প্রতীকী ছবি।
আমরা মার খেয়েও শিখলাম না। আজকের হিসাবে বিশ্বে প্রতি চারজন দৈনিক করোনা আক্রান্তের মধ্যে একজন ভারতের। শুক্রবার কোভিডের ছোবলের বলি ১৩৪০ জন হতভাগ্য। গত বছর কোভিডের প্রথম ঢেউয়ে দৈনন্দিন মৃতের সর্বোচ্চ সংখ্যা ছিল ১২৭৫। ইতিমধ্যেই হাসপাতালে বেডের জন্য হাহাকার। গত বছরের প্রথম ঢেউয়ে ভেসেছিল মূলত বড় শহরগুলিই। কিন্তু এ বার, বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, মফস্বল শহর ছাড়িয়ে দ্বিতীয় ঢেউ গ্রামীণ অঞ্চলেও আক্রান্তের বন্যা বইয়ে দিতে পারে। আর স্বাস্থ্য পরিষেবার যা হাল, তাতে মড়কের অর্থ আমাদের প্রত্যেককেই শুধু রোজগার হারানো দিয়েই নয়, জীবন দিয়েও অনুভব করতে হতে পারে।
অথচ এটা হয়তো এড়ানো যেত। যদি আমরা প্রথম ঢেউয়ের থেকে শিক্ষা নিতে তৈরি থাকতাম। প্রথম ঢেউ আমাদের জীবিকা ও জীবন কেড়েছে। দরিদ্রের তালিকায় আরও সাড়ে সাত কোটি মানুষের নাম উঠেছে। তবুও বাজার খুলেছে, এবং একটা আশার আলোও দেখা দিয়েছিল। কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ এবং আমাদের সম্মিলিত অবিমৃশ্যকারিতা এ বার সেই আশায় জল ঢালতে তৈরি।
মহারাষ্ট্রে দ্বিতীয় ঢেউয়ের শুরুতেই কিন্তু আমরা জানতাম এ বারের সংক্রমণের পিছনে অনেকটাই দায়ী আমাদের দায়হীন ব্যবহার। পশ্চিমবঙ্গ-সহ ভোটমুখী অন্য রাজ্যে রাজনৈতিক প্রচারে যখন দলমত নির্বিশেষে নেতা ও মিছিলের অংশীদারদের মাস্কহীন বিচরণ দেখা গেল তখন কিছু মানুষ প্রশ্ন তুলেছিলেন কোভিড বিস্মৃতি নিয়ে। কিন্তু, না মঞ্চ থেকে না অন্য ভাবে, প্রশাসন বা রাজনৈতিক নেতৃত্বের মুখ থেকে কোনও সাবধান বাণী শোনা গেল। যাঁরা এই নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন তাঁদের প্রশ্নের উপরেই প্রশ্নচিহ্ন বসে গিয়েছিল। কুম্ভ নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী আগ বাড়িয়ে বলে দিয়েছিলেন এই মেলা কোনও ভাবেই বন্ধ করা তো সম্ভব নয়ই, এমনকি, কোনও ভাবেই কাটছাঁট করাও উচিত নয়।
এর ফল? কুম্ভ থেকে দুটি আখাড়া শিবির গুটিয়েছে, একজন মহন্তের মৃত্যু হয়েছে, আখাড়া পরিষদের প্রেসিডেন্টও কোভিড আক্রান্ত এবং মহাস্নান নাকি সাধুরা কয়েকজন গিয়ে নিয়মরক্ষা করবেন! পশ্চিমবঙ্গে দুই প্রার্থীর মৃত্যু হয়েছে, এবং একাধিক প্রার্থী আক্রান্ত। কোভিড ছড়াচ্ছে। কুম্ভ শেষে, বিভিন্ন রাজ্যে ফিরে যাওয়া পুণ্যার্থীরাও কোভিড ছড়াবেন, এ নিয়ে কোনও সংশয় নেই। একই ভাবে ভোটের শেষে রাজ্যের সংক্রমিতের সংখ্যাও বাড়বে। বাড়বে মৃত্যুও।
প্রশ্ন ভোট বা ধর্মীয় অনুষ্ঠান নিয়ে নয়। প্রশ্ন সমাবেশের চরিত্র, কোভিড আচরণবিধি না মানা এবং এ নিয়ে নেতৃত্ব ও প্রশাসনের মুখ ফিরিয়ে থাকা নিয়ে। কিন্তু তার থেকেও বড় প্রশ্ন এ বার কী হবে, তা নিয়ে। ডিসেম্বর মাস থেকে বাজার ঘুরে দাঁড়ানো নিয়ে স্বাভাবিক কারণেই আমরা উত্সাহিত বোধ করেছিলাম। কিন্তু এপ্রিল মাস থেকেই বাজারে বিষণ্ণতা ছড়াতে শুরু করেছে। সরকারের দাবি যাই হোক না কেন, বাজার কিন্তু দুশ্চিন্তায়। বাজারের অনিশ্চয়তা আবার আয়ের উপর প্রভাব ফেলবে। ব্যবসার অনিশ্চয়তা কতটা তা দেখতে বিশ্বজুড়েই নমুরা সুচকের ওঠানামার উপর নজর রাখে। নমুরা ইন্ডিয়া বিজনেস রিজাম্পশন ইনডেক্স ফেব্রুয়ারি মাসেও ভারতের বাজার নিয়ে আশার কথা বলেছিল। কিন্তু ১১ এপ্রিল প্রকাশিত নমুরা সূচক মুখ থুবড়ে পড়েছে।
সবাই মনে করছে কোভিড থেকে বাঁচতে ভারতে হয়ত প্রথম ঢেউয়ের মতো লকডাউন হবে না। কিন্তু যা হতে পারে তা লকডাউনের থেকে কম নয়। বাজার চালু থাকে কেনা বেচার উপর। আর কেনা বেচা তখনই বাড়ে যখন ক্রেতা মনে করে সে খরচ করতে পারে। কোভিডের প্রথম ঢেউয়ের মধ্যে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক প্রকাশিত ক্রেতা আস্থা সূচক নেমে গিয়েছিল ৫০ পয়েন্টে। সেটা কিন্তু জানুয়ারি মাসের শেষে ৫৫.৫-এ উঠেছিল। তবে মাথায় রাখতে হবে বাজারে ক্রেতার আস্থা সূচক ২০১৯ সালের মার্চ মাসেও ১০০-র উপরেই ছিল। কচকচি ছেড়ে এক কথায় বললে ব্যাপারটা দাঁড়ায় এই রকম। দাবি যাই হোক না কেন, বাজার নিয়ে ক্রেতার আস্থা এখনও সে ভাবে ফেরেনি। আর তার মানে হল বাজারে চাহিদার দ্রুত ঘুরে দাঁড়ানোর আশা নেই। তার উপর কোভিডের এই দ্বিতীয় ঢেউ।
কোভিড ছড়ালে মানুষের ঘোরাফেরা কমবে। তা সে কোভিডের আতঙ্কেই হোক বা প্রশাসনিক নির্দেশেই হোক। আর ঘোরাফেরা কমা হল আর্থিক কর্মকাণ্ড কমার ইঙ্গিত। চলতি এপ্রিল মাসে খুচরো কেনাকাটা এবং রেস্তরাঁ যাওয়া কমেছে ৩০ শতাংশ। কিন্তু ওষুধের দোকান এবং সব্জি কেনাকাটা করতে যাতায়াত বেড়েছে ১৭ শতাংশ। যেটা আরও বেশি খেয়াল করার সেটা হল পার্ক বা বিচের মতো জায়গায় যাওয়া কমেছে ১৯ শতাংশ। এই তথ্য গুগলের। অর্থাত্ কোভিড বিধি না মানলেও মানুষের খরচের ভয় বাড়ছে। এবং বাড়ছে স্বাস্থ্য বাবদ খরচ। তা না হলে ওষুধের দোকানে যাতায়াত বাড়বে কেন?
ফেব্রুয়ারি মাসের তথ্যও বলছে কয়লা থেকে শুরু করে সিমেন্ট, ভারতের পরিকাঠামো শিল্পের মূল প্রতিটি ক্ষেত্রেই বৃদ্ধির হার পড়েছে। সিমেন্ট পড়েছে ৫.৫ শতাংশ। কয়লা ৪.৬ শতাংশ। স্টিল বা লোহা ১.৮ শতাংশ।
ছড়ানো ছেটানো এই তথ্যগুলি কিন্তু এক জোটে পড়লে আমার একটা ছবি পাই। আর তা হল কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ সেই ভাবে আসার আগেই কিন্তু আমরা ভাবতে শুরু করেছিলাম যে এলে কী করব। তাই আগে নিজেদের গুছিয়ে তুলতেই বাজে খরচ বন্ধ করে দিয়েছি। কারণ প্রথম ঢেউ সামলানোর লকডাউনের সময়ই আমাদের আয় কমেছে, চাকরি গিয়েছে, বিপন্নতা বেড়েছে। দ্বিতীয় ঢেউয়ে সেই বিপন্নতা বাড়বে বই কমবে না এই ভেবেই কিন্তু মানুষ প্রয়োজনীয়ের খরচের বাইরে হাঁটতে রাজি নয়। আর তার অভিঘাতে নড়বড়ে হয়ে থেকেছে শিল্পও। বাজারে যদি চাহিদার না বাড়ে তা হলে তো উত্পাদনও বাড়বে না। বাজার না থাকলে পণ্য তৈরি করে তা বিক্রি কী করে হবে?
উল্টো দিকে দাম বাড়ছে। সমীক্ষা বলছে মে মাসে পাইকারি দামের সূচক ১১ শতাংশ বাড়তে পারে। যার অনেকটাই হবে পরিবহণের খরচ বাড়ার জন্য। আর এই খরচের সিংহভাগই বেড়েছে পেট্রোপণ্যের দাম বাড়ার জন্য।
দাম বাড়া মানেই তো জীবন যাপনের খরচ বাড়া। একদিকে করোনার কারণে অনিশ্চিত আয়, আর অন্যদিকে নিশ্চিত মূল্যবৃদ্ধি। এই দুইয়ের চাপে সাধারণ ক্রেতা খরচ বাড়ানোর কথা ভাববে কোন সাহসে? এ এক অদ্ভুত বৈপরীত্য। আমরা কোভিড বিধি মানতে নারাজ। কিন্তু আবার আমরা আশঙ্কায় আছি কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ আমাদের আর্থিক কোমর ভেঙে দিতে পারে। আমরা মাস্ক পরছি না। কিন্তু কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কায় খরচে রাশ টেনেছি। আমরা ভোটের মিছিলে বেপরোয়া সঙ্গী কিন্তু বাজার ঘুরে দাঁড়াবে তাও সে ভাবে মানছি না। বিশ্বের বাজার কিন্তু ইতিমধ্যেই ভারত নিয়ে সংশয় প্রকাশ করতে শুরু করেছে। কারণ দেশের ভিতরের বাজারে যদি ক্রেতার এই সংশয় থাকে, তাহলে বিশ্ব সেই বাজারকে অন্য ভাবে দেখবে তা মনে করার কোনও কারণ নেই।
উল্টোদিকে, মাথায় রাখতে হবে মহারাষ্ট্র-সহ ৫টি রাজ্যের হাল যদি ইঙ্গিত হয় তা হলে এই দ্বিতীয় ঢেউয়ের চাপ অনেক বেশি হবেই। কিন্তু এখনও পর্যন্ত এ ব্যাপারে প্রশাসনিক তত্পরতা সেই ভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে না। যেমন কেন্দ্রীয় বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ে অবস্থান। একদম শেষ মুহূর্তে এসে পরীক্ষা নিয়ে সিদ্ধান্ত জানাল বোর্ড। অথচ এই ঢেউ যে বাচ্চাদেরও ছাড়ছে না, তা অনেক আগেই জানা হয়ে গিয়েছিল।
কী ভাবে যুঝব এই আঘাত? কেন্দ্রের কাছ থেকে এখনও কোনও ইঙ্গিত নেই। কোথাও গিয়ে মনে হচ্ছে, সরকারের কাছেও দিশাটা স্পষ্ট নয়। যদি তা সত্য হয়, তা হলে তা ভয়ানক। লক ডাউন হয়ত হবে না। কিন্তু অসুস্থ মানুষ দিয়ে শিল্প চলে না। আর এখনও পর্যন্ত যা দেখা যাচ্ছে তাতে এক জনের হলে আশেপাশে কাউকেই ছাড়ছে না এই কোভিড। তাই লকডাউন না হলেও, বাজার থমকাবেই। কর্মহীনতা বাড়ার সম্ভাবনাও তৈরি হচ্ছে। তাই সরকার যাই বলুক, যাই ভাবুক, কোভিডের ছোবলে বাজার নীল হতে শুরু করেছে। হাসপাতালে বেড নিয়ে হাহাকার বাড়ছে। কচকচানি না বাড়িয়ে এই সমস্যা বাড়বে এটা ধরে নিয়েই কিন্তু সরকারকে এই যুদ্ধ কী ভাবে লড়া হবে তার নীল নকশা প্রকাশ করতে হবে। তা না হলে বাজারে অনিশ্চয়তা বাড়বে। আর তা বাজারের কোনও মহলেরই অভিপ্রেত নয়। সরকারেরও তা হওয়া উচিত নয়। বিশেষ করে সেই বার্তা যা বলে সরকার দিশাহীন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy