‘আত্মনির্ভর’: ঘরে ফেরার অনিশ্চিত পথে পা বাড়িয়েছেন সপরিবার পরিযায়ী শ্রমিকরা। নয়া দিল্লি, মার্চ ২০২০।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন কবি শামসুর রাহমান লিখেছিলেন, “স্বাধীনতা তুমি/ বাগানের ঘর, কোকিলের গান/ বয়েসী বটের ঝিলিমিলি পাতা/ যেমন ইচ্ছে লেখার আমার কবিতার খাতা।” বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের গভীর থেকে উঠে আসা স্বাধীনতার এক সর্বজনীন ইস্তাহার। আজ বাংলাদেশের স্বাধীনতার বয়স পঞ্চাশ বছর অতিক্রান্ত; ভারত পঁচাত্তরের দোরগোড়ায়। কিন্তু কোথায় সেই কোকিলের গান? কোথায় সেই যেমন ইচ্ছে লেখার কবিতার খাতা? করোনার মৃত্যুমিছিলে কোকিল বিষণ্ণ, বটের ঝিলিমিলি পাতা বিবর্ণ, আর কবিতার খাতা ইউএপিএ-রাজদ্রোহ আইন, বা ষড়যন্ত্রী মন্ত্রিমশাইদের শ্যেন পেগাসাস দৃষ্টির কবলে।
স্বাধীনতা মানে সবার আগে অবশ্যই স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস। সে ইতিহাসে জানা-অজানা ছোট-বড় অসংখ্য গৌরবময় অধ্যায়, অগণিত মানুষের মহান আত্মত্যাগ। সে ইতিহাসের অনেকটাই কিন্তু আজও লোকচক্ষুর আড়ালে, অথচ এই ইতিহাসকে ধরেই আজকের ভারতের গড়ে ওঠা। আমাদের আজকের ভৌগোলিক ঐক্য ও জাতীয় চেতনার উৎস এই ইতিহাস। আঠারো ও উনিশ শতকের বিভিন্ন আদিবাসী বিদ্রোহের গৌরবগাথা, আঠারোশো সাতান্ন-র প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলনের ঢেউ, বিয়াল্লিশের ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে গড়ে ওঠা বিভিন্ন স্থানীয় সরকার ও অগণিত স্থানীয় প্রতিরোধে হাজার হাজার মানুষের শহিদের মৃত্যুবরণ— এ বহুমাত্রিক ইতিহাস অবশ্যই আগামী দিনে উঠে আসবে গবেষকদের রচনায়।
আমরা সাধারণ ভাবে স্বাধীনতা আন্দোলন বলতে বুঝি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকের হাত থেকে প্রশাসনিক মুক্তির ইতিহাস। কিন্তু দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসনের পিছনে ছিল ভারতের অভ্যন্তরে উপনিবেশের সামাজিক ও আর্থিক ভিত্তি। তাই অনিবার্য ভাবেই ব্রিটিশ উপনিবেশের এই ভারতীয় ভিত্তিও হয়ে উঠেছে স্বাধীনতা আন্দোলনের নিশানা। আদিবাসী বিদ্রোহ ও কৃষক আন্দোলন জমিদারি ও মহাজনি ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করেছে, করদ রাজ্যগুলিতে স্বাধীনতা আন্দোলন চালিত হয়েছে স্থানীয় রাজার আধিপত্যের বিরুদ্ধে। স্বাধীনতার পর আইনত জমিদারি, মহাজনি, রাজতন্ত্র সবই বিলুপ্ত হয়েছে, কিন্তু থেকে গিয়েছে অবশেষ। আর আজ সব কিছু ছাপিয়ে উঠেছে এ যুগের নতুন জমিদার, নতুন মহাজন, নতুন রাজা— কর্পোরেট প্রভুদের রাজত্ব, বা নয়া কোম্পানি রাজ।
স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় জাতীয় চেতনার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে আর্থিক উন্নয়ন ও ন্যায়সঙ্গত আর্থিক বণ্টনের প্রশ্ন উঠে আসে। জমিদারি প্রথা লোপ, ভূমি সংস্কার, গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক ও আর্থিক সম্পদের জাতীয়করণ এবং একচেটিয়া পুঁজির উপর আংশিক নিয়ন্ত্রণের সাধারণ দিশায় দেশ এগোতে থাকে। কয়লা-সহ বিভিন্ন খনিজ সম্পদ এবং ব্যাঙ্ক ও বিমা শিল্পের জাতীয়করণের কাজ সত্তরের দশকের মধ্যে সম্পন্ন হয়ে যায়। নব্বইয়ের দশকের গোড়া থেকে উল্টোরথ। সেই উল্টোরথ আজ বলতে গেলে দেশের অর্থনীতিকে গুটিকয়েক সংস্থার হাতে তুলে দিয়েছে। জাতীয়করণকে নস্যাৎ করার পাশাপাশি রেল, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো মৌলিক পরিষেবার দায়িত্বও আজ ক্রমেই ব্যক্তিগত মালিকানার উপর ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে— যেটা আগে কোনও দিন ভাবা যায়নি। রাজনীতিতে কথায় কথায় জাতীয়তাবাদ, অর্থনীতিতে সর্বব্যাপী কোম্পানি-রাজ।
এ কাজটা করার জন্য আজ দেশের শাসনব্যবস্থা আবার ফিরে যাচ্ছে সেই ঔপনিবেশিক যুগের আদবকায়দায়। প্রাকৃতিক সম্পদের উপর কোম্পানি-রাজ প্রতিষ্ঠা করতে প্রকৃতির সবচেয়ে কাছের মানুষদের বিরুদ্ধে চলেছে উচ্ছেদের অভিযান। সেই বুলডোজ়ারের বিরোধিতা করলে আদিবাসীদের উপর নির্বিচারে গুলি, মিথ্যা মামলা, দানবীয় আইন। গুজরাত, রাজস্থান, ছত্তীসগঢ়, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ডের বিস্তীর্ণ আদিবাসী অঞ্চল জুড়ে একই ছবি। আদিবাসী জনগণের অধিকার ও ন্যায়ের দাবিতে প্রশ্ন তুলে ভীমা-কোরেগাঁও মামলায় বিচারহীন কারাবন্দি সুধা ভরদ্বাজ; বন্দিদশাতেই প্রাণ হারালেন আদিবাসী-হিতৈষী ফাদার স্ট্যান স্বামী।
ব্রিটিশ আমলে শাসন চলত রাওলাট আইন, রাজদ্রোহ আইন দিয়ে। রাজবাহাদুরের বিরুদ্ধে কথা বললে নির্বিচারে জেল, একের পর এক ষড়যন্ত্র মামলা, এমনকি জালিয়ানওয়ালা বাগের মতো নৃশংস গণহত্যা। সেই রাওলাট আইনের উত্তরসূরি আজকের ইউএপিএ; আর, রাজদ্রোহ আইন সেই আগের মতোই বহাল। দিল্লি হাই কোর্ট সরকারকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে, প্রতিবাদের অধিকারের বিরুদ্ধে ইউএপিএ প্রয়োগ করা যায় না; সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে জানতে চেয়েছেন যে, স্বাধীনতার সাত দশক পরেও নিজের দেশের নাগরিকের বিরুদ্ধে রাজদ্রোহ আইনের কী প্রয়োজন? সরকার নির্লজ্জ, নিরুত্তর।
ব্রিটিশ আমলের তুলনায় আজকের সরকার দমনের প্রশ্নে অনেক এগিয়ে। শারীরিক দমনের পাশাপাশি এই সরকারের হাতে আছে ডিজিটাল অস্ত্র। পেগাসাসের দৌলতে রাষ্ট্র এখন যে কোনও নাগরিকের ফোনে আড়িপাতে। নির্বাচন কমিশনার, সিবিআই ডিরেক্টর, বিরোধী দলনেতা, সাংবাদিক, কারও রেহাই নেই। ইজ়রায়েলের কোম্পানি বলছে তারা সরকার বা সরকারি সংস্থা ছাড়া কাউকে এই আড়িপাতার প্রযুক্তি বিক্রি করে না। তা হলে ভারতে এই প্রযুক্তি কে কিনল? সরকার এ প্রশ্নেও নির্লজ্জ, নিরুত্তর। বিদেশ ও সংস্কৃতি দফতরের রাজ্য-মন্ত্রীর কথায়— শত্রুর বিরুদ্ধে, বামপন্থীদের বিরুদ্ধে কোন প্রযুক্তি আমরা ব্যবহার করছি, তা কেন বলব!
দেশ যখন স্বাধীন হয়েছিল, তখন আমরা এক সংবিধান গ্রহণ করেছিলাম। সে সংবিধানের গোড়াতেই বলা হয়েছিল: স্বাধীন দেশের নাগরিকরাও স্বাধীন। চিন্তার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা; আস্থা, আদর্শ ও উপাসনার স্বাধীনতা। থাকবে ন্যায়ের গ্যারান্টি— সামাজিক, আর্থিক ও রাজনৈতিক ন্যায়। আজ সেই স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক পরাধীন প্রজায় পর্যবসিত। রাজা বলেন— আমি বিনামূল্যে খেতে দিচ্ছি, টিকা দিচ্ছি, ক’জন পেল প্রশ্ন করা যাবে না, কিন্তু প্রজাদের বলতে হবে ‘থ্যাঙ্ক ইউ, মহারাজ’। প্রজাদের বলা অবধি অবশ্য অপেক্ষা করেনি সরকার— দেশ জুড়ে নিজেরাই বিজ্ঞাপন দিয়েছে। এই খরচ আর ওই চাল-গম-টিকার টাকা একই উৎস থেকে আসছে— প্রজাদেরই দেওয়া করের টাকা।
সরকার বলছে স্বাধীনতার সাত দশক পেরিয়ে এখন আত্মনির্ভর হতে হবে। আত্মনির্ভর মানে প্রত্যেক প্রজাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে, সরকারের উপর নির্ভর করলে চলবে না। তাই করোনা অতিমারিতে লকডাউনে আমরা দেখি হাজার হাজার ‘আত্মনির্ভর’ প্রজা মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে বাড়ি ফেরে। আত্মনির্ভর ভারতের নতুন সংসদ ভবন তৈরি হচ্ছে— ব্রিটিশ আমলের পুরনো সংসদ ভবনের পরিবর্তে নতুন ‘আত্মনির্ভর’ রাজদরবার। জুনা আখড়ার মহামণ্ডলেশ্বর যতীন্দ্রনাথ গিরি পরামর্শ দিয়েছেন: নতুন সংসদ ভবন যখন হচ্ছে, তখন নতুন সংবিধানটাই বা বাদ থাকে কেন। নতুন সংসদে নতুন সংবিধান হাতে নিয়েই গৃহপ্রবেশ হোক।
সংবিধানের বিবিধ অন্তর্দ্বন্দ্বের কথা বলেছিলেন সংবিধান রচনা সমিতির চেয়ারম্যান ভীমরাও আম্বেডকর। বলেছিলেন রাজনৈতিক সাম্য বনাম সামাজিক ও আর্থিক বৈষম্যের সংঘাতের কথা। বলেছিলেন রাজনীতিতে ব্যক্তিপূজার বিপজ্জনক প্রবণতার মারাত্মক পরিণতির কথা। বলেছিলেন— স্বাধীনতা, সাম্য, ন্যায়ের পথে অগ্রসর ভারতের পক্ষে হিন্দুরাষ্ট্র হবে এক চরম বিপর্যয়। আজ স্বাধীনতার পঁচাত্তরতম বার্ষিকীর দোরগোড়ায় আমরা সেই বিপর্যয়ের মুখোমুখি। সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা ভারতীয় ঐক্য আজ বহুমুখী বিভাজনের কবলে। এমনকি দুই রাজ্যের সীমা নিয়ে বিবাদ আজ উত্তর-পূর্ব ভারতে অসম ও মিজোরামের পুলিশের মধ্যে সশস্ত্র সংঘাতের রূপ নিচ্ছে।
স্বাধীন ভারতের এই অভূতপূর্ব সঙ্কটলগ্নে কয়েকটি কথা আমাদের আরও এক বার দ্ব্যর্থহীন ভাবে উচ্চারণ করতে হবে। স্বাধীন দেশ মানে স্বাধীন, অধিকারসম্পন্ন নাগরিক, পরাধীন প্রজা নয়— এ কথা আবার জোরের সঙ্গে ঘোষণা করতে হবে; ভারতের ঐক্য বৈচিত্রের মধ্যে, সেই বৈচিত্র ও বহুত্বকে পূর্ণ সম্মান জানাতে হবে; সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতীয়ের ধার্মিক পরিচিতি এবং মুষ্টিমেয় পুঁজিপতির মুনাফার স্বার্থ দিয়ে এই বৈচিত্রকে কারারুদ্ধ করে রাখা যাবে না; ভারতে গণতন্ত্র চলবে সংবিধান মেনে আইনের শাসনে, তাকে আইন-বহির্ভূত হিংসা ও শাসক দলের ষড়যন্ত্রমূলক নিয়ন্ত্রণে নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্রে পর্যবসিত করা চলবে না। ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক দিশাই এই কথাগুলো স্পষ্ট ভাবে বলতে পারে।
সাধারণ সম্পাদক, সিপিআই (এমএল) লিবারেশন
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy