গ্রাফিক— শৌভিক দেবনাথ।
তিনিও বৃদ্ধ হলেন। অবশ্য তাঁর সুবিশাল গোঁফজোড়ায় পাক ধরেনি। লাল রঙের শেরওয়ানি আর ডোরাকাটা পাগড়ি আজও নিভাঁজ। ১৯৪৬ সাল থেকে আজ পর্যন্ত তিনি একই রকম বিনয়ে আপ্যায়ন করে চলেছেন তাঁর অভ্যাগতদের। তিনি ‘মহারাজা’। ভারতের সরকারি বিমান সংস্থা এয়ার ইন্ডিয়ার ‘ম্যাসকট’। ২০২১ সালে ৭৫ বছর পূর্ণ হল মহারাজার।
চেহারা রাজকীয় হলেও তিনি কোনও ‘রাজসিক’ ব্যক্তিত্ব নন। জানাচ্ছেন মহারাজার অন্যতম স্রষ্টা ববি কুকা। ১৯৪৬ সালে ববি ছিলেন এয়ার ইন্ডিয়ার কমার্শিয়াল ডিরেক্টর। সংস্থার ব্র্যান্ড নির্মাণ করতে গিয়েই তিনি এবং তদানীন্তন মুম্বইয়ের এক নামজাদা বিজ্ঞাপন সংস্থার শিল্পী উমেশ রাও মিলে তৈরি করেন মহারাজাকে। এয়ার ইন্ডিয়া তখন ব্রিটিশ ভারতের একমাত্র আন্তর্জাতিক বিমান সংস্থা। সেখানে মহারাজার মতো এক ম্যাসকটকে নিয়ে আসার পিছনে অনেক কারণ কাজ করেছিল। পশ্চিমী বিশ্বে তখনও ভারত ‘রাজারাজড়া’-র দেশ। জাদুসম্রাট পিসি সরকার মঞ্চে উঠতেন দেশীয় রাজার পোশাকে। জাদু আর রাজা-মহারাজা সেখানে একাকার। এমন এক পরিমণ্ডলে এক মহারাজাই যে এ দেশের বিমান সংস্থার মুখচ্ছবি হিসেবে মোক্ষম হবেন, সে কথা কুকা এবং রাও বুঝেছিলেন। লক্ষ করার বিষয়, মহারাজার আকারটিও বেশ সরল। পাগড়ি সমেত মাথাটি একটি গোলক। ফলে কোথাও এক সারল্যের ছোঁয়াও ছিল তাঁর নির্মাণে।
প্রথমে এয়ার ইন্ডিয়ার লেটার হেডের জন্য মহারাজাকে আঁকা হলেও অচিরেই তিনি আবির্ভূত হতে থাকেন সংস্থার বিভিন্ন বিজ্ঞাপন ও ব্র্যান্ড প্রোমোশনের কাজে। ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হয়। কিন্তু মহারাজার স্থানটি অক্ষুণ্ণ থেকে যায়। পরের বছরগুলিতে মহারাজাকে নিয়ে অসংখ্য বিজ্ঞাপন করে এয়ার ইন্ডিয়া। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন শহরে উপস্থিত মহারাজা। সেই সব দেশের পোশাকে অথবা তাঁকে ঘিরে রয়েছে সেই সব শহরের মোটিফ। আইফেল টাওয়ার থেকে স্ট্যাচু অব লিবার্টি পর্যন্ত মহারাজার অবাধ গতি। রাশিয়ায় মহারাজা হয়ত কালিঙ্কা নাচে রত, নাইরোবিতে তিনি সিংহের হাতে বন্দি। ব্রাসেলসের বিখ্যাত ‘মানেকেন পিস’ বা হিসু-করা উলঙ্গ শিশুটির গায়ে নিজের শেরওয়ানি পরিয়ে দিতে দেখা গিয়েছে মহারাজাকে। আবার দিল্লিতে তিনিই উর্দি পরে সাইকেল চালিয়ে সংসদ ভবনের সামনে উপস্থিত। আমূলের বিজ্ঞাপনের বালিকাটির মতোই মহারাজা বার বার নব অবতারে দেখা দিয়েছেন। সালতামামির ইতিহাস ঘাঁটতে বসলে দেখা যায়, আমূল-বালিকা মহারাজার থেকে পাক্কা ২০ বছরের ছোট। তার জন্ম ১৯৬৬ সালে। তবে বিজ্ঞাপন বিশেষজ্ঞরা দুই ম্যাসকটকেই এক পঙক্তিতে রাখেন তাদের জনপ্রিয়তার জন্য। বার বার নব কলেবরে এসে মানুষের মন জয় করার জন্য। বিজ্ঞাপন সৌকর্য ও নান্দনিকতার কারণে একাধিক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারও পেয়েছেন মহারাজা।
মহারাজাকে ভারতীয় বিজ্ঞাপনের ইতিহাসে এক ‘বৈগ্রহিক’ সৃষ্টি বলেই মনে করেন কলকাতার এক বিজ্ঞাপন সংস্থার কর্ণধার শৌভিক মিশ্র। এক সময়ে বিমান সংস্থার বিলবোর্ডের সীমানা ছাড়িয়ে মহারাজা হয়ে উঠেছিলেন শহরের এক শাড়ির দোকানের ম্যাসকটও। শৌভিকের মতে, কাজটা ঠিক আইনসম্মত না হলেও সেখানেই বিজ্ঞাপনের সাফল্য। এয়ার ইন্ডিয়ার মতো বড় সংস্থাও তাই মাথা ঘামায়নি মহারাজার এই জাতীয় ‘ব্যবহারে’। আসলে ভারতীয় ঐতিহ্য, আভিজাত্য এবং বিনয়কে একত্রে ধরে আছে এই ম্যাসকট। তাঁর দাঁড়ানোর ভঙ্গিই যেন বলে দেয় ‘অতিথি দেব ভব’। শৌভিকের মতে, মহারাজা কোনও ব্র্যান্ডের সীমানা ছাড়িয়ে তখন এক সাংস্কৃতিক প্রতীক। মহারাজাকে নিয়ে এক পুরনো টেলিবিজ্ঞাপনের কথা মনে করিয়ে দেন শৌভিক— একটি কাগজে আঁকা গ্লোব ক্রমে মহারাজার পাগড়ি পরা গোল্লামার্কা মাথা হয়ে যাচ্ছে। শৌভিকের মতে, মেধাবি ব্যবহার। বিশ্বসফর আর মহারাজা সেখানে একাকার।
তবে মহারাজার সমালোচনাও হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, কেন এক গণতান্ত্রিক দেশের সরকারি বিমান সংস্থার বিজ্ঞাপন প্রতীক হবেন একজন ‘মহারাজা’। কথা হয় ম্যাসকট বদলানোরও। কিন্তু মহারাজা ততদিনে গণতন্ত্রের শরিক হয়ে গিয়েছেন। আসমুদ্রহিমাচল ভারতীয়ের ঘর সাজানোর সামগ্রীতে রূপান্তরিত হয়েছেন।
বিমানসফর এক সময়ে ভারতীয় মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরের বিষয় বলেই বিবেচিত হত। বিমানবন্দরের বাইরে থেকে উড়ান দেখার জন্য মানুষের ভিড় ছিল। চিড়িয়াখানা, জাদুঘরের মতো কলকাতা বিমানবন্দরও ছিল দর্শনীয় স্থান। কিন্তু অনায়াসলভ্য ছিলেন মহারাজা। রথের মেলায় ডাগর চোখের বৌ-পুতুল, শাশুড়ি-পুতুলের মাঝখানে তাগড়াই গোঁফ আর ডোরাদার পাগড়ি পরে বিনয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন তিনিও। তাঁর পাগড়ির তাজের জায়গায় গোঁজা থাকত রং করা পাখির পালক। কোঁকড়া চুলে রিবন বাঁধা খুকি মেলাতলায় বায়না করে আদায় করত তাঁকে। তার পর তিনি চালান হয়ে যেতেন পুতুলের সংসারে। টোবো টোবো গালওয়ালা মাটির রানি পুতুলের সঙ্গে যে কত বার বিয়ে হয়েছে তাঁর, সে কথা এ দেশের মধ্যবিত্ত সংসারের অলিখিত ইতিহাস জানে, ভারতীয় শৈশবের অকথিত আখ্যান জানে। পুতুলের বাক্সে একদিন খসে গিয়েছে মহারাজার পাগড়ির পালক। তাজ হারিয়ে তিনি নেমে এসেছেন একেবারে সাধারণের স্তরে। মধ্যবিত্তের মাথার উপর দিয়ে আওয়াজ তুলে উড়ে গিয়েছে বিমান। সেই আওয়াজে সচকিত হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকেছে মধ্যবিত্ত জীবন। তার ঘরের কোণে, কাচের বাসন রাখা আলমারিতে যে রাখা রয়েছে সেই বিমানের আত্মার সঙ্গে জড়িত মহারাজা, সে কথা সে হয়তো মনেও রাখেনি।
মহারাজার ৭৫ বছরের যাত্রায় বদল এসেছে সংস্থার চরিত্রেও। বেসরকারি বিমান সংস্থাগুলির সঙ্গে লড়াইয়ে এয়ার ইণ্ডিয়া কিছুটা ক্লান্ত। সেই ক্লান্তির রেশ কি মহারাজার ছবিতেও? ভারতীয় মধ্যবিত্ত এখন কথায় কথায় বিমানযাত্রা করে। এমন দুনিয়ায় মহারাজা যে খানিক জৌলুসহীন, তা অস্বীকার করা যায় না। এই প্রজন্মের ভারতীয় শিশুদের কাছে মাটির পুতুলও সহজলভ্য নয়। তাই ‘মাটির মানুষ’ মহারাজা আজ নিছক এক ‘বিগ্রহ’। তাঁর রূপকথাও থমকে আছে এদেশের মানুষের স্মৃতি-বিস্মৃতির অন্তরালে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy