গত সাত দশক ধরিয়া দিল্লির কাশ্মীর-ব্যথার ওষুধ কেহই বাতলাইতে পারেন নাই। তৎসত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী হওয়া ইস্তক নরেন্দ্র মোদীর ভাবটা ছিল পরশুরামের ‘চিকিৎসা-সঙ্কট’-এর ‘পাড়ার বিচক্ষণ ডাক্তার’-এর মতো, সহজেই সব মীমাংসা করিয়া দিবেন। চার বৎসর শাসনের পর কেমন মীমাংসায় তিনি ও তাঁহার সরকার পৌঁছাইতে পারিয়াছেন, তাহার সাক্ষাৎ প্রমাণ কাশ্মীরি যুবসম্প্রদায়। প্রতি মাসে উপত্যকার জঙ্গিবাহিনীতে নূতন যোগদানকারী যুবকদের সংখ্যা আগের মাসের হিসাবকে ছাড়াইয়া যাইতেছে। গত সপ্তাহে জাতীয় নিরাপত্তাবাহিনীর শেষ বৈঠকটিতেও এ বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ পাইল। কেন্দ্রীয় সরকারের ভারপ্রাপ্ত আধিকারিকরাই বলিলেন, সাম্প্রতিক কালে উপত্যকায় যুবসম্প্রদায়ের দিল্লি-বিরোধিতার পরিমাণ এতটাই সীমা-অতিক্রমী, তাহারা এমন দলে দলে সন্ত্রাস-কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত হইতেছে যে দিল্লির নূতন নীতি ভাবিয়া দেখা উচিত। ‘নূতন নীতি’র অর্থ, দমনমূলক নীতির বদলে অন্য উপায় অবলম্বন। জম্মু ও কাশ্মীরের জন্য নিয়োজিত কেন্দ্রীয় সরকারের ‘মধ্যস্থ’ দীনেশ্বর শর্মাও মন্তব্য করিলেন, উপত্যকায় ‘শক্তি’ ব্যবহার কমানো দরকার। তবে কি মোদী সরকার ভুল বুঝিতেছে? মনে পড়িবে, ২০১৬ সাল হইতে সেনাবাহিনীর লাগাতার হিংসাত্মক চেহারা দেখা গেলে প্রধানমন্ত্রীর মুখে বারংবার তাহার সমর্থন শোনা গিয়াছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ হিংসার বদলে কথোপকথনের উপর জোর দেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই স্বয়ং মোদী বলিয়াছেন কথোপকথন কোনও রাস্তা হইতেই পারে না। বিরোধী আসন হইতে চিদম্বরম যখন বলেন, কথোপকথন সম্ভব করিতে প্রয়োজনে ভারতের সাংবিধানিক কাঠামোর ভিতরে কাশ্মীরের স্বশাসনের দাবিটিও মানিয়া লওয়া যায়, মোদী তখন চিদম্বরমকে ‘পাকিস্তানের ভাষায়’ কথা বলিবার জন্য বিদ্রুপ করিয়াছিলেন।
মনে পড়িতে পারে, যে দীনেশ্বর শর্মার কণ্ঠে এখন শান্তির ললিত আহ্বান ধ্বনিত হইতেছে, কয়েক মাস আগে তিনি নিজ দায়িত্বে সন্ত্রাসবাদী আর বিক্ষুব্ধ সাধারণ নাগরিকের মধ্যে সীমারেখাটি গুলাইয়া দিয়াছিলেন। সেনাবাহিনীকে শিখাইবার চেষ্টা করিয়াছিলেন, হাতে বন্দুক থাকিলে যে-কেহই সন্ত্রাসের কারবারি, সুতরাং সকলের প্রতি এক দমননীতির ব্যবহার চলিতে পারে। আন্তর্জাতিক রীতি ও নীতি কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা বলে। সিভিলিয়ান বা নাগরিক বিক্ষোভ এবং জঙ্গি সন্ত্রাসের মধ্যে পার্থক্য করা যে কোনও উপদ্রুত অঞ্চল শাসনের প্রধান কাজ। সারা পৃথিবীতেই বিক্ষোভ প্রশমনের জন্য এই পদ্ধতি মান্য, এমনকী ভারতের অন্যত্রও, যেমন নাগাল্যান্ড, মিজোরাম কিংবা অসমে। কাশ্মীরেও উনিশশো নব্বইয়ের দশকের দিল্লির প্রধানমন্ত্রীদের ঘোষিত নীতি ছিল, জঙ্গিদের আলোচনার টেবিলে আনিবার জন্যই পাল্টা বন্দুক দরকার। মোদী ও মোদী-নিযুক্ত মধ্যস্থ শ্রীশর্মা নিশ্চিত ভাবে এই ঐতিহ্য পাল্টাইয়া দিয়াছেন।
মোদীর এই লাগাতার পাল্টা সন্ত্রাসের নীতি এখন গোটা বিশ্বের আলোচ্য বিষয়। এবং এই নীতিতে যে তেমন কোনও ফল ফলিতেছে না, তাহাও সেই বিশ্বময় আলোচনার অন্তর্ভুক্ত। এই অধিক-ঝুঁকির খেলায় নামিয়া সুফলের বদলে কুফল অর্জন করিয়া মোদী কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ কতখানি প্রভাবিত করিতে পারিলেন তাহা আলাদা বিষয়, তবে তাঁহার নিজের কূটনৈতিক ও শাসননৈতিক বোধের স্বল্পতাটি ভালমতোই প্রমাণিত হইল। কোনও না কোনও দিন রাজধানী দিল্লিকে মানিতেই হইবে যে বন্দুকের নল দেখাইয়া ভালবাসা উদ্রেক করা যায় না, দুর্দমনীয় সেনাবাহিনীকে দিয়া কাশ্মীর উপত্যকায় ভারতপ্রীতির সঞ্চার ঘটানো যায় না। তবে নরেন্দ্র মোদীই সে দিন রাজধানীর তখ্তে থাকিবেন কি না, তাহা বলা কঠিন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy