Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Birds

পাখির চোখে

মানুষের চোখে যে সকল পশুপক্ষী ধূসর, বিবর্ণ, পাখিদের চোখে তাহাদেরই কোনও কোনওটি দ্যুতিময়, বর্ণচ্ছটায় উজ্জ্বল।

শেষ আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০২১ ০৫:০৩
Share: Save:

পাখি হইয়া আবার ফিরিতে চাহিয়াছিলেন বাংলার রূপমুগ্ধ কবি। শঙ্খচিল, শালিক, কার্তিকের ভোরের কাক, কলমি-গন্ধী পুকুরের হাঁস, ইহারাই বাংলার অভিজ্ঞান। সেই কারণেই, জন্মান্তরে কবির খোঁজ মিলিবে রক্তিম মেঘের উপর উড়ন্ত ধবল বকে, লিখিয়াছেন জীবনানন্দ দাশ। কিন্তু বক কিংবা শঙ্খচিলের চোখ দিয়া দেখিলে কি চিরপরিচিত বাংলার সবুজ, করুণ রূপটিই ধরা পড়িবে? মানুষের চোখে যাহা ছায়াবৃত, শান্ত গ্রাম, পাখির চোখে তাহাই হয়তো শতগুণে বর্ণময়, অস্থির, আন্দোলিত এক ভূখণ্ড। পাখি হইয়া দেখিলে এই চরাচর দেখিতে-শুনিতে কেমন লাগে, বিজ্ঞানী ও পক্ষিপ্রেমীদের নানা গবেষণা আর নিরীক্ষায় তাহার আভাস মিলিতেছে। গবেষকদের দাবি, পাখিদের অভিজ্ঞতায় যে বিশ্ব ধরা দেয়, তাহা অতি সমৃদ্ধ, অতি বিচিত্র। মানুষ যতগুলি রং দেখিতে পায়, পাখি পায় তাহা অপেক্ষা অধিক। তাহারা অতিবেগুনি রশ্মি দেখিতে পায় বলিয়া তাহাদের বিশ্বের রংরূপ আমাদের তুলনায় ভিন্ন। মানুষের চোখে যে সকল পশুপক্ষী ধূসর, বিবর্ণ, পাখিদের চোখে তাহাদেরই কোনও কোনওটি দ্যুতিময়, বর্ণচ্ছটায় উজ্জ্বল। বঙ্কিমচন্দ্র যখন বলিয়াছেন, “পুষ্প আপনার জন্য ফোটে না,” তখন সম্ভবত মানবচিত্তের মুগ্ধতা উৎপাদনকেই ফুলের কাজ বলিয়া ঠাহর করিয়াছিলেন। কিন্তু হায়! ফুল-ফলের আনন্দযজ্ঞে মানুষ অনাহূত অতিথির ন্যায়— পতঙ্গ ও পাখিদের জন্যই উদ্ভিদজগতের এই বর্ণময় আয়োজন, দাবি করে বিবর্তনের বিজ্ঞান। কোথায় মিলিবে পরাগরেণু, অতিবেগুনি রশ্মির সঙ্কেত গায়ে আঁকিয়া তাহা দেখাইয়া দেয় ফুল। দর্শনে যেমন, শ্রবণেও তেমনই। দোয়েল-শ্যামার গান বড়ই মধুর, মানুষ তাহাকে উদীয়মান সূর্যের অভ্যর্থনা বলিয়া কল্পনা করিয়া কতই কাব্য-সঙ্গীত রচনা করিয়াছে। বাস্তব কিছু ভিন্ন— সঙ্গীকে ডাকিতে যেমন গান গাহে পাখি, তেমনই নিজের এলাকা ঘোষণা করিতে, প্রতিযোগী পাখিকে সতর্ক করিতে। যাহাকে নিকষিত হেমের ন্যায় প্রেমের কলতান বলিয়া মনে হয়, আসলে হয়তো তাহা পাহারাদারের হুঙ্কার— ‘তফাত যাও’।

কেহ বলিতে পারেন, শাখা-প্রশাখা হইতে যুদ্ধঘোষণা, ইহাই তো আজ ‘বাংলার মুখ’। কিন্তু এমন সাদৃশ্য রচিবার ঝোঁকও সামলাইতে হইবে। মানুষের বড় কু-অভ্যাস, তাহারা নিজের মাপে জীবজগৎকে মাপিতে চায়। তাহার অপেক্ষা অল্প অথবা অধিক, তাহার পোষ্য অথবা প্রতিদ্বন্দ্বী, এমন দ্বৈতের মধ্যে ধরিতে চাহে সকল প্রাণীকে। এই মানবকেন্দ্রিকতা (অ্যানথ্রোপমর্ফিজ়ম) যে ভ্রান্ত এবং অর্থহীন, সে কথাটি বিজ্ঞানের দুনিয়ায় ক্রমশ শক্তি সঞ্চয় করিতেছে। কাক নুড়ি ফেলিয়া পাত্রের জল উপরে তুলিতে পারে (সত্যিই যে পারে, তাহা পরীক্ষায় প্রমাণিত), কাঠকুটাকে যন্ত্রের মতো ব্যবহার করিয়া কার্যসিদ্ধি করিতে পারে, অতএব তাহার ‘বুদ্ধি’ একটি পাঁচ বৎসরের শিশুর ন্যায়, এমন বিচার কাকের বোধশক্তিকে ধরিতে পারে না। মানুষের মাপকাঠিতে পাখির বিচার হয় না। মানুষের ছুটিবার গতি মাপিয়া অথবা উড়িবার অক্ষমতা দিয়া কি মানুষকে বোঝা যায়? পাখিরা কী শিখিতে পারে, কী করিতে পারে, তাহা প্রতিনিয়ত নূতন করিয়া বুঝিতে হইতেছে। চার হাজার প্রজাতির পাখি গান গাহিতে পারে, কিন্তু স্বজাতির গান শুনিয়া গাহিতে না শিখিলে পারে না। এবং একই গান কোনও পাখি দুই বার গাহে না।

যাঁহারা আপন আগ্রহে পাখিদের নিরীক্ষণ করেন, তাঁহাদের চোখে ধরা পড়িয়াছে এমন নানা সত্য। কারণ, পেশাদার বিজ্ঞানী কেবল ‘তথ্য’ অনুসন্ধান করেন, পক্ষিপ্রেমী অনুসরণ করেন পাখিকে। বৃক্ষ, পতঙ্গ অথবা পক্ষীকে বুঝিতে হইলে কেবল তাহাদের আচরণ লক্ষ করিলেই হয় না। তাহারা যে ভাবে পারিপার্শ্বিককে অনুভব করে, তাহার আভাস পাইবার ইচ্ছাও চাই। মানুষের অভিজ্ঞতা এবং অনুভূতি হইতে তাহা এতই ভিন্ন যে, কল্পনার আশ্রয়ও লইতে হয়। পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র মানুষের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নহে, কিন্তু পাখিদের গোচর। হাউ ইট’স লাইক টু বি আ বার্ড বইতে পক্ষিবিশারদ ডেভিড অ্যালেন সিবলে বলিয়াছেন, হয়তো নীল আকাশে রক্তিম রেখার ন্যায় চৌম্বকক্ষেত্রটি প্রত্যক্ষ করে পরিযায়ী পাখিরা। বহু বৎসর নিরীক্ষার পর কখনও পক্ষী-জগৎ অল্প একটু দ্বার খুলিয়া দেয়। সংযোগ হয় অপরিচিত বিশ্বের সহিত। শিমুলের ডালে বসা লক্ষ্মীপেঁচাটির ভুবন অপার সৌন্দর্যময়, কিন্তু মানুষ সেখানে অকিঞ্চিৎকর— এমন বোধ হইতে যে বিনয়াবনত বিস্ময় জন্মায়, তাহাই সম্ভবত মানবজীবনের সোনার কাঠি।

যৎকিঞ্চিৎ

করোনার দ্বিতীয় প্রবাহে হইচই ফেলে দিয়েছে স্পুটনিক-ভি। পঞ্চাশের দশকে প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ স্পুটনিক মহাকাশে পাঠিয়ে চমকে দিয়েছিল রাশিয়া, এ বার একই নামের চমক তাদের কোভিড-টিকায়। এর মধ্যেই বরাত দিয়েছে ইজ়রায়েল থেকে মেক্সিকো, ভারতেও নাকি তৈরি হবে, চুক্তি পাকা। ইউরোপ এখনও এ টিকার অনুমোদন দেয়নি, আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট দু’ডোজ় নিয়েও করোনাক্রান্ত, তাতেও রুশ উসখুস নেই। শোনা যাচ্ছে, টিকা-কূটনীতির নতুন নাম রাখা হচ্ছে ‘স্পুটনীতি’।

অন্য বিষয়গুলি:

Birds
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy