আর্থিক অসাম্য বিষয়ে বাৎসরিক রিপোর্টটি প্রকাশিত হওয়া ইস্তক পরিচিত হল্লা শুরু হইয়া গিয়াছে। অসাম্য বিপুল, সুতরাং সে বিষয়ে চর্চাও বিপুলতর হইবে, তাহা স্বাভাবিক। কিন্তু, তর্কটি নিয়ম মানিয়া ভুল প্রশ্ন লইয়া হইতেছে। প্রথমত, ভারতের ধনীতম ব্যক্তিদের সহিত দরিদ্রতমদের তুলনায় একটি ব্যাকরণগত ভুল আছে। মুকেশ অম্বানীর ন্যায় ব্যক্তির সম্পদের একটি বড় অংশ আছে কোম্পানির শেয়ারে। তাহার বাজারদরের উপর সম্পদের ওঠানামা নির্ভরশীল। সেই অঙ্ককে হাতে থাকা টাকার সহিত তুলনা করা মুশকিল। কিন্তু, সেই তুলনায় প্রয়োজনই বা কী? ধনতন্ত্রে অসাম্য থাকিবে, ইহা প্রায় স্বতঃসিদ্ধ। সেই অসাম্যে আপত্তি থাকিলে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থাটি লইয়াই আপত্তি করিতে হয়। তেমন আপত্তি বিংশ শতক নেহাত কম দেখে নাই। এবং বুঝিয়াছে, ভাল-মন্দ মিশাইয়া ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থাই দুনিয়ার সার্বিক উন্নতির পক্ষে সর্বাপেক্ষা অনুকূল। অষ্টাদশকাণ্ড মহাভারতের পর ভীষ্মের ঠিকুজি ঘাঁটিবার অর্থ হয় না। আর্থিক অসাম্যের তুলনায় জরুরিতর প্রশ্নগুলিকে আলোচনার কেন্দ্রে লইয়া আসা বিধেয়। তাহাতে একটি সমস্যা আছে— মুকেশ অম্বানীর সহিত রামা কৈবর্তের তুলনা করিলে তাহাতে চমকের তীব্রতা থাকে, ফলে লোকের মনোযোগ আকর্ষণ করাও সহজ হয়। কিন্তু, অর্থনীতির কেন্দ্রে যদি রাজনীতির প্রকৃত বোধকে প্রতিষ্ঠা করিতে হয়, তবে এই চটজলদি চমকের মোহ কাটানোই বিধেয়।
আসল প্রশ্নগুলিও এই রিপোর্টেই আছে। যেমন, গত এক বৎসরে ধনীতম মানুষের সম্পদ বাড়িয়াছে ৩৯ শতাংশ হারে, আর দরিদ্রতম ৫০ শতাংশের আয় বাড়িয়াছে টাকায় মাত্র তিন পয়সা। দেশের দরিদ্রতম ১০ শতাংশ মানুষ ২০০৪ সাল হইতে কখনও ঋণমুক্ত হইতে পারেন নাই। অর্থাৎ, ধনতন্ত্র যে উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দেয়, ভারতে তাহা রক্ষিত হয় নাই। ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার যুক্তি হইল, অর্থনীতি যত বেগবান হইবে, আর্থিক কর্মকাণ্ড যত বাড়িবে, ততই দরিদ্র মানুষের নিকট তাহার সুফল উপচাইয়া আসিবে। নরেন্দ্র মোদী বা একদা যিনি মোদীর প্রবলতম অর্থনৈতিক সমর্থক ছিলেন সেই জগদীশ ভগবতীরা এই ট্রিকল ডাউন তত্ত্বের মহিমাকীর্তন করেন। অন্তত, করিতেন। স্পষ্টতই, ভারতে আর্থিক সমৃদ্ধি গরিব মানুষের ঘরে উপচাইয়া আসে নাই। কেন, তাহা বোঝা সম্ভব। আর্থিক বৃদ্ধি যতটুকু হইয়াছে, কর্মসংস্থানের অভাবে তাহার ফল সুষম হয় নাই। নোট বাতিল এবং জিএসটি-র ধাক্কায় অসংগঠিত ক্ষেত্রের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছে। কৃষিতে অন্ধকার। অর্থাৎ, অর্থনীতির সমৃদ্ধি যে পথগুলি দিয়া গরিবের ঘরে সরাসরি আসিতে পারিত, গত সাড়ে চার বৎসরে সেই পথগুলি বন্ধ হইয়া গিয়াছে। আবার, রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে যে পরোক্ষ পথগুলি খোলা থাকিবার কথা, সেগুলিতেও ধারা ক্রমে ক্ষীণতর হইয়াছে। এনরেগা একটি বড় উদাহরণ। সর্বোচ্চ দশ শতাংশ মানুষ ক্রমে সমৃদ্ধতর হইলে সরকার তাঁহাদের উপর করের বোঝা বাড়াইয়া সেই বাড়তি টাকা গরিবের স্বার্থে ব্যয় করিবার কথাও ভাবে নাই। আর্থিক অসাম্যের তর্কটিকে এই পরিসরে দেখাই বিধেয়। রাজনীতিকেও এই স্তরে লইয়া যাইতে হইবে। ধনতন্ত্রের বিরুদ্ধে স্লোগান দেওয়া সহজ। বামপন্থীরা সেই সহজ পথেই সন্তুষ্ট। কিন্তু, রাজনীতির প্রকৃত প্রশ্নগুলিকে খুলিতে হইবে বইকি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy