কালান্তর: শরৎচন্দ্র বসুর বিদেশ উড়ান, ১৯৪৬ (ছবি: শিশিরকুমার বসু); নরেন্দ্র মোদীর বিকাশ উড়ান, ২০১৭ (ছবি:এএফপি)
গুজরাত নির্বাচন প্রচারের শেষ দিনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সি-প্লেন চড়ে মন্দির দর্শনে গিয়ে বেজায় চমক দিয়েছেন বলে শোরগোল পড়ে গেল। এমনিতেই এই নির্বাচনী প্রচারে নরেন্দ্র মোদী এবং রাহুল গাঁধী কে কতগুলি প্রচার সভা করেছেন, কার সভাতে কত ভিড় হয়েছে, কে ক’টি মন্দির পরিদর্শন করেছেন— তাই নিয়ে সারা দেশে চর্চা চলছিল। হেন কালে নির্বাচনের শেষ প্রহরে প্রধানমন্ত্রী সি-প্লেনে চড়ে অম্বাদেবী দর্শনে গিয়ে তাক লাগিয়ে দিলেন। ভাব দেখে মনে হল যেন সি-প্লেন বস্তুটি আজব এবং কোনও জননায়ক কোনও দিন এমন বিমানে আরোহণ করেননি।
এই ঘটনার বিবরণ পড়ে অনেক কাল আগে কলকাতার হুগলি নদী থেকে সি-প্লেনে অপর এক জননায়কের যাত্রার কাহিনি মনে পড়ল। সময়কাল ১৯৪৬ সাল, জুলাই মাস। দক্ষিণেশ্বরের কাছে নদীবক্ষ থেকে সেই প্লেনে রেঙ্গুন যাত্রা করেছিলেন শরৎচন্দ্র বসু। সঙ্গী ছিলেন পুত্র শিশিরকুমার বসু এবং পারিবারিক বন্ধু মানুভাই ভিমানি। ইয়াঙ্গনে পৌঁছনোর পর নদীর তীরে তাঁদের অভ্যর্থনা জানান ইয়াঙ্গনবাসী আইএনএ-র কর্মীবৃন্দ। এর পর বর্মার (এখন মায়ানমার) তদানীন্তন নেতা আউঙ্ সান্-এর সঙ্গে শরৎচন্দ্র বসুর বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে বর্মার সংখ্যালঘু বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সমস্যা নিয়ে দুই নেতার মধ্যে বিশেষ আলোচনা হয়। আজকের রোহিঙ্গা সমস্যা মনে করিয়ে দিচ্ছে সে দিনকার আলোচনার বিষয় আজও জীবন্ত। সে দিনের দুই নেতার রুদ্ধদ্বার বৈঠকের পরে ইয়াঙ্গনের টাউন হলে আউঙ্ সান্ শরৎচন্দ্র বসুকে জনসংবর্ধনা জ্ঞাপন করেন। তাঁকে গার্ড অব অনার দিয়ে বরণ করে নেওয়া হয়।
আউঙ্ সান্ তখন বর্মার অ্যান্টি-ফ্যাসিস্ট পিপলস ফ্রিডম লিগ-এর নেতা। টাউন হলের সভায় তিনি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, বর্মার ন্যাশনাল আর্মি এবং আইএনএ-র সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। আউঙ্ সান্-এর সঙ্গে শরৎচন্দ্র বসুর এই সাক্ষাৎকার খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। দুর্ভাগ্যবশত ঠিক এক বছর পরে জুলাই, ১৯৪৭ সালে আউঙ্ সান্ নিহত হন, বয়স মাত্র ৩২ বছর।
প্রধানমন্ত্রীর সি-প্লেন যাত্রার চমক নিয়ে কথা বলছিলাম। নির্বাচনী প্রচারে চমক অবশ্যই থাকতে পারে। কোনও এক সময় দক্ষিণের রাজ্যগুলির বিরাট কাটআউট চমকপ্রদ মনে হত। তার পর বিপুল গর্জনে ধুলো উড়িয়ে হেলিকপ্টার থেকে নেমে নেতারা প্রচার শুরু করলেন। আপামর জনতা পুলকিত। এখন আমরা দেখলাম, প্রধানমন্ত্রীর ‘বিকাশ উড়ান’। নির্বাচনী প্রচারে চমকের প্রতিযোগিতা থাকতেই পারে।
তবে কোথাও একটা লক্ষ্মণরেখা প্রয়োজন। অপর যে চমকটি প্রধানমন্ত্রী দিলেন, তাতে আমাদের বিদেশনীতি, অপর রাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক নির্বাচনী প্রচারের অঙ্গ হয়ে পড়ল। এই ঘটনা নিঃসন্দেহে অসংগত। এক সময় পার্লামেন্টে বিদেশমন্ত্রক কমিটিতে যুক্ত ছিলাম। সর্বদলীয় এই কমিটিতে দেশ-বিদেশের ডেলিগেটরা, এমনকী বিদেশমন্ত্রীরাও আসতেন। তাঁদের সঙ্গে আলোচনায় বিভিন্ন দলের সদস্যরা কিন্তু একসুরে কথা বলতেন। বিদেশনীতির মূলকথা নিজের দেশের স্বার্থরক্ষা, সরকার বদল হলেও বিদেশনীতি পালটায় না। রাজনীতি ভিন্ন হলেও একসুরে কথা বলতে বাধা হত না। দেশের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী সর্বজনশ্রদ্ধেয়, সবিনয়ে জানাই ‘বিকাশ উড়ান’ ভালই লেগেছে। অপরটি কিন্তু নয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy