কেবল অসহিষ্ণুতা নয়। অসহনীয় স্পর্ধা। অমর্ত্য সেনকে লইয়া নির্মিত তথ্যচিত্রে সেন্সর বোর্ডের নিষেধাজ্ঞা বিষয়ে এই একটি কথাই বলিবার আছে। এ বার গণতন্ত্রের ভানটুকু পর্যন্ত ফেলিয়া দিয়া নিরাবরণ স্বৈরাচারের পর্ব। স্বাধীনতার সত্তর বৎসর পূর্ণ হইবার প্রাক্কালে ভারতীয় সংবিধানের মূল আদর্শ সর্বার্থে জলাঞ্জলি দিবার প্রস্তুতি সম্পূর্ণ। গরু নামক প্রাণীটিকে লইয়া কেন্দ্রীয় সরকার কতটা মাতোয়ারা, গরু সম্পর্কিত আইনবিধি তৈয়ারির কাজটি কী ভাবে তাহাদের রাষ্ট্রচালনার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য-বিধেয়তে পরিণত, সে তো আসমুদ্রহিমাচল দেশ দেখিতেই পাইতেছে। কিন্তু সরকারি মতের বাহিরে গরু বিষয়ক আর কোনও ভাবনাচিন্তা থাকিলেই তাহাকে নিষিদ্ধ করাকে স্পর্ধার চূড়ান্ত বলিতে হইবে। হিন্দুত্ব বিষয়ে বিজেপি কী ভাবে, তাহা জলের মতো পরিষ্কার। কিন্তু অন্য কোনও নাগরিক সেই সরকারি ধারণার বাহিরে আর কোনও ধারণা পোষণ করিতে পারিবেন না, এই কর্তৃত্ববাদ অক্ষমণীয়। ঘটনা হইল, গরু কিংবা সরকারি নিষেধাজ্ঞা, দুই বিষয়েই এই সম্পাদকীয় স্তম্ভের অবস্থান ইতিমধ্যে স্পষ্ট। গরু লইয়া হিন্দুত্ববাদী অবস্থান থাকিতেই পারে, কিন্তু তাহা সাংবিধানিক মান্যতা পাইতে পারে না। আবার, শিল্পসাহিত্যের উপর নিষেধাজ্ঞাও উদার গণতন্ত্রের সম্পূর্ণ বিরোধী, অত্যন্ত ব্যতিক্রমী ক্ষেত্র ভিন্ন কোনও নিষেধাজ্ঞা একেবারেই সমর্থনীয় নহে। কিন্তু বিষয়টি এখন আর কেবল গরু কিংবা নিষেধাজ্ঞার মধ্যে সীমাবদ্ধ নাই। বিষয়টি এ সবের অনেক উপরে উঠিয়া গিয়াছে— মৌলিক গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার প্রশ্নকে সামনে টানিয়া আনিয়াছে।
অমর্ত্য সেন যে সে ব্যক্তি নহেন। তিনি কত বড় ‘মনীষী’, সেই সূক্ষ্ম বিচার অন্যত্র। কিন্তু একটি কথা স্পষ্ট। তাঁহার ভাবনাক্ষেত্র ও কর্মপরিচয়ের সুবাদেই দেশবাসী তাঁহার মত গুরুত্বসহকারে শুনিবেন। তাঁহার কথায় ইচ্ছা মতো কাঁচি চালাইবার অধিকার সরকারি আধিকারিকদের থাকিতে পারে না, কারণ, অমর্ত্য সেনের আজীবন চর্চা-লব্ধ জ্ঞান ও চিন্তার পাশে এই আধিকারিকদের সংকীর্ণ জ্ঞানজগৎ বা স্বার্থকেন্দ্রিক রাজনীতির হিসাবনিকাশ দাঁড়াইতে পারে না। তাঁহাদের কাজ, দিনগত প্রশাসন চালানো। সৎ ভাবে সেই কাজ করিতে গেলে পণ্ডিত বা বিশেষজ্ঞদের মতামত তাঁহাদের কান খুলিয়া শোনা দরকার। তাঁহাদের মুখ বন্ধ করিবার কুৎসিততম পদক্ষেপের অর্থ, কাজটি অসৎ উদ্দেশ্যে করা হইতেছে। ভাবিয়া শিহরন হয়, অমর্ত্য সেনের ক্ষেত্রে যদি সরকারি কাঁচি এই পরিমাণ সক্রিয় হয়, তবে অখ্যাত কিন্তু মৌলিক অধিকারে অন্বিত সাধারণ মানুষের অবস্থা কী হইতে পারে? নাগরিকের গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা, ব্যক্তি-মতামত, মত প্রকাশের অধিকার যদি এই ভাবে হরণ করা হয়, তবে এই সরকারের মতিগতি ও আচরণ বিষয়ে একটি শব্দই প্রযোজ্য— অসাংবিধানিক।
অগণতন্ত্রের আদ্যন্ত পিপাসু এই সরকার নিশ্চয়ই ভাবিতেছে, স্বাধীন কণ্ঠগুলি এই ভাবে জোর করিয়া রোধ করিলেই বিপরীত মতের পরিসরটি কমিতে কমিতে শূন্যে পরিণত হইবে। ভাবনাটি সর্বৈব ভিত্তিহীন নহে। ভয় অতি প্রবল আবেগ। বাধাপ্রাপ্ত হইবার ভয় মানুষের স্বাভাবিক মতপ্রকাশকে রুদ্ধ করিতেই পারে। সব চিত্রপরিচালক সুমন ঘোষের মতো সাহসী হইয়া নিষেধাজ্ঞা না মানিবার অঙ্গীকার না-ই করিতে পারেন। তবে, ভরসা হয়, ভারতের মতো বহুধাবিচিত্র দেশে গরু বা হিন্দুত্ব লইয়া বাড়াবাড়ি যদি-বা চলেও, এমন ন্যক্কারজনক কর্তৃত্ববাদ চলিবে না। মোদী-বাহিনী বাড়াবাড়ি করিলে তাঁহাদের মূঢ় জয়স্তম্ভও এক দিন নিজের অর্থ ভুলিবে। অবশ্যই ইহা আশাবাক্য। কিন্তু এই দেশের ঐতিহ্য-অনুসারী ও ইতিহাসসম্মত আশাবাক্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy