Advertisement
০৬ নভেম্বর ২০২৪

পেশামাত্র

সমাজের চক্ষে যাহা ‘অনৈতিক’ নহে, সামাজিক নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখিবার প্রয়াসে সরকার তাহাকে অনৈতিক আখ্যা দিয়া সমাজকে সেই আখ্যা মানিতে বাধ্য করিতে পারে না।

শেষ আপডেট: ১৯ জানুয়ারি ২০১৯ ০০:০০
Share: Save:

সমাজের চক্ষে যাহা ‘অনৈতিক’ নহে, সামাজিক নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখিবার প্রয়াসে সরকার তাহাকে অনৈতিক আখ্যা দিয়া সমাজকে সেই আখ্যা মানিতে বাধ্য করিতে পারে না। মহারাষ্ট্রে ফের ডান্সবার খুলিবার ছাড়পত্র দিয়া সুপ্রিম কোর্টের দুই সদস্যের বেঞ্চ এই কথাগুলি বলিল। আশা করা চলে, দেশের সর্বোচ্চ আদালত তাহার সাম্প্রতিক রায়গুলির দার্শনিক অবস্থান হইতে বিচ্যুত হয় নাই। সরকারের চাপাইয়া দেওয়া নৈতিকতা তো নহেই, সামাজিক নৈতিকতাও বিচার্য নহে, আদালতের নিকট গ্রাহ্য শুধু সাংবিধানিক নৈতিকতা, আশা করা চলে যে সুপ্রিম কোর্ট এখনও সেই অবস্থানেই আছে। এই ক্ষেত্রে অবশ্য তত দূর যাওয়ার প্রয়োজন ছিল না। মহারাষ্ট্রে ডান্সবার নিষিদ্ধ করিবার জন্য তৈরি যে আইনটির ডালপালা ছাঁটিল শীর্ষ আদালত, তাহার সর্বাঙ্গে পুরুষতন্ত্রের ছাপ। ‘অশালীন নাচ’ হইতে ‘নারীর সম্ভ্রমরক্ষা’, পুরুষতন্ত্র নারীর শরীরকে যে চক্ষে দেখে, এই আইনও তাহাই দেখিয়াছিল। কোন নাচটি অশ্লীল, তাহা নির্ধারণের দায় যেমন সরকার স্বস্কন্ধে তুলিয়া লইয়াছিল, তেমনই সেই অশ্লীলতা হইতে নারীর সম্ভ্রম রক্ষার জন্যও সরকারই ‘নাইট ইন শাইনিং আর্মর’ হইয়া উঠিয়াছিল। ধর্মস্থান বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হইতে ডান্সবারের দূরত্ব রক্ষায়, লাইসেন্স পাইবার জন্য ‘চরিত্রবান’ হইবার বাধ্যবাধকতাতেও সেই শুচিতা রক্ষার তাগিদ প্রবল। স্পষ্টতই, যে নারী পানশালায় নাচিয়া জীবিকানির্বাহ করিতে চাহেন, মহারাষ্ট্রের বিজেপি সরকার তাঁহাকে ‘শুদ্ধ’ জ্ঞান করে নাই। তাঁহার জীবিকাচয়নের অধিকার কাড়িয়া লইয়া তাঁহার, এবং সমাজের, পবিত্রতা রক্ষা করিতে চাহিয়াছে। সুপ্রিম কোর্ট এই জেঠামহাশয়ের কান মলিয়া দিল বলিলে অত্যুক্তি হইবে না।

আদালতের নির্দেশটিকে অন্তত দুই ভাবে পাঠ করা সম্ভব। প্রথমটি নৈতিকতার পরিসরে। সরকারের মুখোশে খাপ পঞ্চায়েত বসাইবার মনোবৃত্তিটি যে সভ্য গণতন্ত্রে গ্রহণযোগ্য হইতে পারে না, আদালতের রায়ে সেই কথাটি পড়িয়া লওয়া যায়। দ্বিতীয় পাঠ ব্যক্তির স্বাধীনতা সংক্রান্ত। কোনও পেশার ‘নেগেটিভ এক্সটার্নালিটি’ বা নেতিবাচক অতিক্রিয়া সীমিত হইলে নৈতিকতার যুক্তিতে যে তাহাকে গণপরিসরের বাহিরে রাখা চলে না, শীর্ষ আদালতের রায়ে সেই কথা দ্ব্যর্থহীন। পানশালায় নর্তকী হওয়া একটি জীবিকা। কেহ স্বেচ্ছায় সেই পেশায় আসিতে চাহিলে তাঁহাকে বাধা দেওয়ার কোনও অধিকার সরকার বা সমাজের নাই। যাঁহাদের নিকট এই পেশা গ্রহণযোগ্য ঠেকিবে না, তাঁহারা এই গোত্রের পানশালায় না গেলেই হয়। যদি যথেষ্ট সংখ্যক মানুষ এই সিদ্ধান্ত করেন, বাজারের নিয়মেই ডান্সবার বন্ধ হইয়া যাইবে। আর, যদি চাহিদা থাকে, তবে জেঠামহাশয়দের ভিন্ন বারাণসী খুঁজিয়া লইতে হইবে।

আদালতের রায়ের ফলে কি ডান্সবারগুলিতে যথেচ্ছাচারের অধিকার মিলিল? না। ডান্সবারের পরিসরও সমাজেরই অন্তর্গত। ফলে, সমাজের অন্য পরিসরগুলিতে যে আচরণবিধি প্রযোজ্য, ডান্সবারেও তাহার ব্যতিক্রম হওয়া অনুচিত। নর্তকীদের নিকট পানশালাগুলি কর্মস্থল। পানশালার মালিক বা কর্তৃপক্ষ তাঁহাদের একটি নির্দিষ্ট কার্যে নিয়োগ করেন। যে কোনও কর্মস্থলে কর্মীর নিরাপত্তাবিধান যেমন নিয়োগকর্তার দায়িত্ব, পানশালার ক্ষেত্রেও তাহাই। কোনও ক্রেতা নর্তকীদের সহিত অশালীন আচরণ করিলে তাঁহাকে সামলানো কর্তৃপক্ষের কর্তব্য। তাহার জন্য যে ব্যবস্থা করিবার, করিতে হইবে। পানশালার উত্তেজনা যেন রাস্তায় চলিয়া না আসে, তাহা নিশ্চিত করিবে প্রশাসন— খেলা থাকিলে যেমন স্টেডিয়ামের ভিড় সামলাইতে পুলিশ পথে নামে। প্রয়োজনে সেই নিরাপত্তার খরচ সামলাইতে পানশালা হইতে অতিরিক্ত কর আদায় করা হউক। কিন্তু, নৈতিকতার কুযুক্তি খাড়া করিয়া একটি পেশার গায়ে কলঙ্কলেপনের অধিকার সরকারের নাই।

অন্য বিষয়গুলি:

Maharashtra Dance Bar Supreme Court
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE