সতেরোটি দেশ জুড়িয়া এক লক্ষ ত্রিশ সহস্র মানুষকে লইয়া সমীক্ষা করিয়া, গবেষকরা জানাইলেন, গৃহস্থালির কাজকর্ম করিলেও জিম-এ যাইবার সমান শারীরিক সুফল পাওয়া যায়। গরিব-ধনী নির্বিশেষে এই সিদ্ধান্ত নাকি সত্য। কাজটি করা হইতেছে নিতান্ত প্রয়োজনের তাগিদে, মন খারাপ করিয়া, না কি দিব্য আনন্দ উপভোগ করিতে করিতে, তাহার উপরেও সুফল নির্ভর করিবে না। অর্থাৎ, ধনী মানুষ দুশ্চিন্তাহীন ভাবে শিস দিতে দিতে প্রাতঃকালে হাঁটিলেও যে ফল পাইবেন, দরিদ্র পরিচারিকা নিতান্ত পেটের দায়ে গজগজ করিতে করিতে প্রভুর ঘর ঝাড়িলে-মুছিলেও সেই ফলই পাইবেন। গবেষণা করা হইয়াছে পঁয়ত্রিশ হইতে সত্তর বৎসরের মানুষদের লইয়া, গরিব ও ধনী উভয় প্রকারের রাষ্ট্রের মানুষ লইয়া, গ্রাম ও শহরের মানুষ লইয়া। এবং চটজলদি এই সিদ্ধান্তে আসা হয় নাই, মানুষগুলিকে সাত বৎসর ধরিয়া অনুসরণ করা হইয়াছে। অতএব, কেহ মশারি তুলিতেছেন, শয্যা পরিপাটি করিতেছেন বা কলঘর পরিষ্কার করিতেছেন, ইহার প্রকৃত তাৎপর্য হইল, তিনি জিম-এ গিয়া অনবদ্য কসরত করিতেছেন, এই শারীরিক ব্যায়াম তাঁহাকে সম্ভাব্য হৃদরোগ হইতে দূরে রাখিতেছে এবং আয়ু বাড়াইয়া দিতেছে। যে মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত গৃহকর্তা বা গৃহিণী উত্তরোত্তর গৃহ-সহায়কের উপর নির্ভরশীল হইয়া উঠিতেছেন, তাঁহাকে এই তথ্যে দীক্ষিত করিতে পারিলে আর চিন্তা নাই, এই দগ্ধললাট তৃতীয় বিশ্বেও স্বনির্ভরতার সংস্কৃতি বিকশিত হইবে। যদি গৃহের কাজগুলি করিয়া লইবার সময় ক্রমাগত মনে হইতে থাকে ইহাতে জিমের খরচও বাঁচিল, গৃহসহায়িকার বেতনও বাঁচিল, ডাক্তারের খরচও বাঁচিল, তবে কাজগুলি আর বিরক্তিকর থাকিবে না, ঝকঝকে শরীর ও চকচকে উৎসাহ মিলিয়াজুলিয়া প্রসন্নতার দোকান খুলিয়া বসিবে। নিজের কাজ নিজে করিয়া লইবার যে আত্মমর্যাদা, স্বাবলম্বনের সেই দীপ্তি ও আত্মবিশ্বাস অন্যান্য কর্মেও প্রতিফলিত হইবে। রাগিয়া উঠিতে ইচ্ছা করিতেছে, কিন্তু দায়ে পড়িয়া ক্রোধ গিলিয়া লইতে হইতেছে, কারণ যাঁহার উপর রাগ, সেই ফাঁকিবাজ ব্যক্তিটি বিনা সংসারচক্র অচল— এই পরিচিত চিত্রনাট্যে বদল আসিলেই দেখা যাইবে, দৃপ্ত পরোয়াহীনতা আসিয়া ন্যুব্জ অলস উদ্যমবিমুখ জাতির ঝুলিয়া পড়া মুখ ও ভাগ্যকে যুগপৎ উত্থানের পানে লইয়া যাইতেছে।
নিন্দুকে বলিবে, ইহাতে স্বাস্থ্য ভাল হইবে বটে, মেজাজ মোটে ভাল হইবে না। ভারতে অবস্থিত মানুষদের যে ভ্রাতাভগ্নীগণ আমেরিকায় বা ইউরোপের কোনও দেশে থাকেন, তাঁহারা শতেক ডলার বা পাউন্ড কামাইলেও ঈষৎ ঈর্ষার চক্ষে ভারতীয়দের দেখেন, কারণ খাইবার পর ভারতীয়রা থালা পরিষ্কার না করিয়াই টিভির সম্মুখে এলাইয়া পড়িতে পারেন, পরের দিন মালতীর মা আসিয়া সেই দায়িত্ব পালন করিবেন। অনাবাসী ধনী ব্যক্তিটি যেমন দুর্গাপূজায় ভারতে আসিয়া কিছু হম্বিতম্বি ও অহংকার দর্শাইয়া খুশি হন, তেমন তাঁহার মনে এই কণ্টক খচখচ করিতে থাকে যে ফিরিয়াই আবার সারা সপ্তাহ কাজ করিবার পর রবিবারেও সমগ্র বাড়ি ঝাড়পোঁছ করিতে হইবে, গাড়িটিকেও সাফ রাখিতে হইবে। শয্যায় অর্ধশায়িত হইয়া হাঁক পাড়িলেই কেহ সম্মুখে চায়ের পেয়ালা ধরিবে না, ডাইনিং স্পেসে আসিয়া সংবাদপত্র খুলিয়া বসিলে আপনাআপনি ভিতরঘরগুলি ঝকঝকে হইয়া যাইবে না। কেহ তাঁহাদের যদি আসিয়া বলিত, আয়ুর কয়েক বৎসর লইয়া লইব, পরিবর্তে আজীবন গৃহস্থালির কাজগুলি অন্য লোকে করিয়া দিবে, অনেকেই হয়তো এই আদানপ্রদানে সানন্দে সম্মত হইতেন। মানুষের সভ্যতার সাধনাই তো অলসতর হওয়া। গণিত আমি কষিব না, কম্পিউটার কষিয়া দিবে। আমি হাঁটিব না, মোটরগাড়ি চাকা ঘুরাইয়া এই স্থান হইতে ওই স্থানে লইয়া যাইবে। গিয়া সংবাদ পুছিব না, ফোন করিয়া এইখানে বসিয়াই কুশল জানিব। গড় মানুষ রোজগার করিতেছেন শারীরিক নড়নচড়ন যথাসম্ভব কমাইবার জন্যই। প্রত্যহ ফ্যান্টাসি যাপিতেছেন, কবে ল্যাপটপ-টি কণ্ঠস্বর দ্বারাই নিয়ন্ত্রণ করা যাইবে, কবে আর উঠিয়া রেগুলেটর নাড়িয়া পাখা কমাইতে হইবে না, তাহারও রিমোট হস্তগত হইবে। আলস্যের স্বর্গের প্রতি লোভাতুর দৃষ্টি হানিতে থাকা সেই মানুষকে সমীক্ষালব্ধ শ্রম-উপদেশ দিলে, ফল হইবার আশা কম। প্রায় প্রতিটি মানুষ নববর্ষের প্রতিজ্ঞায় দুই সপ্তাহের মধ্যে আলগা দিয়া থাকেন। কারণ মানুষ আরামের দাস। তাহার স্বস্তি ও মৌজমস্তিকে হানিবে যে সমীচীন বার্তা, তাহাকে সে জবরদস্তি বলিয়া ডাকে।
যৎকিঞ্চিৎ
ডোনাল্ড ট্রাম্প বক্তৃতা দিতে গিয়ে দু’বার বলে ফেললেন ‘নামবিয়া’ দেশের কথা। অমন কোনও দেশ পৃথিবীতে নেই, উনি ‘নামিবিয়া’ বলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু অত বড় মানুষটার সম্মানরক্ষার্থে কি উচিত নয়, ওই নামে একটি দেশ পত্তন করা? ও দিকে ট্রাম্পকে বিঁধতে গিয়ে উত্তর কোরিয়ার স্বৈরাচারী শাসক বললেন ‘ডোটার্ড’, যা অতি প্রাচীন ইংরেজির এক শব্দ, মানে: ভীমরতিওয়ালা বৃদ্ধ। প্রায় শেক্সপিয়রীয় এক শব্দকে চালু লব্জে পরিণত করার জন্য ভাষা-নোবেল দেওয়া যায় না?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy