সরস্বতী পূজা দিয়া শিক্ষাবর্ষ শুরু করিবার নির্দেশ দিয়াছিল লখনউ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সংবাদ পাইয়া শিক্ষায় গৈরিকীকরণের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলিয়াছিলেন প্রাক্তন উপাচার্য রূপরেখা বর্মা। অতঃপর, ‘নূতন’ ভারতে এবং যোগী আদিত্যনাথের রাজ্য উত্তরপ্রদেশে যাহা ঘটিবার তাহাই ঘটিয়াছে। প্রবীণ অধ্যাপিকা তথা উপাচার্যের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ অন্য একটি বিষয়ে শৃঙ্খলাভঙ্গে মদত দিবার অভিযোগ আনিয়া তাঁহার হেনস্থা শুরু হইয়াছে। খবরটি ছোট হইলেও ব্যঞ্জনায় বিরাট। তিনটি কথা এই প্রসঙ্গে স্পষ্ট করিয়া বলা প্রয়োজন। প্রথমত, কবে হইতে এ দেশ এমন কারাগার হইয়া গেল যেখানে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোনও নির্দেশ দিলে তাহা সংশ্লিষ্ট সকলকে মানিতেই হইবে, কোনও বিরোধিতা চলিবে না, কোনও প্রশ্ন চলিবে না? ফ্যাসিতন্ত্রের সঙ্গে ইহার তফাত কোথায়? রূপরেখা বর্মার বিরুদ্ধে যে বিশেষ অভিযোগটি আনা হইয়াছে, সেটি ভাবিলেও বোঝা যায়, একই সমালোচনা সেখানেও কতটা প্রাসঙ্গিক। গত মাসে স্নাতক-বর্ষের কিছু ছাত্র মুখ্যমন্ত্রীকে কালো পতাকা দেখাইয়াছিলেন বলিয়া স্নাতকোত্তর পর্বে বিশ্ববিদ্যালয় তাঁহাদের গ্রহণ করে নাই। জানিতে ইচ্ছা হয়, কবে হইতে ভারত এতখানি গণতন্ত্রবিমুখ হইয়া গেল যে, কালো পতাকা দেখানো কিংবা রাজনৈতিক নেতার বিরোধিতা করাও সমাজবিরোধিতা বলিয়া গণ্য হইতেছে? কালো পতাকা তো সব দেশে সব কালেই দেখাইবার দৃষ্টান্ত বর্তমান, এমনকি ব্রিটিশ ভারতেও তাহা ঘটিয়াছে। মোদীর ভারত ও যোগীর প্রদেশ কি তবে দমননীতিতে ঔপনিবেশিক সমাজকেও ছাপাইয়া যাইতেছে?
এ বার প্রশ্ন, শ্রীমতী বর্মা ভুল কী বলিয়াছিলেন? সরস্বতী পূজা দিয়া শিক্ষাবর্ষ শুরুর নির্দেশের প্রতিবাদ তো স্বাভাবিক, কেননা কোনও কালেই এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে হিন্দুত্বের এই দেখানেপনা ছিল না। তাহার অর্থ কিন্তু এই নয় যে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলিতে সরস্বতী পূজা হইত/হয় না। বস্তুত, অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে, এমনকি জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বাম-খ্যাতি-সম্পন্ন প্রতিষ্ঠানেও মাঘী পঞ্চমীর আরাধনা হইয়া থাকে। মাঘ ছাড়িয়া আষাঢ়-শ্রাবণে বিদ্যাদেবীর অকালবোধনে অতিরিক্ত যে স্বস্তিটুকু লাভ হইবে, তাহা কি আধ্যাত্মিক, না কি রাজনৈতিক? শিক্ষাবর্ষ কি এখন হইতে কেবল হিন্দু ছাত্রছাত্রীদের জন্যই উদ্দিষ্ট? অহিন্দুরা এই নূতন ভারতে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক বলিয়া সরকারি সিলমোহর প্রদত্ত? মনে রাখা ভাল, প্রতিবাদ করার অর্থ কিন্তু প্রতিবাদীর ব্যক্তিগত বিশ্বাস জাহির নয়। প্রতিবাদের অর্থ, সামূহিক ভিত্তিতে কোনও একটি মত নীতিগত ভাবে সকলের জন্য প্রযোজ্য কি না, সে বিষয়ে দ্বিমত পোষণ। না কি, এই ‘নূতন’ ভারতে ব্যক্তিগত আর সামূহিকের ভিতর তফাত বুঝিবার বোধটিই আর অবশিষ্ট নাই?
শিক্ষার অর্থ আলোক প্রাপ্তি, যে আলোক সাধারণত ভাবিতে, বিশ্লেষণ করিতে, প্রশ্ন করিতে শিখায়। এ দিকে ভাবিতে বা প্রশ্ন করিতে গেলেই সরকারি ‘লাইন’ হইতে সামান্য বিচ্যুত হইলেও যে ভাবে একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয়ে একের পর এক অধ্যাপককে তাড়ানো হইতেছে, তাহার ধারাটি গত কয়েক বৎসর যাবৎ দেশের নিয়মিত দস্তুর দাঁড়াইয়া গিয়াছে। ইহা অতিশয় উদ্বেগের বিষয়। শিক্ষাক্ষেত্রে জুলুমবাজি বর্তমান সরকারের একার অপরাধ নয়। কিন্তু বর্তমান সরকার নিয়মিত চর্চা ও দ্রুত তাড়নার ভিত্তিতে ইহাকে যে উচ্চতায় লইয়া গিয়াছে, তাহা ভয়ঙ্কর। শিক্ষার মধ্যেকার মুক্ত ভাবনার পরিসরটিকে এই ভাবে হেনস্থা করিলে শেষ পর্যন্ত পড়িয়া থাকিবে শিক্ষা-কাঠামোর একটি জীর্ণ কঙ্কাল, এবং তৎসহ দেশব্যাপী একটি বিপুল মোসাহেব সমাজ। সরস্বতী বন্দনার অন্তরালে যোগী আদিত্যনাথরা সদলবলে এখন সেই সমাজেরই আবাহন করিতেছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy