এক যুগ। দক্ষিণ-পূর্ব আফগানিস্তানে খোঁজ চলছে সন্ত্রাসবাদীদের। অক্টোবর, ২০০২।
২০০৬ থেকে এশিয়া ফাউন্ডেশন আফগানিস্তানে নমুনা সমীক্ষা চালাচ্ছে। ২০১৩-এ আফগানিস্থানের ৩৪টি প্রদেশের ৯২৬০ জনের উপরে সমীক্ষা চালানো হয়। ৩০% আফগান নিরাপত্তার অভাবকে সবচেয়ে বড় সমস্যা বলে মনে করেছেন। এর পরে এসেছে দুর্নীতি (২৬%), বেকারত্ব (২৫%), অর্থনীতির খারাপ অবস্থা (১০%), দারিদ্র (৯%), শিক্ষা (৯%), আত্মঘাতী হামলা (৯%) তালিবানের অবস্থান (৭%)। ২০০৬ থেকে ছবিটি খুব বেশি বদলায়নি। বেকারত্ব, অর্থনীতির খারাপ অবস্থা, দারিদ্র, শিক্ষার মতো সমস্যা আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক। কিন্তু ২০০৯-এর পরিকল্পনা ঠিকঠাক কাজ করলে নিরাপত্তার অভাব, দুর্নীতি, আত্মঘাতী হামলা, তালিবানের অবস্থানের মতো সমস্যা এত প্রকট হত না।
সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার জন্য ২০০৬-এ মার্কিন সেনা ও নৌ-সেনা যৌথ ভাবে নতুন সন্ত্রাসবাদ বিরোধী নীতি ‘কাউন্টার-ইনসারজেন্সি ডকট্রিন, ফিল্ড ম্যানুয়াল ৩-২৪’ প্রকাশ করে। ২০০৯-এর পরিকল্পনা এই নীতির উপরেই দাঁড়িয়ে আছে। এর মূল উদ্দেশ্য দু’টি। এক, সন্ত্রাসের পরিকাঠামো ধ্বংস করে সাধারণ মানুষকে সুরক্ষিত করা। দুই, বৈধ, দায়িত্বশীল সরকার গড়ে তোলা, যে সরকার অতিপ্রয়োজনীয় পরিষেবাগুলি চালু করতে পারে। এখানে স্বীকার করা হয় যে, এই দু’টি উদ্দেশ্য পূরণ করতে দীর্ঘ সময় এবং প্রচুর অর্থ খরচ হবে। উপরের পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, চার বছর পরেও আফগানিস্তানে এই দুই মূল উদ্দেশ্যে পূরণ হয়নি। কেন?
ওবামা প্রশাসন ধরে নিয়েছিল, তালিবান দমন করলেই আফগানরা সুরক্ষিত হবেন। কিন্তু সমস্যা অনেক বেশি জটিল। যেমন, আফগানিস্তান জুড়ে রমরমিয়ে মাদকের ব্যবসা চলে। বেকার যুবকদের একাংশকে হিংসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন। আফগান পুলিশ ও প্রশাসনের একাংশ দুর্নীতিগ্রস্ত। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে হিংসা-বিবাদ বন্ধ হয়নি। বেহাল স্বাস্থ্য-ব্যবস্থার জন্যও অনেকের মৃত্যু হয়েছে। এই ধরনের সমস্যা থেকে আফগানদের রক্ষার কথা পরিকল্পনায় ছিল না। কিন্তু চার বছর ধরে মার্কিন সেনা, প্রশাসনের কর্মী, উন্নয়ন বিশেষজ্ঞদের এই দিকগুলি সামলাতে হিমশিম খেতে হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে তাঁরা তৃণমূল স্তরের এই সমস্যাগুলি বুঝেই উঠতে পারেননি। সমীক্ষা দেখা যাচ্ছে, ৫৯% আফগান প্রায়ই নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকেন। ৭৭% আফগান বিদেশি সেনার মুখোমুখি হতে ভয় পান। ৬৮% আফগান শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে অংশ নিতে এবং ৫৯% আফগান এমনকী ভোট দিতেও ভয় পান। তালিবান দমনের জন্য ধাপে ধাপে এক লক্ষের বেশি সেনা মোতায়েন করা হয়েছিল। সঙ্গে বেড়েছে নির্বিচারে আটক, রাতে বাড়ি বাড়ি অভিযান, বোমাবর্ষণ। উঠেছে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ। কিন্তু ২০০৯-এর আগেই তালিবান তার ঘাঁটি পাকিস্তানে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছে। রাষ্ট্রপতি হামিদ কারজাই বার বার পাকিস্তান থেকে তালিবানদের মদত দেওয়ার অভিযোগ তুললেও আমেরিকা বিশেষ কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। কারজাই-এর সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হয়েছে।
আর দায়িত্বশীল সরকার? সমীক্ষায় আফগানরা জানিয়েছেন, সাংসদরা তাঁদের সমস্যার কথা শোনেন না। সংসদে বা সরকারের কাছে তাঁদের সমস্যার কথা তুলে ধরেন না। জীবিকা ও উন্নয়ন বিষয়েও সাংসদরা বিশেষ কিছুই করে উঠতে পারেননি। গত আট বছরের মধ্যে এ বছরের সমীক্ষায়ই দেখা যাচ্ছে সরকারি প্রতিষ্ঠান, সংস্থা, কর্মীদের উপরে আফগানদের আস্থা সবচেয়ে কম। অর্থাত্ নির্বাচিত, বৈধ সরকার দায়িত্ববান হয়ে ওঠেনি। পূরণ হয়নি দ্বিতীয় উদ্দেশ্য। কেন?
নির্দিষ্ট দায়িত্ব এবং তা পালনের জন্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো ছাড়া দায়িত্বশীল সরকার গঠন সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সংস্কার, সার্বিক পরিকল্পনা এবং পরিকল্পনা রূপায়ণের জন্য সাহায্য। ২০০৮ সালে কারজাই সরকার আফগানিস্তানের উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রকাশ করে। এর থেকে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি, রাজস্ব আদায়, জীবিকা ও মানব-উন্নয়নের মূল লক্ষ্যগুলি নিয়ে ২০১০-এ তৈরি হয় ন্যাশনাল প্রায়রিটি প্রোগ্রামস (এনপিপি)। কিন্তু প্রায় সবটাই পরিকল্পনার স্তরে আটকে। অবস্থা এমনই যে, ২০১২ তে টোকিওয় দাতা দেশগুলির সঙ্গে আলোচনায় কারজাই সরকার সাহায্যের ৮০% এনপিপি-র জন্য ব্যয় করা এবং অন্তত ৫০% সাহায্য আফগানিস্তানের বাজেটের মাধ্যমে খরচের দাবি তোলে। টোকিও ঘোষণায় তা মেনেও নেওয়া হয়।
অনুন্নয়ন তালিবানদের জন্ম দেয়, সত্য। তালিবানের প্রতি সমর্থন কমাতে মার্কিন সেনাকর্তারা তাই স্থানীয় স্তরে নানা উন্নয়নের কাজ শুরু করেন। এর জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় হতে থাকে। প্রায় সবই ছিল খাপছাড়া। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কারজাই সরকারকে এড়িয়ে কাজ হয়েছে। এই অর্থের ভাগ পেতে নানা অঞ্চলের গর্ভনর, জেলার প্রধান, আদিবাসী নেতারা মার্কিন সামরিক কর্তা, প্রশাসনের কর্মী, পুনর্গঠন দলের বিশেষজ্ঞদের কাছে ভিড় জমাতে শুরু করেন। কেন্দ্রীয় সরকারের সমান্তরাল প্রশাসন কাজ করতে থাকে। যাঁরা এই সমান্তরাল প্রশাসন থেকে নানা সুবিধা পেয়েছেন, তাঁরা ক্রমাগত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সংস্কারের বিরোধিতা করে গিয়েছেন। কারজাই সরকারের দুর্বলতা প্রকট হয়। সরকারের দায়বদ্ধতা না থাকায় দুর্নীতি প্রশ্রয় পেয়েছে। এ বছরের সমীক্ষা দেখাচ্ছে, ২০০৯-এর তুলনায় দুর্নীতির সমস্যা (১৯% থেকে ২৬ %) অনেকটা বেড়েছে।
এই অবস্থায় চলেছে নিরাপত্তা চুক্তি স্বাক্ষরের কথাবার্তা। আপত্তি প্রধানত কারজাইয়ের দিক থেকে এসেছে। আফগানিস্তানে ২০১৪’র পরে আমেরিকার কোনও সামরিক অভিযান চালানো নিয়ে তাঁর আপত্তি আছে। ২০১৪-এর পরে আফগানিস্তানে মার্কিন সেনা ও কর্মীর সংখ্যার বিষয়ে সিদ্ধান্ত আফগান সরকারের হাতেই ছেড়ে দেওয়ার পক্ষপাতী তিনি। রাজি নয় আমেরিকা। আফগান গোষ্ঠীগুলির সংগঠন লয়া জিরগা বর্তমান অবস্থায়ই চুক্তি স্বাক্ষরের পক্ষে মত দিয়েছে। তাতেও কারজাইকে টলানো যায়নি। তিনি চান, নতুন রাষ্ট্রপতিই চুক্তির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিন। সম্প্রতি হতাশ ওবামা নির্বাচন-পরবর্তী সরকারের সঙ্গেই চুক্তি বিষয়ে আলোচনার উপরে জোর দিয়েছেন। চুক্তি স্বাক্ষর না হলে, এক বারে সব সেনা সরিয়ে নিয়ে, অর্থসাহায্য বন্ধ করার হুমকিও মার্কিন প্রশাসনের একাংশ থেকে শোনা যাচ্ছে। তালিবানরা ২০১৪-এর পরেও আফগান বাহিনীকে যথেষ্ট বেগ দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে মার্কিন সাহায্য না এলে আফগান সেনা মুখ থুবড়ে পড়তে পারে। আফগানিস্তান আবার গৃহযুদ্ধের সময়ে ফিরে যেতে পারে।
তালিবানদের সঙ্গে হাই পিস কাউন্সিল যে আলোচনা চালাচ্ছে, তার ফল নিয়েও সংশয় রয়েছে। এখনও তালিবানরা হিংসা ছাড়েনি। আক্রমণ চলছেই। তা ছাড়া তারা মূল স্রোতে ফিরলেও দুর্বল আফগান সরকারের পক্ষে রাজনৈতিক ময়দানে তালিবানের মোকাবিলা করা কতটা সম্ভব হবে তা নিয়ে আশঙ্কা রয়েই যাচ্ছে। এতে শেষ পর্যন্ত গণতান্ত্রিক পরিবেশ নষ্ট হতে পারে, ধাক্কা খেতে পারে নারী-স্বাধীনতার মতো বিষয়গুলি।
ইরাক থেকে আমেরিকা ২০১১-এ সরে এসেছিল। আজ ইরাকের দিকে তাকান। ২০১৩-তেই ইরাকে প্রায় আট হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। ফালুজার মতো বেশ কয়েকটি সুন্নি-প্রধান অঞ্চল কার্যত সরকারি নিয়ন্ত্রণের বাইরে। আল-কায়দা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। অবস্থা এমনই যে ইরাকের রাষ্ট্রপতি মালিকি আন্তর্জাতিক সাহায্যও চেয়েছেন। ইরাক থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের যৌক্তিকতা নিয়েই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। আফগানিস্তানেও যদি এমন অবস্থা হয়?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy