বইমেলা আসিয়াছে এবং উহার সহিত আসিয়াছে এক অতিপরিচিত হুতাশ: মানুষ আর বই পড়িতেছে না। অথচ অগণ্য মানুষ বইমেলা যাইতেছে, ছবি তুলিয়া ফেসবুকে দিতেছে, অসংখ্য ‘লাইক’ পাইতেছে। সমগ্র বিশ্ব জুড়িয়া নানা সমীক্ষায় দেখা যাইতেছে যে বই বর্তমানে অধিক মুদ্রিত হইতেছে। এই বাংলায় সাংস্কৃতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা সম্ভবত আর্থিক উচ্চাকাঙ্ক্ষারও অধিক, ফেসবুক খুলিলেই দেখা যাইবে অগণ্য মানুষের নূতন বই, কখনও বা একাধিক, এই বইমেলায় প্রকাশিত হইতেছে এবং অমুক নম্বর স্টলে যাইলেই পাওয়া যাইবে। বইমেলার বার্ষিক উৎসবটিকে কেন্দ্র করিয়া যে ভাবে পুস্তকপ্রেম উদ্যাপিত হইতেছে, তাহাতে মনে হয় বই লইয়া হাহাকারটি বাঙালির দৈনন্দিন ও শৌখিন অন্যান্য বিষাদবিলাসেরই ভগিনীপ্রতিম। যখন টেলিভিশন আবিষ্কৃত হইয়াছিল, অনেকেই হলফ করিয়া বলিয়াছিল সংবাদপত্রের দিন শেষ হইল, যে খবর মানুষ সেই মুহূর্তে চক্ষে দেখিতে পাইতেছে, সেই খবর পরের দিবসে বিশদে পড়িয়া সে কী করিবে। কিন্তু তাহা হয় নাই, ভিন্ন আবেদন লইয়া সংবাদপত্র টিকিয়া গিয়াছে। আজ দৃশ্য-শ্রাব্য মাধ্যম আসিয়া গ্রন্থকে আক্রমণ করিয়াছে, মানুষে ওয়েব-সিরিজ় দেখিতেছে তাই বই পড়িবার সময় ধৈর্য অভ্যাস সকলই গিয়াছে বলিয়া যত অভিযোগ ধাবিত হউক, মানুষ হইহই করিয়া বই পড়িতেছে কিনিতেছে লিখিতেছে। অনেকে বলে, যে বইগুলি প্রচুর বিকাইতেছে সেইগুলির মান উচ্চ নহে, লোকে কাফকা না পড়িয়া বাঁটুল দি গ্রেট চাখিতেছে। কিন্তু তাহাদের শৈশব কৈশোর যৌবনকালে লোকে দস্তয়েভস্কি ও কমলকুমারেই নিমজ্জিত থাকিত, মোটে হেমেন্দ্রকুমার রায় ও বিমল মিত্র পড়িত না— ব্যাপার এমন নহে। অধিকাংশ মানুষ পত্রপত্রিকা ও থ্রিলার পড়িতে ভালবাসিবে, সামান্য সংখ্যক লোকেই মহৎ ও জটিল শিল্প লইয়া মাথা ঘামাইবে, ইহা যুগে যুগে সত্য। তাই বই পড়িবার অভ্যাস ও ভাল বই পড়িবার অভ্যাস সমার্থক নহে।
অনেকেই এখন বই পড়িতেছে ট্যাব-এ, বা কম্পিউটারের পর্দায়, বা কিন্ডল জাতীয় যন্ত্রে। অনেকে মোবাইলেই পড়িতেছে। কেবল মোবাইলে পড়িবার জন্য লেখার জোগান দিবার সংস্থাও তৈয়ারি হইয়াছে। সেইগুলিও তো পাঠ। ফেসবুকে কেহ যদি দিবারাত্র অন্যের পোস্ট পড়িতে থাকে, তাহাও তো পাঠ। কেবলমাত্র পৃষ্ঠায় মুদ্রিত অক্ষর পড়িলে তাহা কুলীন অভ্যাস, আর পর্দায় সেই অক্ষর স্ফুট থাকিলে তাহা নিম্নমানের অধ্যয়ন, এই মতের কোনও ভিত্তিই নাই। নিঃসন্দেহে মানুষে এখন টেলিভিশন ও আন্তর্জালে অসংখ্য অনুষ্ঠান দেখিতেছে, কিন্তু তাহা দেখিয়া অনেকে বই কিনিতেও ছুটিতেছে। একটি উপন্যাসের চিত্ররূপ দিবার পর সেই উপন্যাসের বিক্রয় বাড়িয়া গিয়াছে, এমন ঘটনা বিরল নহে। চিত্র মানুষকে স্পষ্ট ভাবে ঘটনাটি দেখাইয়া দিতে পারে, তাহার আবেদন প্রবল। বইয়ের যাহা দুর্বলতা— সে অক্ষরের মাধ্যমে ধারণাটিকে উপস্থাপিত করে, তাহার পর পাঠককে স্বয়ং ছবিটি নিজ হৃদয়ে রচনা করিয়া লইতে হয়— উহাই তাহার শক্তি। মানুষ যেমন অন্যের নির্মিত ছবি দেখিয়া আরাম পাইতে ভালবাসে, তেমনই নিজের নির্মিত ছবির নেশাও তাহাকে আলোড়িত করে।
আর যদি সত্যই এমন দিন আসে, যখন নূতন নূতন মাধ্যম আসিয়া বইকে একেবারে বিলুপ্ত করিয়া দিবে, অসুবিধা কোথায়? পূর্বে কথকতা হইত, মানুষ অধীর আগ্রহে কথক ঠাকুরকে ঘিরিয়া গল্প শুনিবার জন্য বসিত। তাহার পর বই আসিল, কথক ঠাকুরের চাকুরি যাইল। নিশ্চয় অনেক কথনপ্রতিভা মাথা খুঁড়িয়া মরিয়াছে। তাহাতে মানুষের সংস্কৃতির জয়যাত্রা থামিয়া থাকে নাই। পুতুলনাচের কথা আর কেহ বলে না, নিশ্চয় অনেক মানুষ আছে যাহারা পুতুলনৃত্যের সাহায্যে অসামান্য শিল্প সৃষ্টি করিতে পারিত কিন্তু চলচ্চিত্রের দাপটে তাহা করিতে পারিল না। কিন্তু এই ভাবিয়া গালে হাত দিয়া কাঁদিতে বসিলে, পৃথিবীর নূতনতর শিল্পমাধ্যগুলিকে আহ্বান জানানো হইবে না, ইতিহাস তাহার পূর্ণ বৈচিত্রে বিকশিত হইবে না। যেমন নিজ দৌড়ের ব্যাটনখানি পরবর্তী প্রজন্মের হস্তে তুলিয়া, দৌড় হইতে সরিয়া দাঁড়াইতে হয়, তেমন ভাবেই গ্রন্থকে যদি সত্যই এক দিন নূতন মাধ্যমের নিকট পরাজয় স্বীকার করিতে হয়, তাহা সকল গ্রন্থপ্রেমীকে মানিয়া লইতে হইবে। এবং অভিসম্পাত নহে, আশীর্বাদ ও মঙ্গলাকাঙ্ক্ষা দ্বারা নূতন মাধ্যমকে বরণ করিয়া লইতে হইবে। সুগ্রন্থ সেই সৌশীল্য নির্ঘাত শিখাইয়াছে।
যৎকিঞ্চিৎ
আগে লোকে পরকীয়া করলে ইলোপ করত, এখন বেমালুম স্বামী বা স্ত্রীকে খুন করে দিচ্ছে। কেউ আবার প্রাক্তন প্রেমিকাকে খুন করার আগে মাস তিনেক ভাল করে দুলে দুলে পড়াশোনা করে নিচ্ছে, কোন পিস্তলে দিয়ে মাথার ঠিক কোন জায়গাটায় গুলি করতে হবে। কেউ কুকুরছানার উপদ্রব পছন্দ না হলে দলে দলে পিটিয়ে থেঁতলে মারছে। চমৎকার এই অভ্যাসে পৃথিবীর জনসংখ্যা কমছে, নিত্য সংবাদে রোমাঞ্চ বাড়ছে, সর্বোপরি পঞ্চ ‘ম-কার’এ যোগ হচ্ছে ‘মার্ডার’!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy