শাসনের লাঠিটি কাজে না লাগাইলে ছেলেপিলে উচ্ছন্নে যায়। প্রবচন এমনই শিখাইয়াছে, পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষামন্ত্রী উত্তমরূপে তাহা শিখিয়াছেনও। মুশকিল একটিই, রাজ্যব্যাপী কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককুলকে মন্ত্রিবর ‘ছেলেপিলে’ ভাবিয়া লইয়াছেন। মাঝেমধ্যেই শাসনলাঠি লইয়া তিনি তাড়িয়া আসেন, বকাঝকা করিয়া ভয় দেখাইয়া ‘ছেলেপিলে’কে ভব্যতা শিখান। কয়েক দিন আগে শোনা গিয়াছে তাঁহার আবার এক বুক-হিম-করা বকুনি: শিক্ষকরা কাজে ফাঁকি দিলে তাঁহাদের পত্রপাঠ দূরের জেলার কলেজে বদলি করিয়া দেওয়া হইবে। ইহা কেবল ফাঁকা আওয়াজ নয়, তেমন নরমসরম ‘অভিভাবক’ তিনি নহেন। নিকট অতীতে পার্থ চট্টোপাধ্যায় একাধিক বার মনে করাইয়া দিয়াছেন, সরকারের তরফে তিনিই যখন শিক্ষকদের মাহিনা প্রদানের দায়িত্বে অবতীর্ণ, শিক্ষকদের উপর ছড়িচালনা-র কাজটিও তাঁহারই করায়ত্ত, এমনকী কশাঘাতের অধিকারটিও। সরকারের অঙ্গুলিচালনায় রাতারাতি স্থানান্তরিত হইবার হুমকিটি যে কতখানি বাস্তবসম্মত, সে আর এই রাজ্যের শিক্ষককুলের অজানা নাই। অর্থাৎ মন্ত্রী নিজের কাজ বলিয়া যাহা জানিয়াছেন, তাহা পালন করিতে তিনি অত্যন্ত উদ্গ্রীব।
একটি মৌলিক প্রশ্ন উঠিতে পারে। ইহা কি সত্যই তাঁহার নিজের কাজ? অন্নদাতার দায়িত্ব অনস্বীকার্য, মানিয়া লওয়া গেল। কিন্তু এত বড় রাজ্যে এতগুলি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে কি তাঁহাকেই সেই দায়িত্ব পালন করিতে হইবে? প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেই তো নিজস্ব প্রশাসক আছেন, অন্তত থাকিবার কথা। সেই অধ্যক্ষদের কাজ তবে কী? নিজ নিজ কলেজে শিক্ষকরা নিয়মিত আসিতেছেন কি না, না আসিলে কেন আসিতেছেন না, কী ভাবে তাঁহাদের আসিতে উদ্বুদ্ধ অথবা বাধ্য করা যায়, তাহা যদি শিক্ষামন্ত্রী নিজেই দেখেন, তাহা হইলে আর অধ্যক্ষরা থাকেন কেন? ঘটনা হইল, শিক্ষামন্ত্রীর শাসন-পদ্ধতি লইয়া যত সংশয়ই থাকুক না কেন, তাঁহার শাসনের উদ্দেশ্যটির সংগতি লইয়া কোনও সংশয় নাই। সত্যই নামী কলেজে আসন ভর্তি হইতেছে না, তাহার একটি বড় কারণ শিক্ষকদের মনোভাব ও কাজকর্মের ধরনধারণ। সাধারণ কলেজগুলিতে আসন ভর্তি হইলেও ক্লাস যে হইতেছে না, প্রত্যহ প্রমাণ মেলে। ক্লাস ঠিক মতো হয় না বলিয়া ছাত্রছাত্রীরাও আসিতে চাহে না। সব মিলাইয়া নৈরাজ্যে ডুবিতেছে এ রাজ্যের শিক্ষাপরিবেশ। শিক্ষামন্ত্রীর উদ্বেগটি অতি স্বাভাবিক। কিন্তু তাঁহার পদ্ধতিটি নীতিমাফিক নয়।
নীতিমাফিক করিতে না পারার একটি বাস্তব বাধাও আছে। কলেজের এই প্রশাসনিক স্তরটির মান্যতা আজ আর কিছুমাত্র অবশিষ্ট নাই। রাজনীতির কারুকার্য অনুসারে তাঁহারা এই পদে বসিয়াছেন, যথেষ্ট কর্তাভজা জীবনযাপনের প্রয়াসে দিবারাত্রি মগ্ন আছেন, নিজেদের স্বাধীন বিবেচনা কিংবা বোধ বলিয়া কিছুই অবশিষ্ট নাই, কিংবা যদি বা থাকে, উপরের কর্তৃমহলে এবং নীচের শিক্ষকমহলে তাহার স্বীকৃতি বা মান্যতা নাই। তাঁহারা সরকারের অধীন, সরকারই তাঁহাদের কাজটি করিয়া দেয়, তাঁহাদের কাজ সবই সেই নিবেদনে সমর্পিত। প্রায় চার দশক ধরিয়া এই ‘অনিলায়িত’ প্রথা চলিবার পর আজ অকস্মাৎ তাঁহাদের ব্যক্তিত্বের উন্মেষ বা বিবেচনার প্রকাশ আশা করাই বাতুলতা। খোদ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হইতে দূর জেলার অনামী কলেজের অধ্যক্ষ, সবই সরকারের নিজহস্তনির্বাচিত। এই পঙ্গু পরিস্থিতির প্রাথমিক দায়িত্ব বাম পশ্চিমবঙ্গেরই, যদিও তৃণমূল পশ্চিমবঙ্গেরও কৃতিত্ব, প্রথাটিকে সমান উৎসাহ ও দক্ষতা সহকারে চালাইবার জন্য। ইঁহাদের সম্মিলিত সৌজন্যে আজ এই রাজ্যের শিক্ষককুল সরাসরি মন্ত্রীর অধীন কর্মচারীতে পরিণত। ছুটির পুরস্কার হইতে বদলির তিরস্কার, সবই নবান্নের কৃপা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy