সূর্যোদয়ের সহিত সশব্দতার যোগ যেন অমোঘ হইয়া গিয়াছে। সূর্যোদয়ের অর্থ দিগন্তরেখা ছাপাইয়া অপার্থিব আলোর বিস্তার নহে, বরং ক্রমাগত বিস্ময়সূচক ধ্বনির সহিত ক্যামেরার খচখচানি। সেরা মুহূর্তটি নিজস্ব ফ্রেমে বন্দি করিবার লক্ষ্যে ঈষৎ ঠেলাঠেলিও বটে। বহু বৎসর পূর্বে টাইগার হিলে গিয়া এই রূপ হইয়াছিল পটলডাঙার চার মূর্তির। কাজেই অভ্যাস নূতন নহে। ইদানীং তাহাতে নূতনতর উপসর্গ যোগ হইয়াছে মাত্র। কোথাও তাহার নাম ইনস্টাগ্রাম, কোথাও বা স্ন্যাপচ্যাট। এবং উপসর্গ ভয়ঙ্কর, জানাইতেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা। তিন দল ব্যক্তিকে কম্পিউটার স্ক্রিনে কিছু পেন্টিং দেখাইয়া তাঁহারা পরীক্ষা করিয়াছিলেন। প্রথম দল শুধু ছবি দেখেন, দ্বিতীয় দল দেখেন এবং ফ্রেমবন্দি করেন, তৃতীয় দল ফ্রেমবন্দি করিয়াই স্ন্যাপচ্যাটে তুলিয়া দেন। প্রথম হইতে তৃতীয় দলে ক্রমানুযায়ী পর্যবেক্ষণ বলিতেছে, দর্শকদের মনোযোগ কমিতেছে ২০ শতাংশ করিয়া। মূল কথাটি হইল, যত বেশি দলিলায়নের বন্দোবস্ত, তত কম স্মরণে রাখিবার ক্ষমতা।
ক্ষমতা না বলিয়া ইচ্ছা বলাই হয়তো শ্রেয়। দলিল সঙ্গে রহিয়াছে, এই আশ্বাস মনের কোণে থাকিলে দৃশ্যকে সযত্নে লালন করিবার ইচ্ছা ততটা জন্মে না। চারি পাশকে আত্মস্থ করিবার পরিবর্তে তখন কেবল উহাকে যথারূপে যথাস্থানে পরিবেশন করিবার ভাবনাটি প্রাধান্য পায়। যাঁহাদের জগতের সাক্ষাতে পরিবেশনের কাজটিও সম্পন্ন হইয়া যায় তৎক্ষণাৎ, তাঁহাদের আর কিছুই পড়িয়া রহে না। নূতনকে অবলোকন করিবার পূর্বেই তাঁহারা প্রিয়জনদের নিকটে তাহা উপস্থাপন করিয়া ফেলেন, কাজেই উহাকে ভুলিয়া যাইলে ক্ষতিবৃদ্ধি নাই। পাছে স্মরণে রাখিতে গিয়া মগজে চাপ পড়ে, আর সেই চাপের কারণে কোনও রূপে স্থানটি বিস্মৃত হয়, অতএব চটজলদি দলিল বানাইয়া তাহা প্রেরণের অভ্যাস। নিজে ভাল করিয়া দেখা হউক বা না-হউক, অপরকে তাহা দেখাইয়া দেওয়া চাই। পরের স্থানটি আসিতে আসিতে কোন স্মৃতির অতলে ভাসিয়া যায় সেই সূর্যোদয়। কিন্তু যাঁহাদের সেই সুযোগ নাই, তাঁহারা ছবি সঞ্চয়ের বদলে স্থানটি তুলিয়া রাখেন মনের মণিকোঠায়।
স্মরণে আসিতে পারে গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস-এর ‘ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অব সলিচিউড’ উপন্যাস। সেই কাহিনিতে বিবৃত আশ্চর্য ভুবনে ভুলিয়া যাওয়ার রোগ দেখা দিয়াছিল। বস্তু চিনিবার এবং মনে রাখিবার উদ্দেশ্যে ঘড়ি, দরজা, দেওয়াল, পালঙ্ক সর্বত্র বস্তুর নাম লিখিয়া চিহ্নিত করিয়া দেওয়া হইয়াছিল। ইংরেজি ‘মেমেন্টো’ কিংবা তামিল-হিন্দি ‘গজনী’ চলচ্চিত্রেও ইন্টেরোগ্রেড অ্যামনেশিয়া অর্থাৎ তৎক্ষণাৎ ভুলিয়া যাওয়ার রোগে আক্রান্ত নায়ক এই রূপ কর্ম করিত। স্ন্যাপচ্যাটও কতকটা তাহাই। রোগটি, স্পষ্টতই, বহুরূপী। প্রসঙ্গত, পূর্বে গ্রন্থ হইতে হাতে লিখিয়া বা টাইপরাইটার ব্যবহার করিয়া পাঠ্য বিষয়ের প্রতিলিপি করিবার কালে চক্ষু মেলিয়া বস্তুটি দেখিবার প্রয়োজন পড়িত। তাহার পর আসিল প্রতিলিপি করিবার যন্ত্র। বহু ভার লাঘব করিলেও অর্থব্যয়ের প্রয়োজন থাকিবার ফলে ইহার সুযোগ অপরিমিত ছিল না। স্মার্টফোনে ছবি তুলিবার যুগে বিনা মূল্যে যত বার ইচ্ছা বোতাম টেপা সম্ভব। অতএব কেবলই দলিলায়ন এবং অব্যবহার। এবং অনিবার্য বিস্মৃতি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy