ঈশানী দত্ত রায়ের প্রবন্ধ ‘ইচ্ছে করে ভালবাসি তাকে’ (২৮-১২) শুনিয়েছে সন্তানকে ঘিরে বাবা-মায়ের স্বপ্ন দেখা আর সবার পিছে সবার নীচে যারা থাকে তাদের উত্তরণের কাহিনি। প্রসঙ্গত, প্রতিযোগিতায়, শ্রেণিকক্ষে, মাঠে-ময়দানে দৈনন্দিন জীবনযুদ্ধে সন্তানের হেরে যাওয়া বা পিছিয়ে থাকার যন্ত্রণা বাবা-মায়ের কাছে চিরকাল থেকে যায়। এ যন্ত্রণা একমাত্র বাবা-মায়েরই, তাঁদেরই বয়ে বেড়াতে হয় আমৃত্যু। বাবা-মায়ের সন্তানকে ঘিরে স্বপ্ন বোনা যে দেশ-কাল ঊর্ধ্বে। তিনি যে প্ল্যাটফর্মে পা রাখতে সমর্থ হননি, সন্তান যেন সেই স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে সেই স্বর্ণশিখরে পৌঁছতে পারে, সেই আশাতেই বাঁচেন তাঁরা— ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে।’ (রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র) সে কারণেই পরাজয় মানতে নারাজ; তাই প্রি-স্কুল থেকে প্রতিযোগিতায় ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। কচিকাঁচাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে বইয়ের বোঝা। খেলার মাঠ নেই, নীল আকাশ নেই, অপু দুর্গা নীলু রাণুদের ভিড় নেই। আছে গগনচুম্বী অট্টালিকা, আর বইয়ের বোঝায় ন্যুব্জ শিক্ষার্থীদের দেহ-মন-প্রাণ।
পরীক্ষা বাবা মায়েরও। ‘আমার পরীক্ষা তো ২ ডিসেম্বর, আপনার কবে?’ এত চাপে শ্লথগতিতে উপরে উঠতে থাকা সন্তানের জীবন সংশয়ও যে হতে পারে, অবগত হয়েও আশা ছাড়েন না। ফলে কৈশোরেই শুরু সন্তানের সঙ্গে পিতা-মাতার বিরোধ। এই প্রসঙ্গে জয় গোস্বামীর ‘টিউটোরিয়াল’ কবিতাটি বড় প্রাসঙ্গিক। “তোমাকে পেতেই হবে শতকরা অন্তত নব্বই (বা নব্বইয়ের বেশি)/ তোমাকে হতেই হবে একদম প্রথম/ তার বদলে মাত্তর পঁচাশি!/ পাঁচটা নম্বর কেন কম? কেন কম?/ এর জন্যে আমি রোজ মুখে রক্ত তুলে খেটে আসি?”
লেখক বলেছেন, “...গত পাঁচ বছরে স্কুলের বড় বড় সব পরীক্ষায় প্রথম তিন জন পরবর্তী কালে কী হয়েছে? খোঁজ নিয়ে দেখবেন তো।” প্রশ্ন তুলেছেন, শেষ বেঞ্চে বসা বা পিছিয়ে পড়া ছেলেমেয়েরা কি প্রতিষ্ঠিত হয়নি? আজীবন শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত থাকায় তাঁর সঙ্গে সহমত পোষণ করেও বলছি, প্রথম তিন জন পরবর্তী কালে পিছিয়ে গেলেও কর্মক্ষেত্রে বা জীবনযুদ্ধে সুপ্রতিষ্ঠিত। কারণ মেধাকে অস্বীকার করা যায় না। অন্য দিকে এই আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে পিছিয়ে পড়াদের জীবনযুদ্ধে প্রতিষ্ঠিত হওয়া দুরূহ, কঠিন। ফলে তারে জ়মিন পর বা থ্রি ইডিয়টস চলচ্চিত্রে যা সম্ভব, বাস্তবে বড় কঠিন। তবে অনস্বীকার্য, এই পিছিয়ে পড়া পডুয়ারা মানবিক গুণে গুণান্বিত, যা বহু ক্ষেত্রেই প্রথম সারির সুপ্রতিষ্ঠিতদের মধ্যে দুর্লভ। অন্য দিকে,‘লাস্ট ম্যান স্ট্যান্ডিং’-এর ব্যাখ্যা মূলত রণক্ষেত্রে কি? রণক্ষেত্রে সবাই যখন হতাহত, তখনও শেষ মানুষটি লড়ে যাচ্ছে রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত দেহে। আসলে সে-ই তো প্রথম। সে ক্ষেত্রে গোলরক্ষক বা ক্রিকেটে টেলএন্ডার ব্যাটার কখনও কখনও দুর্গরক্ষা করে একা কুম্ভ হয়ে। কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রে, কর্মক্ষেত্রে, সর্বোপরি এই আর্থ-সামাজিক বা ঘোলা রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে পথ বড়ই কর্দমাক্ত, পিছল, কণ্টকাকীর্ণ। তবুও আমরা আশাবাদী।
সূর্যকান্ত মণ্ডল, কলকাতা-৮৪
নূতনের অঙ্কুর
বর্ষশেষে লেখা প্রবন্ধ ‘ইচ্ছে করে ভালবাসি তাকে’-তে শীর্ষক প্রবন্ধে ঈশানী দত্ত রায় একেবারে সার কথাটাই বলেছেন, “শেষে তো শেষ নয়। শুরু। পুরনো বছরের মতো।” ‘শেষ’কে শেষ বলে দেখলে যে জীবনে পথ চলারও শেষ হয়ে যায়, এটা অনেকেই বুঝতে পারেন না। লেখকের উক্তিটি তাই ভীষণ আশাব্যঞ্জক। যাঁরা একেবারে ধরেই নিয়েছেন তাঁদের দ্বারা আর কিছুই হবে না এবং এই ভাবনার কবলে পড়ে যাঁরা স্থাণুবৎ জীবন কাটাচ্ছেন, এই প্রবন্ধটি তাঁদের উদ্বুদ্ধ করবে।
ইতিহাসে এ রকম বহু জ্ঞানীগুণী রয়েছেন যাঁরা প্রথম জীবনে সাফল্যের মুখ দেখেননি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শৈশবের কথা তো সর্বজনবিদিত। প্রথাগত পড়াশোনা ছাড়াই তিনি নিজে ইতিহাস। সাহিত্যে নোবেলজয়ী। বিশ্বের সর্বকালের সেরা বিজ্ঞানীদের অন্যতম আলবার্ট আইনস্টাইন জীবনের প্রথম নয়টি বছর ভাল করে কথাই বলতে পারতেন না। স্কুলে তাঁর গ্রেড এমনই খারাপ হচ্ছিল যে তাঁর সম্বন্ধে স্কুল কর্তৃপক্ষের ধারণাও খুব বিরূপ হয়ে পড়ছিল। পলিটেকনিক স্কুলও তাঁকে ভর্তি নিতে অস্বীকার করে। আবার, বিবর্তনবাদের প্রবক্তা চার্লস ডারউইনকে তাঁর তত্ত্ব-সম্বলিত বই অন দি অরিজিন অব স্পিসিজ় প্রকাশের জন্য দীর্ঘ কুড়িটি বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল। আর এক বিখ্যাত বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসন, যিনি ইলেকট্রিক বাল্ব এবং গ্রামোফোনের আবিষ্কর্তা, তাঁকেও স্কুলে শুনতে হয়েছিল “এত বোকা ছেলের পক্ষে কিছু শেখাটাই অসম্ভব।”
সুতরাং, ছেলেমেয়েদের ব্যর্থতায় হতাশ বাবা-মায়ের মনে আলোচ্য প্রবন্ধ আশার আলো জাগিয়ে তুলবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানেও আছে “শেষ নাহি যে, শেষ কথা কে বলবে?” আবার ‘শেষ’কে নতুনের শুরু রূপেও যে দেখা যেতে পারে তা-ও বলেছেন ওই একই গানে, “পুরাতনের হৃদয় টুটে, আপনি নূতন উঠবে ফুটে।”
গৌতম নারায়ণ দেব, কলকাতা-৭৪
স্থৈর্য কোথায়
ঈশানী দত্ত রায়ের প্রবন্ধের শেষে থেকে শেষ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকার যে কয়েকটা উদাহরণ তুলে ধরেছেন তার কতটুকুই বা আমরা অভ্যাস করি? আজ যেখানে চোখের পলকে ভাইরাল, ট্রোলিং, ব্রেক আপ, মুভ অন চলছে, সেখানে ‘লাস্ট ম্যান স্ট্যান্ডিং’-সুলভ ধৈর্য-স্থৈর্য কোথায়? আন্তর্জাল বেঁধে ফেলছে আমাদের, দিনভর টুংটাং নোটিফিকেশনে শুধুই গরল আর অনিদ্রা! ছোটবেলায় পরীক্ষার রেজ়াল্টের কম্পিটিশন ছিল, বড় হয়ে সমাজমাধ্যমে ভাল থাকা আর অ্যাচিভমেন্টের রংবাহারি পোস্ট। আজকালকার আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের বদলে ফুটে ওঠে স্ট্রেস-অ্যাংজ়াইটি-ডিপ্রেশন, তাই মনোবিদের দ্বারস্থ হয়ে শূন্য থেকে বাঁচা শিখতে হয়। তাই নতুন বছরে নতুন শপথের মোড়কে পুরনো জীবন নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা।
ব্যর্থতার ঘন অন্ধকার কিংবা সাফল্যের চটকদার উদ্যাপনে হারিয়ে না গিয়ে জীবনের স্রোতে ভাসতে ভাসতে হাসি-কান্নার কিছু সহজ সুন্দর মুহূর্ত আঁজলা ভরে যেন নিতে পারি নতুন বছরে।
অনিশা ঘোষ, পান্ডুয়া, হুগলি
পুতুল নয়
ঈশানী দত্ত রায়ের লেখা ‘ইচ্ছে করে ভালবাসি তাকে’ প্রবন্ধটি অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত ও বাস্তববাদী। মানুষের আকাঙ্ক্ষা, চাহিদা, অভিলাষ এত বেড়ে গিয়েছে যে, তার প্রভাব পড়ছে আজ আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের উপর। অভিভাবকরা সন্তানকে আজ নামিয়ে দিয়েছে ইঁদুর দৌড়ের মাঠে। প্রথম তাকে হতেই হবে। যেন খেলনা পুতুল। সকালবেলা চাবি দিয়ে ছেড়ে দিচ্ছেন। আর সারাদিন বন বন করে ঘুরছে। সন্ধ্যাবেলায় ক্লান্ত পরিশ্রান্ত অবসন্ন দেহ-মনে বাড়িতে ফিরছে। সকালবেলায় আবার চাবি...
কোথায় শৈশব? খোলা আকাশ, খেলার মাঠ, পুকুর, নদী, গল্পদাদুর আসর, ঠাকুরমার ঝুলি, একটু বিনোদন— সব যেন শিশুদের জীবন থেকে হারিয়ে গিয়েছে। কারণ অভিভাবকরা আজ স্বপ্নের ফেরিওয়ালা। সন্তানকে প্রথম, দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় হতেই হবে। কিন্তু পৃথিবীতে, সমাজ-সংসারে এমনও দেখা গেছে শেষ বেঞ্চে বসা ছেলেটি অথবা দৌড় প্রতিযোগিতায় সব শেষের ছেলেটি এক সময় জীবনে এমন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যা কল্পনার অতীত। সুতরাং মনে রাখতে হবে ‘শুরু থেকে শেষ’ আবার ‘শেষ থেকে শুরু’ও হয়। সুতরাং লাস্ট বেঞ্চের শিশু, দৌড় প্রতিযোগিতার শেষের ছেলে বা মেয়েটি,পরীক্ষায় কম নম্বর পাওয়া সন্তান, রেসের মাঠের শেষ ঘোড়াটি— কেউ যেন অনাদৃত না হয়। তাদের আমাদেরই পরম যত্নে ভালবাসা দিতে হবে। সেই ভালবাসাই তাকে পৌঁছে দেবে উন্নতির চরম শিখরে।
স্বপন আদিত্য কুমার বিশ্বাস, অশোকনগর, উত্তর ২৪ পরগনা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy