কলেজে হাজিরা বস্তুটি সম্প্রতি অত্যন্ত প্রহেলিকাময় ঠেকিতেছে। ছাত্রছাত্রীরা প্রয়োজনীয় সংখ্যক ক্লাসে উপস্থিত থাকিতেছেন না বলিয়া তাঁহাদের পরীক্ষায় বসিতে দেওয়া হইবে না, প্রতিষ্ঠানের এ হেন সিদ্ধান্তে ছাত্রদুনিয়া তো উদ্বেল হইয়া উঠিয়াছেই, রাজনৈতিক দাদারাও সুযোগ পাইয়া চটপট মাঠে নামিয়া পড়িয়াছেন। অভিযোগের ঘূর্ণিপাকে গুলাইয়া যাইতে বসিয়াছে যুক্তি। কলেজে ৬০ শতাংশ উপস্থিতিও পশ্চিমবঙ্গের ছাত্রসমাজ রাখিতে পারিতেছে না— এই পরিস্থিতির দায় কাহার? কেহ বলিতেছেন, ছাত্ররা কী ভাবে উপস্থিত হিসাবে গণ্য হইবেন, হাজিরা খাতায় দাগ দিবার লোকই তো নাই! হাজিরা খাতার এমত দায়িত্বজ্ঞানহীনতার অভিযোগে খাতাটিই সম্পূর্ণ লোপাট করার ব্যবস্থা হইয়াছে উত্তর কলিকাতার এক কলেজে— খাতাই যখন নাই, উপস্থিতির প্রশ্নও নাই! কেহ বলিতেছেন, হাজিরা খাতার বদলে সাদা কাগজে অশিক্ষক কর্মীরা লিখিয়া লন উপস্থিত ছাত্রের নাম, সুতরাং সাদা কাগজই বিলক্ষণ প্রমাণ যে ছাত্ররা প্রাণ যাইলেও ক্লাসে ফাঁকি দেন না! ‘দাদা’রা বলিতেছেন, দুঃস্থ ছাত্রদের ক্লাস করিতে কষ্ট হয়, তাঁহারা ক্লাস করিবেন কেন। ইহা ছাড়া, নূতন সিবিসিএস পদ্ধতিতে পড়ানো হইতেছে, কিন্তু তাহার উপযুক্ত পরিকাঠামো নাই, ছাত্ররা ক্লাস করিবেন কেন। ‘পরিকাঠামো’ ছাড়া ক্লাসে ছাত্রদের উপস্থিতি আশা করা যায়? এখন, ‘ছাত্ররা ক্লাস করিতেছেন কিন্তু নাম উঠিতেছে না’, এবং ‘পরিকাঠামো নাই, ছাত্ররা ক্লাস করিবেন কেন’, এই দুইটি অভিযোগ পরস্পরবিরোধী। একই দলের দাদারা দুইটি কথাই বলিতেছেন দেখিয়া ধরিয়া লওয়া যায়, এসএফআই যথারীতি প্রয়োজনীয় হোমওয়ার্ক ছাড়াই রাজনীতি করিতেছে। সর্বাপেক্ষা বড় অভিযোগটি অবশ্যই শিক্ষকদের বিরুদ্ধে। যে হেতু ছাত্রসমাজ ও দাদাসমাজ প্রমাণ করিতে তৎপর যে শিক্ষকরা ছাত্রদের ‘শত্রুপক্ষ’— শিক্ষকরা ক্লাস করেন না বলিয়াই ছাত্ররা ক্লাস করে না, যুক্তি হিসাবে ইহা ব্রহ্মাস্ত্র।
একটি প্রশ্ন উঠিবেই। নিশ্চয় শিক্ষকদের ক্লাস না করা একটি বড় সমস্যা। রাজ্যের উচ্চশিক্ষাসমাজ এই রোগে পর্যুদস্ত। কিন্তু ছাত্রদের ৬০ শতাংশ উপস্থিতির প্রেক্ষিতে কথাটি উঠিতেছে কেন? শিক্ষকরা যে ক্লাস লইতেছেন, তাহার ৬০ শতাংশ ছাত্ররা করিতেছেন কি না, তাহাই তো এখানে প্রশ্ন। সুতরাং শিক্ষকরা বলিবেন— যে ক্লাস তাঁহারা লন, সেখানেও ছাত্ররা হাজির থাকেন না বলিয়াই তাঁহারাও ক্রমে অনুৎসাহী হইয়া পড়িয়াছেন। শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য এই প্রসঙ্গে সঙ্গত একটি কথা মনে করাইয়া দিয়াছেন। ছাত্রহাজিরার চিন্তা না করিয়া শিক্ষকরা শিক্ষকদের কাজ করুন, অর্থাৎ পড়ান। কী দুর্ভাগা সেই দেশ যেখানে এত স্বাভাবিক কথাও মন্ত্রীকে দণ্ডহস্তে আজ্ঞা দিতে হয়— শিক্ষকরা ক্লাস লউন, ছাত্ররা ক্লাস করুন!
সুতরাং মূল কথাটি হইল, পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাসমাজে এখন কোনও মঙ্গল-অমঙ্গল উচিত-অনুচিত চিন্তার স্থান নাই, স্থান কেবল পেশিবলের। যেখানে শিক্ষকদের পেশির জোর বেশি, অর্থাৎ তাঁহাদের প্রতি রাজনীতির প্রশ্রয় বেশি, সেখানে এক রকম চিত্র। আর যেখানে ছাত্ররা রাজনৈতিক ইউনিয়নের উদার সৌহার্দ্যে সমৃদ্ধ, সেখানে আর এক রকমের। শাসক রাজনীতি এক পক্ষকে ‘দেখিলে’ বিরোধী আর এক পক্ষকে ‘দেখিবে’। তাই শিক্ষাদানের নৈতিকতা, ছাত্রশিক্ষক সম্পর্কের পারস্পরিকতা ইত্যাদি সবই গত প্রজন্মের যুক্তি কিংবা তর্ক। ইউজিসির বাঁধিয়া দেওয়া ৭৫ শতাংশ হাজিরার নিয়মটি বিনা আলোচনায় ৬০ শতাংশে নামাইয়া আনিবার পরও ছাত্রপক্ষ বনাম শিক্ষকপক্ষের মৈত্রী তাই কার্যত অসম্ভব। মৈত্রী বা পারস্পরিকতা তো রাজনীতির মশলা হইতে পারে না। রাজনীতির জন্য যাহা চাই, শিক্ষাভুবন অপর্যাপ্ত পরিমাণে তাহা জোগান দিলেই সব পক্ষ খুশি। তাহার নাম দ্বন্দ্ব!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy