
শুধু হেরিটেজ কমিশন নয়। পুর কমিশনার খলিল আহমেদের সঙ্গেও কথা হয়েছে। কলকাতার ঘরবাড়ি মানে শুধু মার্বল প্যালেস বা শোভাবাজার রাজবাড়ি নয়। মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্তরাও তাঁদের মতো বাড়ি তৈরি করেছেন। সবই যে উনিশ শতকে এমন নয়, গত শতকের মাঝামাঝি অবধি বাড়িগুলি তৈরি হয়েছে। এই বাড়িগুলি কলোনিয়াল স্থাপত্য নয়। সেখানে রেনেসঁসের চিরাচরিত চিহ্ন যেমন ডোরিক থাম, লম্বা হলঘর ইত্যাদি দেখাও যাবে না। বরং দেখা যাবে অন্য কিছু জিনিস। লাল মেঝে, খোলা ছাদ, লম্বা ছিটকিনি, দেওয়ালে ঘুলঘুলি, সবুজ খড়খড়িওয়ালা কাঠের জানলা। এই বৈশিষ্ট্যগুলি হয়তো আলাদা করে অনেক শহরে দেখা যাবে। কিন্তু একটা বাড়িতেই এতগুলি সম্ভার, উপরন্তু পাশাপাশি দুটি বাড়ি একেবারে আলাদা, এটা কলকাতা ছাড়া অন্য কোথাও পাওয়া যাবে না।
বাড়িগুলির মধ্যে তাই আধুনিকতার ইতিহাস ধরা যায়। ইন ফ্যাক্ট, বাঙালি আধুনিকতার অন্যতম গুণ তার ইনভিজিবিলিটি। সেই ইনভিজিবিলিটি বাঙালিকে অন্য রকম স্বাধীনতা দিয়েছিল। তাই রবীন্দ্রনাথও গানে বারংবার ছুটির উল্লেখ করেন। ব্রিটিশ আমলে যে ভাবে বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে বাংলা সাহিত্য, গান তৈরি হচ্ছে, সে ভাবে বাড়িগুলির স্থাপত্যচরিত্রও তৈরি হচ্ছে। যেটা অনেকেই রেনেসঁস বলছেন।
একেবারে রেনেসঁস বলে দিলেন?
জানি, এই শব্দটা লোকে আজকাল ব্যবহার করতে ভয় পায়। ইউরোপীয় রেনেসঁসে শাসকের একটা সমঝদারি থাকে। যেটা এখানে ছিল না। কারণ ব্রিটিশ শাসক আর মধ্যবিত্ত বাঙালির মধ্যে যথেষ্ট দূরত্ব ছিল। অথচ মধ্যবিত্ত এই বাড়িগুলির সঙ্গে শহরের ইতিহাস মিশে আছে। একটা হাইকোর্ট বিল্ডিং বা শপিং মলের ব্যাপারে এমনটা বলা যায় না। স্থাপত্যের নতুন চেহারা, যেখানে লোকের বাসস্থান, শহরের ‘ভিজিব্ল হিস্ট্রি’ সব একসঙ্গে ধরা পড়ছে, তাকে রেনেসঁস বলব না কেন? তথাকথিত এই বাঙালি রেনেসঁসের প্রতি ব্রিটিশ রাজের আগ্রহ বা চেতনা ছিল না, শাসকের এন্ডোর্সমেন্ট ছাড়াই এগুলি গড়ে উঠেছিল। যদিও এখানে বাড়ি তৈরি হয়েছিল, সিস্টিন চ্যাপেল নয়!
তপন রায়চৌধুরী থেকে পার্থ চট্টোপাধ্যায়, দীপেশ চক্রবর্তী, গৌতম ভদ্র সকলে বারংবার বলেছেন, আমাদের আধুনিকতা ইংল্যান্ড থেকে আমদানি-করা সেকেন্ডহ্যান্ড জিনিস নয়। তার একটা নিজস্ব বয়ান আছে। ঘরবাড়ি এত দিন ধরে আমাদের দৃষ্টি এড়িয়ে গেল কেন?
কারণ, এ দেশে ক্রিটিক্যাল ডিসকোর্স সব সময়েই দেরিতে শুরু হয়। আমরা বরাবর ভেবেছি, ঘরবাড়ির আধুনিকতা আমাদের নিজস্ব নয়। বিদেশ থেকে আসা এলিটিস্ট, মিডল ক্লাস, বুর্জোয়া ব্যাপার। ভাবনাটা এতই আত্মস্থ করে ফেলেছি যে, সেই ইতিহাসের সঙ্গে নিজেদের এনগেজ করতে চাইনি। খাঁটি আধুনিকতা বলে কিছু হয় না। ইউরোপের আধুনিকতাও বিভিন্ন সংস্কৃতির সঙ্গে আদানপ্রদানের ফসল। তাই, দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে।
যেমন, ‘তৃতীয় বিশ্ব’ বলে চালু কথাটা। এটা একটা কোল্ড ওয়র টার্ম। আপনি যখনই স্থাপত্য, শিল্প সংরক্ষণের কথা বলবেন, পাল্টা দীর্ঘশ্বাস ভেসে আসবে। এগুলি ইউরোপ আমেরিকায় হয়। তৃতীয় বিশ্বে কি এ সব সম্ভব?
আমাদের মুশকিল অন্যত্র। এখানে দুর্দম গতিতে সৃজনশীল একটা ঢেউ এসেছিল। তার আপনত্ব বোঝার ভাষা আমরা তৈরি করতে পারিনি। তাই সেটা বেশির ভাগ সময় চেনা ছকে ঘুরপাক খায়: এলিটিস্ট না পলিটিকাল? কলোনিয়াল না ইন্ডিজেনাস? কিন্তু বাংলা বা ফরাসি সাহিত্য, স্থাপত্য এই সব ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড, থার্ড ওয়ার্ল্ড গোছের শব্দ দিয়ে বোঝা যায়? অনেকেরই ধারণা, দুটো বিশ্বে আকাশপাতাল তফাত। তৃতীয় বিশ্বে দুর্নীতি, অপুষ্টি, জাতিদাঙ্গা ইত্যাদি ঢাউস সমস্যা। প্রথম বিশ্বে অন্য রকম: মোটা হওয়া বা জীবজন্তু নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা। কিন্তু নাইজিরিয়ার ঔপন্যাসিক তেজু কোল সম্প্রতি লিখেছেন, অর্ডিনারি ব্যাপারটা শুধু প্রথম বিশ্বের দখলদারি নয়। নাইজিরিয়াতেও জাতিদাঙ্গা, দুর্নীতির পাশাপাশি ‘এভরিডে রিদম অব মান্ডেন, অর্ডিনারি’, আছে।
স্থাপত্যের ব্যাপারে একই কথা বলছেন সোমালিয়ার স্থপতি রাশিদ আলি। বলছেন, মোগাদিশুতে হিংসা আছে, হানাহানি আছে, কিন্তু সেখানে ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক সজীবতাও আছে। সেটা স্থাপত্যে ধরা দেয়। এখানেই সোমালিয়ান স্থাপত্যের ঋদ্ধতা।
তা ছাড়া, তৃতীয় বিশ্ব মানেটা কী? ঢাকা-কলকাতায় কিংবা কলকাতা-চণ্ডীগড়ে অনেক তফাত। একটা জিনিস মনে রাখা উচিত। নতুন শহর কোথায় তৈরি হতে পারে? রাজারহাট, চণ্ডীগড় বা দুবাই। যেখানে শূন্য ছাড়া কিছুই নেই। কিন্তু যেখানে ঘরবাড়ি, স্থাপত্যর অনন্য অর্গানিক আর্কিটেকচার আছে, সেটা ধ্বংস করে নতুন ঘরবাড়ি বানাচ্ছি, সেটাকে উন্নয়ন ভেবে আহ্লাদিত হচ্ছি... এ ভাবে আরবান ট্রান্সফর্মেশন ঘটতে পারে? নতুন শহর কোথায় হয়? ধরুন, টেক্সাসের মরুভূমিতে গড়ে-ওঠা ডালাস। নিউ ইয়র্ক ধ্বংস করে সেখানে ডালাস তৈরির কথা কেউ ভাবে?
পুরনো বাড়ি ভেঙে স্কাইস্ক্রেপার তৈরি শুধু কলকাতায় নয়। শাংহাই, হংকং, কুয়ালা লামপুর সারা এশিয়ায়...
এই ‘এশিয়ান প্রবলেম’ গোছের ভাবনা ছেড়ে নিজেদের ঐতিহ্য নিয়ে ক্রিটিক্যাল এনগেজমেন্ট এ বার জরুরি। কলকাতা আর কুয়ালা লামপুর এক? আমরা ইস্তানবুল, রোমে গিয়ে মুগ্ধ হচ্ছি বাহ্, কী সুন্দর বাড়ি! এ দিকে কলকাতায় যেটা ফেলে এলাম, সেটা নিয়ে ভাবি না। এই গ্লোবাল বাঙালি নিজের বাপ-ঠাকুর্দার পুরনো বাড়ি বেচে রাজারহাটে কন্ডোমিনিয়মে থাকবে, কিন্তু লন্ডনে গিয়ে ভিক্টোরিয়ান আমলের বাড়ি কিনবে। সে জানে, তার ‘কালচারাল ভ্যালু’ অনেক বেশি। আমি রেনেসঁসের কথাটা বলছিলাম এই কারণেই। আমাদের এখানে কোনও হেজিমনিক ক্ষমতা নেই, যে বুঝিয়ে দেবে, এই বাড়িগুলির আর্কিটেকচারাল, কালচারাল ও মার্কেট ভ্যালু বেশি।
কিন্তু বেশির ভাগ বাড়িতেই একটি-দুটি সন্তান, হয়তো বিদেশে। বয়স্কদের পক্ষে বড় বাড়ি সামলানো অসম্ভব। শরিকি সমস্যাও থাকে। বাড়ি না বেচে উপায় কী?
বিক্রি তো বাড়ির মালিকের গণতান্ত্রিক অধিকার। আমি বেচতে বারণ করছি না। কিন্তু কলকাতায় যেন বাড়ির দাম নেই, সব দাম জমির। বার্লিনে যে সব জায়গা বোমায় ধ্বস্ত হয়েছিল, সেখানে প্রি-ফ্যাব্রিকেটেড বাড়িও তৈরি হয়েছিল। কিন্তু পুরনো অক্ষত বাড়ি ধ্বংস করে নতুন বাড়ি তৈরির নির্বুদ্ধিতা কারও হয়নি। বার্লিন তো ঐতিহাসিক কারণে একটা দেউলিয়া শহর। বোমাবর্ষণ, দেশভাগে তার অনেক কিছু ধ্বংস হয়েছিল। আর এখানে? উন্নয়নের নামে আমরা প্রতিদিন শহরটাকে ধ্বংস করে যাচ্ছি। মুম্বইয়ে কিন্তু এখন ‘ট্রান্সফার অব ডেভেলপমেন্ট রাইট’ বলে একটা ব্যাপার রয়েছে। পুরনো বাড়ির মালিক সেই বাড়ির জমিতে নতুন বাড়ি তৈরির অধিকার ডেভেলপারকে বিক্রি করে দেবেন, কিন্তু ডেভেলপার ওই বাড়ি ভাঙতে পারবেন না, তাঁকে সরকার বা পুরসভা থেকে অন্যত্র সমতুল জমি দেওয়া হবে। এক জনের হাতে বাড়ির স্বত্ব, অন্য জনের হাতে সংস্কারের স্বত্ব। বাড়িটা কিন্তু অক্ষত থেকে গেল। এখন পশ্চিমবঙ্গ সরকারও এ নিয়ে ভাবছে।
সরকার বাড়ি কেনাবেচার ব্যাপারে আসবে কেন? বাজারই তো দাম ঠিক করবে...
এখানে একটা সংঘাত আছে। বাড়ি নিশ্চয় মালিকের সম্পত্তি। কিন্তু শহরের ইতিহাস এবং আর্কিটেকচারাল ইথস প্রত্যেকটি নাগরিকের সম্পত্তি। তাই বাজারের মধ্যেও নিয়ম চাই। যেমন, সরকার কর কমিয়ে পুরনো বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণে উত্সাহ দেবে। ধরুন, বকুলবাগান বা প্রতাপাদিত্য রোড। চল্লিশ-পঞ্চাশের দশকে সেখানে আমি যা বলছি সে রকম বাড়ি তৈরি হয়েছিল। অথচ মুড়িমিছরির এক দর। বকুলবাগান হলে স্কোয়ার ফুট হিসাবে এত, বাবুবাগান হলে অত। কিন্তু বকুলবাগানে ১৯৪০ সাল আর ২০০০ সালে তৈরি বাড়ির কর এক রকম হবে কেন?
সরকার এটা পর্যটনের খাতিরেই ভেবে দেখতে পারেন। এখানে সুন্দরবন, পৌষমেলা আর ডুয়ার্স ছাড়া পর্যটনের ব্যাপারে তেমন কিছু ভাবা হয় না। আজকাল সবাই যে মারাকেশ বেড়াতে যায়, সেখানে কী আছে? কোনও ঐতিহাসিক সৌধ বা অট্টালিকা নেই। ওরা শুধু পুরনো শহরটা অক্ষত রেখেছে। সেটা দেখতেই লক্ষ লক্ষ টুরিস্টের আনাগোনা। কেন না সবাই জানে, শহরটার একটা বোহেমিয়ান ইতিহাস আছে। কলকাতা এই জায়গাটা তৈরি করতে পারে। পর্যটন মানে শুধু জয়পুরের প্রাসাদ আর উট নয়। বিদেশিরা কলকাতায় এসে কেন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, হাওড়া ব্রিজ আর নতুন শপিং মল দেখতে চাইবেন? বরং আহিরিটোলা, ভবানীপুর, এ সব দেখবেন। ভারতে আধুনিকতার ইতিহাসে কলকাতার স্থান প্রথম। প্যারিস নিয়ে ওয়াল্টার বেঞ্জামিন যেমন বলেছিলেন: ক্যাপিটাল অব মডার্নিটি।
অনেকে বলছেন, কলকাতা শহরটাকেই আপনি মধ্যবিত্তের মিউজিয়াম বানাতে চান।
সে তো ক্রেডাই-এর প্রেসিডেন্ট বলেছেন। কিন্তু উনি ভুল বুঝছেন। ইস্তানবুল বা বার্সেলোনাকে আদৌ মধ্যবিত্তের মিউজিয়াম বলা যায় না। আমি অনেক বার বলেছি যে, কলকাতায় তাজমহলের মতো কিছু নেই। পুরনো বাড়িই প্রধান দ্রষ্টব্য। ইন ফ্যাক্ট, ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক রবার্ট অ্যান্টনি বলেছিলেন, বার্সেলোনাতেও এক ব্যাপার। সেখানে আসল মনুমেন্ট হল বাড়ি। কলকাতায় নতুন বাড়ি তৈরি হবে না, সে কথা কিন্তু আমি বলিনি। ভবানীপুর, আহিরিটোলায় নতুন বাড়ি হবে না তা-ও বলিনি। কিন্তু নতুন স্থাপত্য কি কলকাতায় হচ্ছে? চার্লস কোরিয়া-র ‘সিটি সেন্টার’ ছাড়া অন্য বিল্ডিংগুলি এক ধরনের উন্নয়ন, কিন্তু ঠিক স্থাপত্য নয়। একমাত্র পুজো-প্যান্ডেলের যে তাত্ক্ষণিক স্থাপত্য, সেটা অনেক ক্ষেত্রে আশপাশের এলাকা ঠিকঠাক ব্যবহার করে। পাশের বাড়ি, রাস্তা সব কিছু মিলিয়ে সুসমঞ্জস উপস্থিতি সৃষ্টি হয়। কলকাতায় নতুন স্থাপত্য অবশ্যই দরকার। কিন্তু পুরনোকে অস্বীকার করে নয়, বরং যথাযথ সামঞ্জস্য রেখে। হেরিটেজ শব্দটা আমার তাই পছন্দ নয়। স্থাপত্যের মধ্যে যে প্রাণশক্তি বা ভাইটালিটি, সেটা ধরা পড়ে না।
কলকাতায় আর একটা জিনিস আছে। ধরুন, কোনও হেরিটেজ বাড়ি। আপনি যদি সংস্কার করতে চান, তার সদর বা ‘ফাসাদ’ বদলানো যাবে না। কিন্তু এই নিয়ম অর্থহীন। মানে, আমি ‘ফাসাদ’ ঠিক রেখে ভিতরের রেলিং, মেঝে বা আসবাব ধ্বংস করে দিতে পারি? বিল্ডিংগুলির অন্দরে আছে একটা হাইব্রিড বসবাসের ইতিহাস। কোনও একটা পাবলিক বিল্ডিং-এর কথা ধরুন। যেমন, মেট্রো সিনেমা। তার ভেতরে আর্ট ডেকো ফিচার্স... যেখানে রয়েছে আমাদের বিনোদনের, মেলামেশার ইতিহাস।
পুরনো বাড়ি, বিভিন্ন খোপ বিভিন্ন জনকে কয়েক দশক আগে ভাড়া দেওয়া, শরিকি মামলা... এ সবও কি ধ্বংসের কারণ নয়?
একমাত্র ব্রিটেন আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে লোকের নিজের বাড়ি নিয়ে একটা অবসেশন আছে। ইউরোপে ভাড়াটে বেশি। ভাড়াটে হলে যে স্থাপত্যের গুরুত্ব নিয়ে ভাবা যাবে না, এমন নয়। কলকাতার সবচেয়ে বড় সমস্যা অন্যত্র। মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত পরিবারে ছোটবেলা থেকে মনে গেঁথে দেওয়া হয়, আমরা এখানে আছি খুব অল্প সময়ের জন্য। যদি উন্নতি করতে চাই, এখান থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম একটাই ধারণা... শহরটা ট্রানজিট ক্যাম্প। আমরা অল্প দিনই এখানে থাকব।
আমি এটা পর্যবেক্ষণ হিসাবেই বললাম। কোনও জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নয়। সবাই ভাবি, এ শহরে আমরা সাময়িক বাসিন্দামাত্র। তাই এখানকার পাবলিক স্পেসের সঙ্গে নিজেদের এনগেজ করতে পারি না।
বাঙালি অন্য কথাও ভাবে। ধন নয়, মান নয়, এতটুকু বাসা করেছিনু আশা। বাসাটা হলেই হল, তার স্থাপত্য, অন্দরসজ্জা উপরি। নীরদ চৌধুরী যখন জানলায় পর্দা লাগিয়েছিলেন, প্রতিবেশীরা বলেছিল, খেতে পায় না, পর্দা টাঙায়!
কিন্তু নীরদবাবু ছিলেন। মানে, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজ থেকে হারায়নি। আমি সে কারণেও শহরের আর্কিটেকচারাল ভাইটালিটি বজায় রাখার কথা বলছি। ইস্তানবুল পুরনো শহর সাজিয়েগুছিয়ে রেখেছে, পর্যটন থেকে আয় করছে সবই ঠিক। কিন্তু সেখানে এভরি সেকেন্ড অর্ডিনারি সিটিজেন ইজ আ টাউট। সবাই বলছে, ওখানে চলো, ওই গির্জাটা দেখো, এই বাড়িটা দেখো। কলকাতায় শিক্ষিত মধ্যবিত্তের একটা লেগ্যাসি আছে। ফলে, এমনটা হয়তো ঘটবে না।
আসলে কলকাতার স্থাপত্য, তার গলিপথের অন্তরঙ্গতা, মধ্যবিত্ত জীবন... এটার সঙ্গে ইংল্যান্ডের চেয়ে বাকি ইউরোপের মিল অনেক বেশি। দীপেশ (চক্রবর্তী) আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, তুমি কলকাতার ছেলে না হয়েও বাঙালি জীবন এত অন্তরঙ্গ ভাবে তুলে ধরো কী ভাবে। বলেছিলাম, আমি তো বাঙালি জীবন পেয়েছি অন্য জায়গায়। জেম্স জয়েস, ক্যাথরিন ম্যান্সফিল্ড-এর উপন্যাসে। যেমন সত্যজিত্ রায়ের বাংলা ছবিতে আমরা রনোয়া, দে সিকা বা রোসেলিনিকে স্বীকার করে নিই।
সাম্প্রতিক ‘টেলিং টেল্স’ বইয়েও আপনি লিখেছেন, কলকাতার সঙ্গে লন্ডন নয়, বরং ডাবলিনের অনেক মিল।
কলোনিয়াল ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে এই শহরের পুরোটা ধরা যাবে না। এখানকার বাড়ি, রাস্তাঘাট, মধ্যবিত্তের সংগ্রাম, সব কিছু কলকাতার মধ্যে এমন একটা ‘সেন্স অব প্লেস’ এনেছে, যেটা কোনও দিন লন্ডনে ছিল না। এখানকার আধুনিকতা, জীবনযাত্রা অনেকটা কাল্পনিক ডাবলিনের মতো। কলকাতার কলোনিয়াল ইতিহাস বুঝতে হলে আমাদের তাই লন্ডন না দেখে ডাবলিনের দিকে তাকাতে হবে। জয়েসের উপন্যাস আমাকে পড়তে শিখিয়েছিল কলকাতা। ইউলিসিস-এর লিয়োপোল্ড ব্লুম যখন চলন্ত ঘোড়ার গাড়ির খড়খড়ির জানলা খুলে রাস্তা দেখে, বা ট্রাইটনভিল রোডে ট্রামলাইনের ওপর ঘোড়ায় টানা ট্রামের আওয়াজ ওঠে, কলকাতার কথাই মনে পড়ে।
কিন্তু এ শহরের লিয়োপোল্ড আর মলি ব্লুমরা আজ পালাতে চায়। বাড়ি ভাঙা, বাড়ি তৈরির সিন্ডিকেট-রাজ ছাড়া দ্বিতীয় কোনও ইন্ডাস্ট্রি নেই...
শিক্ষিত মধ্যবিত্ত যে সমস্যার জাঁতাকলে পড়েছে, সেটা হল পপুলিস্ট রেটরিক। অনেক সময় নেতা, লেখক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবীরাও সেই রেটরিকের বাইরে বেরোন না। তাই রাজনৈতিক এবং সামাজিক পরিবর্তনের ধারণাটা খুব সীমিত হয়ে যায়। শহরের স্থাপত্যসংস্কৃতির কোনও দিক নিয়ে বলতে গেলে একটাই জবাব আগে গরিবদের চাল ডাল, থাকা খাওয়ার সমস্যা মিটুক, তার পর অন্য সব!
অথচ শিক্ষা, জনস্বাস্থ্য, সংস্কৃতি, বাসভাড়া, সব তো এক সঙ্গেই ভাবতে হয়। পপুলিস্ট মডেলটা কোথাও কাজে দেয়নি। গরিব বা সংস্কৃতি কারও উন্নতি হয়নি। যে মাথাটা গরিবদের জন্য ভাবে, সে একই সঙ্গে শিক্ষা এবং সংস্কৃতির উন্নতির দিকে নজর রাখে। পপুলিস্ট স্লোগানের চোটে শিক্ষা-সংস্কৃতিকে তাচ্ছিল্য করলে চলবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy