রাজ্যসভা নির্বাচন সম্পন্ন হল। বাংলায় পাঁচটি আসনের জন্য নির্বাচন হল। চারটিই গেল তৃণমূলের ভাগে। একটিতে জয়ী হলেন তৃণমূল সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী। বামফ্রন্ট জয়ের ধারেকাছেও রইল না।
এই ফল দেখে কেউই আশ্চর্য বা বিস্মিত হননি। প্রত্যাশিত যা ছিল, তা-ই হয়েছে, বলছেন প্রত্যেকে। কিন্তু মাত্র সাত-আট বছর আগেও কি এই ছবিটা কল্পনা করা যেত বাংলায়? পাঁচটি আসনে নির্বাচন হলে চারটি তো বটেই, পারলে পাঁচটিই কব্জা করে নিতেন বামেরা। সেই বামেরা আজ একটি আসনে প্রার্থী দিয়েও জিততে পারেন না এ বঙ্গে। কালচক্রের সামান্য ঘূর্ণনেই যে কী সাংঘাতিক ভাবে বদলে যেতে পারে পরিস্থিতি, তা আজকের বঙ্গীয় বামেদের দেখলে সম্যক উপলব্ধি হয়।
সান্ত্বনা অবশ্য রয়েছে বামেদের। বিধানসভা নির্বাচনে ৩২টি আসনে জয়ী হয়েছিলেন বামফ্রন্টের প্রার্থীরা। ২ বিধায়ক পরে দলবদল করেন। বাম শিবিরে রয়েছেন এখনও ৩০ জন। বাম প্রার্থী রবীন দেব সেই ৩০ জনের ভোটই পেয়েছেন, রাজ্য জুড়ে দলবদলের তুমুল আবহেও বামফ্রন্ট তার বিধায়ক দল মোটের উপর অটুট রাখতে পেরেছে, বাম প্রার্থী জিততে পারবেন না বুঝেও ক্রস ভোটিং-এর পথে হাঁটেননি কেউ। ব্যক্তিগত স্বার্থের চিন্তায় মগ্ন হয়ে নতুন করে আর দল ছাড়েননি কেউ।
সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
ক্রস ভোটিং-এ বাংলার বিধায়করা পারদর্শী নন বা এ রাজ্যে ক্রস ভোটিং হয় না, এমন কিন্তু নয়। রাজ্য বাম শাসনে থাকাকালীন কংগ্রেস বিধায়করা কী ভাবে দলের নির্দেশ অগ্রাহ্য করে তৃণমূল শিবিরের প্রার্থী জয়ন্ত ভট্টাচার্যকে ভোট দিয়েছিলেন এবং রাজ্যসভায় পাঠিয়েছিলেন, তা অনেকের স্মৃতিতেই উজ্জ্বল। রাজ্যে তৃণমূল যুগ শুরুর পর এবং তৃণমূলে মুকুল রায় যুগ চলাকালীন কী ভাবে কংগ্রেস বিধায়কদের দিয়ে ক্রস ভোটিং করিয়ে আহমেদ হাসান ইমরানকে রাজ্যসভায় পাঠানোর পথ সুগম করা হয়েছিল, তা আরও বেশি করে মনে থাকার কথা। অর্থাৎ এ রাজ্যে বিরোধী আসনে থাকা দলের বিধায়কেরা যে রাজ্যসভা ভোটের সময়ে দলের নির্দেশ অগ্রাহ্য করতে পটু, তা একাধিক বার প্রমাণিত হয়েছে। বাম বিধায়করা দেখালেন, তাঁরা সে গোত্রে এখনও সামিল হননি।
আরও পড়ুন
পিসি-ভাইপোকে হারাল বিজেপি, উত্তরপ্রদেশে
বাংলায় ক্রস ভোটিং হোক বা না হোক, অন্যত্র হয়েছে এবং তা নিয়ে গোটা দেশের রাজনীতি সরগরম হয়ে উঠেছে। কর্নাটকে ক্রস ভোটিং সংক্রান্ত বিতর্ক নিয়ে ধুন্ধুমার হয়েছে, নির্বাচন বাতিল করে দেওয়ার দাবি উঠেছে। আর উত্তরপ্রদেশে ক্রস ভোটিং-এ ভর করে বসপা-সপা জোটকে যোগী আদিত্যনাথ জোর ধাক্কা দিয়ে দিয়েছেন।
তাৎপর্যপূর্ণ হল, যাঁরা ক্রস ভোটিং করেছেন, তাঁরা বেশ সদর্পেই নিজেদের ‘কীর্তি’র কথা বলছেন, একটুও লজ্জিত বা সঙ্কুচিত বোধ করছেন না, বেশ গরিমাই অনুভব করছেন বরং। আর যে সব দল ক্রস ভোটিং-এর সুবিধা পেয়ে জিতেছে, তারাও বিষয়টিকে অসামান্য সাফল্য হিসেবেই দেখছেন, কোনও অনৈতিকতার বোধ কোথাও কাঁটার মতো খচখচ করছে বলে মনে হচ্ছে না।
আরও এক বার তাই মনে করিয়ে দেওয়া দরকার, ক্রস ভোটিং কিন্তু কোনও গরিমার বিষয় নয়, ক্রস ভোটিং লজ্জার, অনৈতিকতার, বিশ্বাসঘাতকতার। এ কথা ঠিক যে, ক্রস ভোটিং-এর দৃশ্য বেশ পরিচিত এ দেশে। এই প্রথম বার ক্রস ভোটিং হল, তেমনও নয়। ক্রস ভোটিং-এর দোষে প্রায় সব দলই দুষ্ট, বামেরা একটু ব্যতিক্রমী শুধুমাত্র। কিন্তু তাতে নেতিবাচক বিষয়টা ইতিবাচক হয়ে ওঠে না একেবারেই।
যে দলের প্রতীকে জয়ী হচ্ছেন এক জন জনপ্রতিনিধি, যে দলের গণভিত্তির উপরে দাঁড়িয়ে আইনসভায় পৌঁছচ্ছেন, ক্রস ভোটিং সেই দলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা তো বটেই। ক্রস ভোটিং আসলে সাধারণ ভোটদাতাদের সঙ্গেও বিশ্বাসঘাতকতা।
দলবদলের স্বাধীনতা সকলেরই রয়েছে। কিন্তু এই দলের সঙ্গে থাকার সুবাদে যা পাওয়া গিয়েছে, সে সব পরিত্যাগ করে তবেই ওই দলের দিকে পা বাড়ানো উচিত। না হলে শুধু দলকেই নয়, সাধারণ নাগরিককেও ধোঁকা দেওয়া হয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy