কে দায়ী? এটা কোনও প্রশ্ন বা তর্কের বিষয় হতে পারে? নাকি হওয়া উচিত?
চুরি গিয়েছে খাবারের থালাটা। কী ভাবে থালাটা ফিরে পাওয়া যায়, সে নিয়ে ভাবছি না আমরা। কারণ আমরা এখন ব্যস্ত। কাকে দায়ী করা যায়, সেটাই ভেবে মরছি আপাতত। কার দোষ? স্থলপুলিশ, নাকি জলপুলিশ? কার দেখার কথা ছিল বিষয়টা? সে নিয়েই তর্ক চলছে।
কথা ছিল লজ্জিত হওয়ার। অসীম লজ্জার বিষয়। কখনও আমরা বলেছি ভারতের ‘উদয়’ ঘটেছে। কখনও আমরা বলেছি নতুন করে ভারতের ‘নির্মাণ’ হয়েছে। এখন বলছি ভারত ‘ডিজিটাল’ হয়ে গিয়েছে। দশকের পর দশক ধরে দেশের ‘অগ্রগতি’ নিয়ে শ্লাঘার শেষ নেই। ক্রম ক্ষমতায় কতগুলো দেশকে ছাড়িয়ে গিয়েছি, অর্থনীতির আকারে কতটা সামনের সারিতে চলে এসেছি, সামরিক শক্তিতে কতটা আস্ফালন করার জায়গায় পৌঁছে গিয়েছি, ফি বছর কত টাকার অস্ত্র কিনছি, গোটা দেশে কী ভাবে পরিকাঠামোর উন্নয়ন ঘটিয়েছি, মহাকাশে কতটা পথ পাড়ি দিয়েছি— সে নিয়ে বিস্তর দর্প আমাদের। দর্প অথবা শ্লাঘারই বিষয় এ সব, সংশয় নেই তাতে। কিন্তু সুদূর মহাকাশেও চোখ রাখতে দক্ষ হয়ে গিয়েছে যে রাষ্ট্র, সে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইনসভার মাত্র কয়েক কিলোমিটারের বৃত্তে অনাহারের ভয়াল বাসা! দেখতেই পায়নি রাষ্ট্র! তিনটি শিশুর প্রাণ চলে গেল স্রেফ না খেতে পেয়ে!
এ লজ্জা আমরা রাখব কোথায়? দিল্লির ওই তিনটে শব আমরা রাখব কোথায়? স্বাধীনতার পর সাত-সাতটা দশক পেরিয়ে এসেছি। ধনকুবেরের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। দৈনন্দিন জীবনে অসীম জৌলুসের যাবতীয় উপকরণ ভেসে বেড়াচ্ছে। কিন্তু এক বিপুল সংখ্যক নাগরিকের নাগালের অনেক বাইরে থেকে যাচ্ছে এখনও সে সব। ধনবৈষম্য ক্রমশ বাড়ছে, সম্পদ ক্রমশ মুষ্টিমেয়ের হাতে সমন্বিত হচ্ছে, আর কোটি কোটি নাগরিকের রোজকার সংগ্রাম ক্রমশ কঠিন হচ্ছে। গোটা বিশ্বে অনাহার কমছে ২৭ শতাংশ হারে, আর ভারতে কমছে ১৮ শতাংশ হারে। কঠিন থেকে কঠিন হতে থাকা সেই জীবন-সংগ্রামটারই প্রতীক হয়ে সম্ভবত ধরা দিল সংসদ ভবনের কয়েক কিলোমিটার মধ্যে অনাহারের শিকার হয়ে পড়া তিন শিশু।
সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
অন্য একটি তত্ত্বও অবশ্য আসছে। অনাহারে নয়, বিষক্রিয়ায় মৃত্যু। এমন কথাও শোনা যাচ্ছে। যদি মেনেও নেওয়া হয় যে, দিল্লিতে ওই তিন শিশুর মৃত্যু না খেয়ে হয়নি, তা হলেও কি এ দেশের অনাহারের ছবিটা খুব একটা বদলাবে? আন্তর্জাতিক খাদ্যনীতি গবেষণা সংস্থার তৈরি বিশ্ব ক্ষুধা সূচক কী বলছে? বলছে অনাহারের সূচকে ভারতের স্থান ১০৬ নম্বরে। অনাহার মেটানোয় পাকিস্তান ছাড়া অন্য সব প্রতিবেশী এগিয়ে রয়েছে ভারতের থেকে। চিন তো বটেই, নেপাল, বাংলাদেশ, মায়ানমারের মতো দেশেও অনাহারের মার অনেক কম ভারতের চেয়ে। আমরা সে সব নিয়ে ভাবছি না, সে বিশ্লেষণে যাচ্ছি না। এক পক্ষ বলছে কেন্দ্র দায়ী। আর এক পক্ষ বলছে রাজ্য দায়ী। অন্য কোনও পক্ষ বলছে, পূর্ববর্তী শাসকরা দায়ী।
কে দায়ী? এটা কোনও প্রশ্ন বা তর্কের বিষয় হতে পারে? নাকি হওয়া উচিত? যে তিনটি শিশুর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে এত তোলপাড় দেশজুড়ে, তাদের মৃত্যু যদি অনাহারে না-ও হয়ে থাকে, তা হলেও কি এ কথা আমরা বলতে পারব যে, ওই পরিবার অত্যন্ত সুখী এবং সমৃদ্ধশালী জীবন যাপন করছিল? দারিদ্রের করাল গ্রাস পরিবারটাকে ঘিরে, অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। শুধু ওই একটা পরিবার নয় বা ওই চার-পাঁচ জন নাগরিক নন। এ দেশের কোটি কোটি নাগরিক পরিবার-পরিজন নিয়ে দারিদ্রের ওই রকম করাল ছায়াতেই দিন কাটান। সাড়ে সাত কোটি শিশু রক্তাল্পতায় ভোগে। সাড়ে চার কোটি শিশুর ওজন তাদের বয়সের তুলনায় কম। এ হিসেব আবার আমাদের জাতীয় পরিবার সাস্থ্য সমীক্ষা থেকেই প্রাপ্ত, কোনও আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছ থেকে নয়। তার পরেও কি আমরা সুসংহত বা সুস্পষ্ট কোনও নীতি তৈরি করতে পেরেছি, যার মাধ্যমে এই বিপুল সংখ্যক নাগরিককে দারিদ্রের কবল থেকে বার করে আনা যায়? কোনও দিশা কি আমরা খুঁজে বার করতে পেরেছি, যাতে এই নাগরিকদের উপার্জন এবং জীবনযাত্রার মানের উন্নতি ঘটানো যায়? উত্তর কারও কাছে নেই। এই প্রশ্নগুলোর উত্তর না থাকাটাও সমান লজ্জার। রাষ্ট্রের কাছে লজ্জার, রাজনীতিকদের জন্য লজ্জার, সমাজের জন্য লজ্জার, দায়িত্বশীল নাগরিকদের জন্যও লজ্জার।
আরও পড়ুন: অনাহারে শিশু মরে, নেতারা সস্তায় জিভে জল আহারে
আরও পড়ুন: অনাহারে নয়, ৩ শিশুর মৃত্যু বিষে, দাবি নয়া রিপোর্টে
বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের সর্বোচ্চ পীঠস্থানের নিবিড় ভৌগোলিক বৃত্তের মধ্যে যে লজ্জার মুখচ্ছবি ভেসে উঠল, তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রয়েছি আমরা সবাই। এত বছর ধরে কী করলাম তা হলে! নিজেদের নাগরিক কর্তব্যগুলো কি ঠিক মতো পালন করতে পারলাম? যদি তা পারতাম, যদি শাসনযন্ত্রে উপযুক্ত লোকগুলোকে পাঠাতে পারতাম, তা হলে কি এতটা শোচনীয় বাস্তবতার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে হত আজও? আমাদের প্রত্যেকের উচিত নিজেদেরকেই প্রশ্ন করা। শুধু প্রশ্ন করাই নয়, জরুরি উত্তরটাও খুঁজে বার করা। না হলে এ লজ্জার কবল থেকে আমাদের মুক্তি অসম্ভব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy