Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Lionel Messi

Lionel Messi: দরকার হলে একশো বার কাঁদব, মেসির মতোই অঝোরে কাঁদব

ভীমবেগে গোটা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে যাচ্ছিল ছবিটা— পেপার ন্যাপকিনে মুখ ঢেকে কাঁদছেন লিওনেল মেসি।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

অনিন্দ্য জানা
অনিন্দ্য জানা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ অগস্ট ২০২১ ১৪:১৪
Share: Save:

দিনের ছবি হয়ে গেল! মোবাইল দেখতে দেখতে বললেন পাশে বসা অনুজ সহকর্মী। ইডেন গার্ডেনসের ক্লাব হাউসের দোতলার মিডিয়া সেন্টারে নিমেষে ছড়িয়ে গেল গুঞ্জনটা। আরও ভীমবেগে গোটা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে যাচ্ছিল ছবিটা— পেপার ন্যাপকিনে মুখ ঢেকে কাঁদছেন লিওনেল মেসি।

রবিবার। বার্সেলোনা ছেড়ে যাওয়ার আগে শেষ সাংবাদিক বৈঠক করার কথা আধুনিক ফুটবলের ঈশ্বরের। কিন্তু দেখা গেল, মঞ্চে পৌঁছেও সাংবাদিক বৈঠক শুরুই করতে পারছেন না মেসি। ‘এফ সি বার্সেলোনা’ লেখা পোডিয়ামের সামনে দাঁড়িয়ে কিছু কথা বলার আগেই ভেঙে পড়লেন। আবেগে ঠোঁট কাঁপছে। চোখ থেকে গড়িয়ে আসা অশ্রু আটকানোর ব্যর্থ চেষ্টায় তাঁকে ভঙ্গুর দেখাচ্ছে। মাথা নিচু। অনেকক্ষণ নাকি অল্পক্ষণ? পেপার ন্যাপকিন তুলে চোখ মুছতে শুরু করলেন বার্সেলোনার বিদায়ী নক্ষত্র। পরের কয়েক ঘণ্টায় যে দৃশ্য দেখে ফেলবে কোটি কোটি মানুষের দুনিয়া। যে ভিডিয়ো নেটমাধ্যমকে ভাসিয়ে নেবে বন্যার জলের মতো। ভেঙেচুরে একাকার হয়ে যাবে ভগবানের ভক্তকুল।

পাশাপাশি এক মধ্যবয়সির মনে জন্ম দিয়ে যাবে অমোঘ প্রশ্নের— তা হলে পুরুষমানুষও সর্বসমক্ষে কাঁদে? কাঁদতে পারে? ভাববে, অদ্যাবধি শুনে আসা ‘মেয়েদের মতো কাঁদিস না তো’ বা ‘পুরুষমানুষ সকলের সামনে চোখের জল ফেলবে না’ মার্কা বলবর্ধক পৌরুষের যে কড়া জোলাপ সমাজ আবাল্য খাইয়ে এসেছে, তার কী হবে! তদ্গত হয়ে ভাববে, লিওনেল মেসি, আধুনিক ফুটবলের শ্রেষ্ঠ প্রতিভা বহুলালিত এক সনাতন ধারণাকে ধুয়ে দিলেন চোখের জলে।

কোপা ফাইনালে চিলির কাছে হেরে অবসরও নিয়ে ফেলেছিলেন মেসি। ছবি: রয়টার্স।

কোপা ফাইনালে চিলির কাছে হেরে অবসরও নিয়ে ফেলেছিলেন মেসি। ছবি: রয়টার্স।

সামনে বসা স্ত্রী আন্তোনেল্লা এবং তিন নাবালক সন্তান। আশেপাশে ছড়িয়ে বার্সেলোনার সতীর্থ ফুটবলাররা। পরিচিত সাংবাদিক। সর্বসমক্ষে চোখের জলে ভেসে মেসি বলছিলেন, ‘‘এটা মেনে নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে। বার্সেলোনায় প্রথম থেকেই নিজের সেরাটা দিয়েছি। কখনও ভাবিনি, এমন একটা অবস্থা তৈরি হবে। এ ভাবে ক্লাবকে বিদায় জানাতে চাইনি। আশা করছি, একদিন ঠিক ফিরে আসব।’’ চোখের জল মুছতে মুছতে বলছিলেন, ‘‘এইদিনটা আসবে কখনও ভাবতে পারিনি। কখনও মিথ্যে বলিনি। সবসময় সৎ থেকেছি। গত সিজনে ক্লাব ছাড়তে চেয়েছিলাম ঠিকই। কিন্তু এ সিজনে থাকতেই চেয়েছিলাম। যন্ত্রণাটা সে কারণেই।’’ এ-ও কি এক আশ্চর্য সমাপতন নয় যে, ১৩ বছর বয়সে যে ফুটবল প্রতিভাকে পেপার ন্যাপকিনে সই করিয়ে তাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ করিয়েছিল বার্সেলোনা, ২১ বছর পর সেই পেপার ন্যাপকিন দিয়েই তাঁকে মুছতে হল বিদায়বেলার আবেগাশ্রু। বৃত্ত সম্পূর্ণ? হতে পারে।

আর্জেন্টিনার রোজারিয়ো থেকে লা মাসিয়া অ্যাকাডেমিতে যোগ দিয়েছিল বালক মেসি। তার পর থেকে গত একুশ বছরে বার্সেলোনাই তার ঘরবাড়ি থেকেছে। প্রতিভাধর বালক থেকে আধুনিক বিশ্ব ফুটবলের ঈশ্বর হওয়া বার্সেলোনাতেই। আশ্চর্য নয় যে, মেসি বলেছেন, ‘‘এটা আমার জীবনে এক অন্যতম দুঃখের দিন। আমি বার্সেলোনাকে ভালবাসি। বার্সেলোনায় থাকার জন্য যথাসম্ভব চেষ্টাও করেছিলাম। আমার পারিশ্রমিক ৫০ শতাংশ কমানোর প্রস্তাব দিয়েছিলাম। কিন্তু বার্সার পক্ষ থেকে আমায় অন্য কোনও প্রস্তাব দেওয়া হয়নি। ক্লাব আমার পারিশ্রমিক আরও ৩০ শতাংশ কমাতে বলেছে বলে যা রটনা হয়েছিল, তা সম্পূর্ণ অসত্য! এই শহরটাই আমার ঘরবাড়ি হয়ে উঠেছিল। দীর্ঘ একুশ বছরের সম্পর্ক ছিন্ন করে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে বার্সেলোনা থেকে বিদায় নিচ্ছি।’’

ক্লাবকে বহু ট্রফি এনে দিয়েছেন বার্সার ১০ নম্বর। ছবি: রয়টার্স।

ক্লাবকে বহু ট্রফি এনে দিয়েছেন বার্সার ১০ নম্বর। ছবি: রয়টার্স।

বলছিলেন আর আবেগে গলা বুজে আসছিল মেসির। হাজার হাজার মাইল দূরে বসে এক বেভুল মধ্যবয়সি ভাবছিল, পুরুষদের মাথায় পৌরুষের যে নির্মাণ চলে, সেখানে তো পুরুষমানুষকে প্রকাশ্যে আবেগতাড়িত হতে নেই। কাঁদতে নেই। নির্জনে চোখের জল ফেলতে গেলেও তাকে বোধহয় ভাবতে হয়— একটু কম পুরুষ হয়ে গেলাম না তো! চৌত্রিশ বছরের মেসি সেই বিষাক্ত পৌরুষের বিনির্মাণ করলেন। লোকসমক্ষে হাপুসনয়নে কেঁদে দেখিয়ে দিলেন, দিব্যি কাঁদা যায়। দেখিয়ে দিলেন, কান্না মানেই দুর্বলতা নয়। যেমন নিরাসক্তি মানেই শোকের অভাব নয়। নিথর থাকা মানেই নিরাবেগ নয়। জানিয়ে দিলেন, চোখের জল না ফেলা পৌরুষের ধারক-বাহক নয়।

ব্যক্তিগত ভাবে চিরকাল মেসির চেয়ে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর বেশি ভক্ত। কারণ, ঈশ্বরদত্ত মেসিকে কখনও ‘চরিত্র’ বলে মনে হয়নি। রোনাল্ডোর ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক জীবনের লড়াই, ছোটবেলায় অ্যালকোহলিক বাবার মৃত্যু, মায়ের নার্সের চাকরি করে চালানো সংসার থেকে উল্কার মতো উত্থান, কুঁড়েঘর থেকে ব্যক্তিগত ইয়টের মালিক, নিত্যনতুন বান্ধবী, বিবাহবন্ধন বহির্ভূত সন্তানের জনক— সি আর সেভেনের মতো রংদার চরিত্র বিশ্ব ফুটবলে কোথায়! পাশাপাশিই, খ্যাতনামী এবং প্রতিভাবান হয়েও জর্জ বেস্টের মতো বিশৃঙ্খলার আবর্তে ঢুকে না পড়ে নিজের ফোকাস ঠিক রাখা। টুর্নামেন্টের ফাইনালে হ্যামস্ট্রিংয়ে চোট নিয়ে স্ট্রেচারে মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েও সাইডলাইন থেকে খোঁড়াতে খোঁড়াতেও মাঠের ভিতরে সতীর্থদের উদ্দীপ্ত করে যাওয়া এবং ফাইনালটা জেতা। সিংহবিক্রম। দৃঢ়সংবদ্ধ চোয়াল। গোল করে শূন্যে লাফ। ঘাসে অবতরণ করার পর বিপক্ষের সামনে ‘আয় না দেখি’ ভঙ্গিতে দু’পা ফাঁক করে দাঁড়ানো। ‘আলফা মেল’ এবং সফল ‘চরিত্র’ তো এমনই হবে। এমনই তো হবেন ‘নেতা’।

বার্সার হয়ে শেষ সাংবাদিক সম্মেলনে আবেগাপ্লুত মেসি। ছবি: রয়টার্স।

বার্সার হয়ে শেষ সাংবাদিক সম্মেলনে আবেগাপ্লুত মেসি। ছবি: রয়টার্স।

পাশাপাশি রাখলে এল এম টেনের জীবনে সেই স্ট্রাগল কোথায়! কোথায় সেই নাটক! পায়ে অজস্র কুঁচির কাজ আছে, তুঙ্গ সাফল্য আছে, পৃথিবীর যে কোনও ফুটবল রক্ষণকে ফালা ফালা করে ফেলার একক ঐশী দক্ষতা আছে, সকলকে বেকুব মানিয়ে ঠিকানা লেখা অত্যাশ্চর্য ফ্রি কিক হেলাফেলায় গোলে পৌঁছনোর ক্ষমতা আছে। ছোটবেলার বান্ধবীকে বিবাহ এবং তার পর তাঁর সঙ্গে নিরুপদ্রবে সংসার করা আছে। নিটোল। মসৃণ। রুটির দু’পিঠে লাগানো মাখনের মতো। সুখী জীবন হিসেবে অনুকরণযোগ্য। কিন্তু ‘চরিত্র’ নয়। ‘নেতা’ নয়। ফলে মেসিভক্তদের কাছে চিরকাল উষ্মার বস্তু হয়ে থেকেছি। মেসি-রোনাল্ডো নিয়ে উদ্দন্ড তর্ক হয়েছে বন্ধুদের আড্ডায়। বারবার গলা উঁচিয়ে বলেছি, বার্সেলোনায় আশেপাশে সাপ্লিমেন্টারি প্রতিভাগুলো পান বলেই মেসি অপ্রতিরোধ্য। আর্জেন্তিনায় পান না বলে নিষ্প্রভ। সেখানে রোনাল্ডো দেশের হয়ে একক ইঞ্জিনের মতো তেজিয়ান ভঙ্গিতে আগুয়ান। গনগনে। এই সেদিনও ইউরো থেকে পর্তুগাল (আসলে রোনাল্ডো) বিদায় নেওয়ায় বিষণ্ণ হয়েছি। মেসি কোপা জেতায় পরিপার্শ্ব যখন আনন্দে মশগুল, তখন মনে হয়েছে, অবশেষে ইনি দেশের হয়ে কাপ জিতলেন! এর আগে পর্যন্ত অলিম্পিক্স ছাড়া দেশের নীল-সাদা জার্সিতে তো কোনও ট্রফি নেই। ২০১৬ সালে কোপার ফাইনালে চিলির কাছে হারার পর যখন বলেছিলেন, আর্জেন্তিনার হয়ে আর খেলবেন না। তীব্র কটাক্ষ করে এক রোনাল্ডোভক্ত লিখেছিল, ‘পালালেন তিনি পালালেন’। সেই অকাল-অবসর ভেঙে ফিরে আসার পর আরও ব্যঙ্গাত্মক কলাম— ‘ফিরিলেন তিনি ফিরিলেন’। কারণ, ‘পালালেন’-এ বলা ছিল, ‘বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে আর ফুটবলার মেসি বার্সেলোনায়।’ পাশাপাশি ভবিষ্যদ্বাণী ছিল, দেশের হয়ে তিনি আবার খেলবেন। আর্জেন্তিনার জার্সি খুলে রাখার সিদ্ধান্ত নেহাতই ফাইনালে হেরে গিয়ে তাৎক্ষণিক আবেগপ্রসূত।

বাস্তবে অন্যকিছু ঘটেনি। কিন্তু অফিসের ল্যান্ডলাইনে একের পর এক আসতে-থাকা ফোনে বুঝেছিলাম, কী ভয়ানক কাণ্ড ঘটিয়ে বসেছি! মেসি আসলে বিগ্রহ। তাঁর গায়ে সামান্য সমালোচনার আঁচড় পড়লে ছেড়ে কথা বলে না তাঁর ভক্তকুল। এতটাই জঙ্গি তারা যে, অর্বাচীন সাংবাদিককেও ছাড়ে না। কিন্তু তবু নিজের ভাবনা থেকে সরে আসিনি। প্রতিভা মনে হয়েছে। ঈশ্বর মনে হয়েছে। অপার্থিব মনে হয়েছে। মায়াবি বিভ্রম মনে হয়েছে। মনে হয়েছে, এঁকে দেখেই ফুটবল সম্পর্কে বলা হয় ‘বিউটিফুল গেম’। কিন্তু মেসিকে কখনও ‘চরিত্র’ মনে হয়নি। মনে হয়েছে, এই লোকটাকে দেখে মুগ্ধ হওয়া যেতে পারে। এই লোকটার খেলা দেখার জন্য রাত জাগা যেতে পারে। মনে হয়নি, এই লোকটার থেকে কিছু শেখা যেতে পারে।

এই প্রথম মনে হল। ‘চরিত্র’ মনে হল। শিক্ষা হল, চোখের জল মানেই দুর্বলতা নয়। দরকার হলে কাঁদব! একশো বার কাঁদব! মেসির মতোই কাঁদব!

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy